কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ৮০০ কোটি টাকা গায়েব হয়ে যাওয়ায় গভর্নর আতিউর রহমানকে বিদায় নিতে হলো মেয়াদ শেষের কয়েক মাস আগে। আতিউরের উত্তরসূরি হিসেবে সাবেক অর্থ সচিব ফজলে কবিরের নাম ঘোষণা করা হয়েছে। সোনালী ব্যাংকের এই চেয়ারম্যান বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছেন।প্রকাশ্যে ক্ষোভ প্রকাশ করে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতই গভর্নরকে পদত্যাগে বাধ্য করেছেন। অর্থমন্ত্রী হিসেবে তিনি অপমানিতই বোধ করেছিলেন। এবং তার ক্ষোভ অযৌক্তিক কিছুই নয়। কারণ বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী জানবেন না তার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ৮০০ কোটি টাকা হ্যাকাররা নিয়ে গেছে, তাতো হতে পারে না। ঘটনার একমাস পর তিনি সংবাদপত্র থেকে জানবেন-এটা তার জন্য অপমানই বটে। সেই অপমান থেকেই তিনি বলেছিলেন, অর্থ লোপাটের বিষয়টি চেপে গিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যেভাবে তা সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেছে সেটা অযোগ্যতা। তাদের এই ‘স্পর্ধার’ জন্য ‘অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে’।মূলত এরপরই গভর্নর পদত্যাগ করেন। এরপরপরই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দুই ডেপুটি গভর্নর নাজনীন সুলতানা ও আবুল কাশেমকেও অব্যাহতি দেওয়ার কথা জানান অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। একই সঙ্গে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব এম আসলাম আলমকে পরিবর্তনের কথাও জানান তিনি। যিনি পদাধিকার বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য ছিলেন। এ ছাড়া ব্যাংকের দুজন নির্বাহী পরিচালক (ইডি) ও দুজন মহাব্যবস্থাপককে (জিএম) অব্যাহতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। রিজার্ভ থেকে হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে দুই জন নতুন সদস্য নিয়োগ দিয়েছে সরকার। তারা হলেন, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক ড. জামালউদ্দিন আহমেদ ও বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক রুশিদান ইসলাম রহমান। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ইতিহাসে এক দিনে এত ব্যাপক রদবদল নজিরবিহীন। অবশ্য রিজার্ভ থেকে টাকা গায়েবের ঘটনাও নজিরবিহীন। তবে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে এরচেয়ে বেশি টাকা লোপাটের উদাহরণ রয়েছে। প্রথম প্রশ্ন হলো, গভর্নর পদত্যাগ করেছেন কেন? বাংলাদেশের জনগণের টাকা পাহারা দেয়ার দায়িত্ব ছিল গভর্নরের, তিনি সেই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছেন বলে, নাকি রিজার্ভ থেকে টাকা গায়েব হয়ে যাওয়ার ঘটনা অর্থমন্ত্রীকে না জানানোর অপরাধে? টাকা গায়েব হওয়ার ঘটনা গভর্নর অর্থমন্ত্রীকে না জানিয়ে অপরাধ করেছেন বলে তাকে সরিয়ে দেয়া যেতেই পারে। কিন্তু দেশের জনগণের টাকা পাহারা দেয়ার আসল দায়িত্ব ছিল কার? বাংলাদেশের মানুষের অর্থ রক্ষণাবেক্ষণের মূল দায়িত্বতো অর্থ মন্ত্রণালয়ের। সেই মন্ত্রণালয় কি তার দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে? এর আগে ব্যাংকিং সেক্টরে একের পর এক দুর্নীতির ঘটনা ঘটেছে। সোনালী ব্যাংক, রূপসী বাংলা ব্রাঞ্চ, বেসিক ব্যাংকসহ আরো অনেক ব্যাংক গ্রাহকদের আমানতের অর্থ যাকে খুশি তাকে দিয়ে লোপাট করা হয়েছে। হলমার্ক গ্রুপ সোনালী ব্যাংকসহ ২৭টি ব্যাংক থেকে হাতিয়ে নিয়েছে ৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। বিসমিল্লাহ গ্রুপ ৪টি ব্যাংক থেকে নিয়েছে ১২০০ কোটি টাকা। বেসিক ব্যাংক থেকে নেয়া হয়েছে সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা। ডেসটিনি গ্রাহকদের কাছ থেকে আত্মসাৎ করেছে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা। সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী নিজেও স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন সোনালী ব্যাংকে বড় ধরনের ডাকাতি ও জালিয়াতি হয়েছে আর বেসিক ব্যাংকে লুট করা হয়েছে। এতগুলো লুটপাটের ঘটনায় রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে কারো বিরুদ্ধেই তেমন ব্যবস্থা নেয়া যায়নি। এর দায় কি অর্থমন্ত্রী এড়াতে পারেন? আজ দেশের টাকা হ্যাকাররা হাতিয়ে নিয়েছে বলে এবং অর্থমন্ত্রীকে তা জানানো হয়নি বলে তিনি এত গোস্বা করেছেন। নজিরবিহীনভাবে রদবদল ঘটিয়েছেন। এর আগে হাজার হাজার কোটি টাকা যে লোপাট হয়ে গেল তখন তিনি কী ব্যবস্থা নিয়েছেন? একজনকেও কি বদলি করতে পেরেছেন বা চেয়েছেন? আমি নিশ্চিত বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের টাকা যদি হ্যাকাররা না নিয়ে বাংলাদেশেরই কোনো প্রভাবশালী গোষ্ঠি হাতিয়ে নিত তাহলে এত প্রতিক্রিয়া হতো না। আর অর্থমন্ত্রীও এতো ক্ষ্যাপাটে হতেন না। দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো, রিজার্ভের টাকা গায়েবের একমাস পর অর্থমন্ত্রীকে বিষয়টা জানতে হলো কেন? গভর্নরতো বলেছেন, ঘটনাটি জানার পরই বাংলাদেশ সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে রিপোর্ট করা হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গেও এ নিয়ে বৈঠক হয়। আতিউর রহমান আরো জানিয়েছেন, গোটা ব্যাপারটা কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এনে তিনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অনানুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছেন, পরে চিঠি লিখে অর্থমন্ত্রীকেও জানিয়েছেন। তিনি অর্থ সচিবকেও জানিয়েছেন। তবে স্বীকার করেছেন সাইবার অ্যাটাকের পর তা বোঝার জন্য কিছুটা সময় নিয়েছিলেন তিনি, তাই অর্থ মন্ত্রণালয়কে দেরিতে জানানো হয়েছে। যদিও এটা কোনো গ্রহণযোগ্য যুক্তি নয়। আতিউর রহমান আরো জানিয়েছেন, প্রথম দিনই তিনি ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটে এফআইআর করেছেন, তাদের পরামর্শমতো কাজ শুরু করেছেন, বিশেষজ্ঞ মতামত নিয়েছেন, ফিলিপিন্সের গভর্নরের সঙ্গে টেলিফোনে আলাপ করেছেন। যখন পরিস্থিতি খানিকটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে তখন তিনি এনএসআইকে যুক্ত করেছেন র্যাবকে যুক্ত করেছেন, ফায়ারআইকে তো আগেই যুক্ত করেছেন। গভর্নর বলেছেন, যেহেতু ইন্টেলিজেন্সের বিষয়- এগুলো গোপনীয়তার সাথে করতে হয়। প্রশ্নের জবাবটা এখানেই। দুনিয়ার সব মানুষকে গভর্নর জানাতে পেরেছেন, পারেননি শুধু অর্থমন্ত্রীকে জানাতে! কারণটা কী হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। তিনি ধরেই নিয়েছিলেন, বিষয়টা জানালে অর্থমন্ত্রী রাবিশ বলে তা যেখানে সেখানে প্রকাশ করে দিতে পারেন। মোদ্দাকথা অর্থমন্ত্রীর ওপর আস্থা রাখতে পারছিলেন না গভর্নর। আমিও খোঁজ নিয়ে জেনেছি প্রধানমন্ত্রী আর ব্যাংকিং বিভাগের সচিবকে বাংলাদেশ ব্যাংক বিষয়টি জানিয়েছিল। তার মানে এটা ঠিক যে ইচ্ছা করেই অর্থমন্ত্রীকে বিষয়টি জানানো হয়নি। তৃতীয় প্রশ্ন হলো প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি জানার পরেও অর্থমনন্ত্রীকে তা না জানানোর বিষয়টি তিনি অনুমোদন করেছিলেন কিনা? ঘটনার পরম্পরায় মনে হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীও গভর্নরের কথায় ভরসা রেখে অর্থমন্ত্রীকে এড়িয়ে যাওয়ার বিষয়টি এক রকম অনুমোদন দিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রীকে বোঝানো হয়েছিল বেহাত হয়ে যাওয়া অর্থ উদ্ধার করেই বিষয়টি জানানো হবে। এক্ষেত্রে বাধ সেধেছে ফিলিপাইনের গণমাধ্যম আর অর্থ উদ্ধারে অনিশ্চয়তা। সর্বোপরি অর্থমন্ত্রীকে আসলে অবজ্ঞাই করা হয়েছে। সবশেষ প্রশ্ন হলো বাংলাদেশ ব্যাংক, ব্যাংকিং বিভাগ, প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর সবাই যেখানে অর্থমনন্ত্রীকে অবজ্ঞা করলো, তার আওতাধীন দেশের এতো বড় একটা ঘটনা তাকে অন্ধকারে রাখা হলো এরপরেও কী তিনি অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকবেন? বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাটের কথা না-ই বা বললাম। এইচআর/পিআর
Advertisement