ফিচার

আশ্রয়ণের আলোয় মাহীদের ঘুরে দাঁড়ানো

মো. জাকির হোসেন

Advertisement

‘এই যে ভাই! আমগোরো সাহায্য করেন, কয়টা টেকা দেন। আরে ভাই, আমরাও মানুষ! আমরাও মা-বাবার সন্তান। পেটের টানেই আপনাগো কাছে হাত পাতছি।’ কথাগুলো একজন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের। দৌলতদিয়া ফেরি ঘাটের ৪ নাম্বার পন্টুনের রো রো ফেরিতে যানবাহন লোডিংয়ের সময় একটি সাদা পাইভেট গাড়ির দরজার সামনের দৃশ্য।

বলছি ২০২২ সালের জুলাই মাসের ঈদুল আজহার কথা। যাত্রী পারাপার নির্বিঘ্ন এবং ঘাটের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে গিয়ে চোখে পড়ে এ দৃশ্য। আশেপাশে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, তৃতীয় লিঙ্গের বেশ কয়েকজন দৌলতদিয়া ঘাটের আশেপাশেই একটি ভাড়া করা ঘরে বসবাস করে। খোঁজ নিই তাদের দলনেতা কে? মাহী তাদের দলনেতা। দৌলতদিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান মন্ডলের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানতে পারি, মাহী এবং তার দল পেট্রোল পাম্পের পাশে জেলা পরিষদের পুরাতন ডাক বাংলোর পেছনে থাকে। পরদিন ঈদ উপলক্ষে মাহীদের জন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কিছু ঈদ উপহার দিতে যাই। ছোট্ট একটা ঘরে ১০-১২ জন থাকে। ঘরের সামনে একটা টিনশেড। সেখানে কয়েকটি গরু পালন করছে মাহীরা। বেশ বড় সাইজের। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী করবে?’ মাহী হাসিমুখে জানালো একটা কোরবানি দেবে। বাকি দুইটা হাটে বিক্রি করবে। একে একে মাহীর গ্রুপের সবার সঙ্গে পরিচিত হলাম। ঈদ উপহার সবাই হাসিমুখে বরণ করে নিলো। কয়েকজনের চোখে আনন্দ অশ্রু। উপস্থিত সবাইকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে জমিসহ ঘরের মালিকানা দিলে থাকবে কি না?’ উৎসুক দৃষ্টিতে এবং হাসিমুখে সবাই একবাক্যে বলল, ‘অবশ্যই আমরা থাকবো। আমাদের কোনো পরিচয় নাই, ঠিকানা নাই। শুনছি আমাদের প্রধানমন্ত্রী যাদের ঘর-বাড়ি নাই; তাদের ঘর করে দেন।’ মাহীদের আগ্রহ দেখে সবাইকে কথা দিয়ে আসি, প্রধানমন্ত্রীর উপহার আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় ২ শতাংশ জমিসহ একটি করে সেমিপাকা ঘরের ব্যবস্থা করবো। এটিও জানতে চাই, আশ্রয়ণের মাধ্যমে পুনর্বাসন করা হলে অন্য কোথাও যাবে কি না বা আশেপাশে, ঘাটে কিংবা হাটে কোনো প্রকার বিরূপ আচরণ করবে কি না? সবাই কথা দেন, থাকার ব্যবস্থা হলে তারা গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি পালন করে জীবন চালিয়ে নেবে।

আরও পড়ুন: তাজউদ্দীন আহমদ: বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী

Advertisement

২০২২ সালের কোরবানি ঈদের পরদিন থেকেই শুরু করি উপর্যুক্ত খাস জমি খোঁজা। প্রথমত এমন একটি জায়গা বের করতে হবে যেটি গ্রোথ সেন্টারের কাছাকাছি। সহকারী কমিশনার (ভূমি), প্রকল্প বাস্তবায়নকারী কর্মকর্তা (পিআইও), ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা, সার্ভেয়ারসহ খাস জমির সন্ধান করতে করতে দৌলতদিয়া ইউনিয়নেই সন্ধান মেলে। মহাসড়কের কাছেই। ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান, মেম্বারসহ উপজেলা টিম সিদ্ধান্ত নিই সেখানেই মাহীদের জন্য ঘর নির্মাণ করবো। ইউপি চেয়ারম্যান আশ্বাস দেন, পরদিন থেকেই মাটি ভরাটের ব্যবস্থা নেবেন। পরের দিন সকালে চেয়ারম্যান ফোনে জানান, ভেকু দিয়ে মাটির কাজ শুরু করার সময় স্থানীয় লোকজন বাঁধা দিচ্ছে। ছুটে যাই সেখানে। সঙ্গে উপজেলা চেয়ারম্যান, গোয়ালন্দ ঘাট থানার অফিসার ইন-চার্জ, পিআইওসহ বেশ কয়েকজন। এরই মধ্যে রাজবাড়ী-১ আসনের সংসদ সদস্য এবং জেলা প্রশাসক মহোদয়ের সঙ্গে কথা হয় এবং বিস্তারিত অবহিত করি। দুজনেই আশ্বাস দেন, প্রধানমন্ত্রীর প্রকল্প বাস্তবায়নে সব ধরনের সহযোগিতা দেবেন। কয়েক ঘণ্টা উপস্থিত স্থানীয় জনগণের সঙ্গে বিস্তারিত কথা বলে সবার আন্তরিক প্রচেষ্টায় মাটি ভরাটের কাজ শুরু হয়।

নির্মাণশ্রমিক নিয়োগ, ইট, রড, সিমেন্ট, বালি, কাঠ, টিন এবং অন্য মালামাল কিনে আশ্রয়ণ প্রকল্পের স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী গুণগত মান বজায় রেখে শুরু হয় ঘর নির্মাণের কর্মযজ্ঞ। নিয়মমাফিক ঘর নির্মাণ কাজ প্রতিনিয়ত তদারকি হয়। আস্তে আস্তে দৃশ্যমান হয় সেমিপাকা দুই কক্ষ বিশিষ্ট সাতটি ঘর। প্রতিটি ঘরের ভেতরেই অ্যাটাচড টয়লেট এবং রান্নাঘর। উপরে রঙিন টিন। বিদ্যুৎ সংযোগ এবং টিউবওয়েল স্থাপন করা হয় প্রতিটি ঘরে। মিলন (মাহিয়া মাহী), রোকেয়া আক্তার, অন্তরা খাতুন, রনি চৌধুরী, নিলিমা, রোকেয়া এবং আকাশ মন্ডলের নামে বন্দোবস্ত, কবুলিয়ত এবং নামজারি সম্পাদন শেষে সার্টিফিকেটসহ ঘরের চাবি এবার বুঝিয়ে দেওয়ার পালা।

ঘরের চাবি হস্তান্তরের সময় আবারো স্থানীয় মাতব্বরের আপত্তি। আশঙ্কা করা হয়, মানুষ যদি এই পাড়ার নাম দেয় ‘হিজড়া পাড়া’। আবার স্থানীয় চেয়ারম্যান, মেম্বার, পিআইও, নির্বাচন অফিসার, আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ, স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিসহ দীর্ঘক্ষণ আলোচনার মাধ্যমে আশঙ্কার পরিসমাপ্তি ঘটে। অবশেষে হাসিমুখে সবাই মাহীদের বরণ করে নেয়। সবাই আশ্বস্ত করে, তারা মাহীদের পড়শি হিসেবেই দেখবে। আমরাও মাহীদের হাতে ঘরের চাবি বুঝিয়ে হাসিমুখে বিদায় নিই। ফেরার সময় মাহীদের কাছে আমাদের প্রত্যাশা, তারা যেন ঘুরে দাঁড়ায় নিজেদের পরিচয়ে।

আরও পড়ুন: হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী খেলা

Advertisement

কিছুদিন আগে মাহী তার দল নিয়ে অফিসে হাজির। হাতে ব্যাগভর্তি সবজি। হাসি দিয়ে জানায়, আশ্রয়ণে বোনা প্রথম ফলন ইউএনওকে উপহার দিতে এসেছে। আমি প্রথম ক্রেতা হিসেবে হাসিমুখে ক্রয় করে নিই। মাহীর নেতৃত্বে বসবাসরত তৃতীয় লিঙ্গের সবাই এখন ঘুরে দাঁড়িয়েছে। পরিপাটি করে সবাই ঘর সাজিয়েছে। গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি পালন করছে। সবজি চাষ করছে, ঘরের চারপাশে নানা ফলের গাছ বুনেছে। সবাই এখন জমিসহ ঘরের মালিক। একসময়ের ভিটেমাটি ছাড়া পরিচয়হীন মাহীরা এখন জমিসহ ঘরের মালিক। পড়শিদের সঙ্গে ভাব জমেছে মাহীদের। আশ্রয়ণের বুকে পরম মমতায় গেঁথে আছে মাহীদের ঠিকানা। ঘুরে দাঁড়ানো তৃতীয় লিঙ্গের মাহীদের চোখমুখে এখন প্রত্যয়ের আভা।

যখনই তৃতীয় লিঙ্গের মাহীদের দেখতে যাই, প্রতিবারই গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে মন খুলে দোয়া করে প্রধানমন্ত্রীর জন্য। প্রধানমন্ত্রীর দৃপ্ত ঘোষণা ‘একজন মানুষও গৃহহীন থাকবে না’। এটি আজ বাস্তব। ১৯৯৭ সালে আশ্রয়ণ প্রকল্পের যাত্রা শুরু হয়। পুনর্বাসিত পরিবার সংখ্যা ৫ লাখ ৫৫ হাজার ৬১৭টি এবং পুনর্বাসিত জনসংখ্যা ২৭ লাখ ৭৮ হাজার ৮৫ জন। প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার এ প্রকল্পের আওতায় মুজিববর্ষ উপলক্ষে এরই মধ্যে ৯টি জেলা, ২১১টি উপজেলা ভূমিহীন-গৃহহীনমুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। বরাদ্দকৃত গৃহের সংখ্যা ২ লাখ ৩৮ হাজার ৮৫১টি এবং পুনর্বাসিত জনসংখ্যা ১১ লাখ ৯৪ হাজার ২৫৫ জন। এসব গৃহ নির্মাণে শ্রমিক মজুরি বাবদ ব্যয় ১ হাজার ২৫৯ কোটি টাকা এবং ব্যয়িত শ্রমঘণ্টা ১৫ কোটি ৫৫ লাখ ২১ হাজার ৭৪৭। আজ আরও ১২টি জেলা এবং ১২৩টি উপজেলাকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভূমিহীন-গৃহহীনমুক্ত ঘোষণা করেছেন। একই সঙ্গে গোয়ালন্দ উপজেলা এবং রাজবাড়ী জেলা ভূমিহীন-গৃহহীনমুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রীর অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের সুফল আজ সব প্রান্তে। মৌলিক চাহিদার অন্যতম উপাদান জমির মালিকানাসহ ঘর শুধু আশ্রয়ণের উপহারই নয়, এটি উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণে এক বিজয় গাঁথার প্রতিচ্ছবি। মাহীদের মতো হাজারো আশ্রয়হীন এবং ঠিকানাবিহীন মানুষ আজ ২ শতাংশ জমিসহ ঘরের মালিক। সবুজের হাতছানি ঘরের চারপাশ। সতেজ এবং প্রাণোচ্ছ্বাসে উদ্বেলিত লাল-সবুজের বাংলাদেশ। জাতির পিতার আজন্ম স্বপ্নের সোনার বাংলা অর্জনে উন্নয়ন অভিযাত্রার মহাসড়কে বাংলাদেশ।

সাবাস বাংলাদেশ, এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়।

লেখক: উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, গোয়ালন্দ, রাজবাড়ী।

এসইউ/এএসএম