বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) পশুপালন অনুষদের চার শিক্ষার্থী আরমান, মেহেদী, সাদিক ও বাধন। ভ্রমণ তাদের নেশা। বারবার তারা বেরিয়ে পরে সাইকেল নিয়ে বহু দূরের গন্তব্যে। ঘুরতে যেন তারা সীমাহীন আনন্দ পায়।
Advertisement
হঠাৎ চায়ের দোকানে বসে চায়ের কাপে চুমুক দিতে গিয়ে তারা ঠিক করে এবার ক্রস কান্ট্রি ভ্রমণে যাবে। তাদের ক্রস কান্ট্রি চ্যালেঞ্জের গল্পটি তুলে ধরছেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও ক্যাম্পাস সাংবাদিক রায়হান আবিদ।
আরও পড়ুন: অবিশ্বাস্য ‘লাল নদী’ দেখলেই জুড়াবে চোখ
প্রথম দিন: ময়মনসিংহের গোবড়াকুড়া বর্ডার থেকে রমাঞ্চকর শুরুটা
Advertisement
তাদের যাত্রা শুরু হয় ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটের গোবড়াকুড়া বর্ডার থেকে। ময়মনসিংহ শহর থেকে ৫৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত বাংলাদেশ-ভারতের বর্ডারটি। রাত ৯টায় বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তারা হালুয়াঘাটের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। হালুয়াঘাট বাজারে পৌঁছায় রাত দেড়টায়।
সেখানে পৌঁছে রাতে খাবার খেয়ে বর্ডারের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। কারণ গোবড়াকুড়া বর্ডার থেকে তাদের ক্রস কান্ট্রি চ্যালেঞ্জ শুরু হবে। সেখানে এক ভয়ংকর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয় তারা।
আহনাফ সাদিক সেদিনের ঘটনা বর্ণনাতে বলেন, ‘বাংলাদেশ সীমানায় বিজিবি না থাকায় অজান্তেই আমরা সাইকেল নিয়ে বাংলাদেশ সীমানা ক্রস করে ইন্ডিয়া সীমান্তের কাছে ‘নো মেন্স ল্যান্ডে’ বা বাংলাদেশ-ভারতের মাঝে অনধিকৃত জায়গার মধ্য দিয়ে যাওয়া সড়কে গিয়ে অবস্থান করি।’
আরও পড়ুন: মাউন্ট এভারেস্টে আরোহণের খরচ কত? রইলো অবাক করা সব তথ্য
Advertisement
তখন প্রায় রাত ৩টা। সেখানে পরিবেশ খুব গোছানো, সড়কের দুই পাশে বাতি দেওয়া, তবে একদম থমথমে। এতটাই থমথমে যে কোনো কারণ ছাড়াই ভয় লাগতে শুরু হয়। হঠাৎ বিএসএফ এর সাইরেন বাজতে শুরু করলো। তখন আমরা বুঝতে পারলাম হয়তো ভুল সড়ক দিয়ে যাচ্ছি। হয়তো আমাদের সতর্ক করতেই এই সাইরেন বাজানো হয়েছিল।
সাইরেনের আওয়াজ শুনে সে সময় বুকের ভেতরটা কেমন ধুকধুক করছিল। সত্যিই আমাদের খুব ভয় লাগছিল। আমরা সর্বোচ্চ গতিতে সাইকেল চালিয়ে আগের ১০০-১৫০ মিটার যাওয়ার পরে বাংলাদেশ জিরো পয়েন্ট লেখাটা দেখতে পাই। সেখান থেকে ময়মনসিংহ শহরে আসতে সকাল ৮টা বাজলো। ময়মনসিংহে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে দুপুরে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হই।
ঢাকা ময়মনসিংহ মহাসড়কে সবচেয়ে বেশি ভুগিয়েছে রং সাইডে বিপরীত দিক থেকে আসা অটো, সিএনজি, মটর-সাইকেল। ময়মনসিংহ থেকে ত্রিশাল, ভালুকা হয়ে ঢাকা যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা করলেও গাজীপুর পর্যন্ত যেতেই রাত ১টা বাজলো। ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানের সামনে ছবি উঠানোর জন্য দাড়াই।
আরও পড়ুন: ভারত গিয়ে ঘুরে আসুন ছোট্ট ‘বাংলাদেশে’
সেখানে কয়েকজন পুলিশের (এসআই,কনস্টেবল) সঙ্গে কিছুক্ষণের আড্ডায় মেতে উঠি আমরা। তাদের কাছ থেকে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে ছিনতাই, বেপরোয়া গাড়ি চালানোর কথা শুনে সবারই ভয় লাগছিল। তারপর সিদ্ধান্ত নিলাম গাজীপুরে রাতে থাকবো।
তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে মেহেদীর বন্ধু শান্তর সঙ্গে যোগাযোগ করে গাজীপুরে অবস্থান করলাম। তবে না বললেই নয় যে, শান্তর আতিখি আপ্যায়ন আমারা বেশ মুগ্ধ।
দ্বিতীয় দিন: দূর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা ও পুলিশের দৌড়ানি
পরের দিন তারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সকাল ১১টায় আমরা মাওয়া ঘাটের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। ঢাকা যাওয়ার পথে বড় একটি দূর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা পায়। সেদিনের ঘটনা স্মরণ করে আরমান হাবিব বলেন, আমরা সাইকেলে করে মাওয়া ঘাটের উদ্দেশ্যে রওনা দেই। সেদিন বড় একটা দূর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা পায় মেহেদী।
আরও পড়ুন: বিশ্বের যে স্থানে সেলফি তুলতে গিয়ে মারা গেছেন অনেকেই
সম্রাট নামে ঢাকার এক লোকাল বাস মেহেদীর সাইকেলে পাশ থেকে ধাক্কা দেয়। ভাগ্যিস যাত্রায় বড় কোনো দূর্ঘটনা ঘটেনি। পেছন থেকে পুরো ঘটনা আমি দেখছিলাম। এই ঘটনায় মেহেদী আর আমি দু’জনই বেশ ভয় পাই। আমরা সামনে গিয়ে কিছুক্ষণ বসলাম। সেখানে অবস্থানরত পুলিশ সদস্যরা আমাদের কাছে আসলেন।
আমাদের পরিচয় ও সাইকেল ভ্রমণ সম্পর্কে বিস্তারিত শুনে তারা কিছুটা অবাক হলেন। পাশাপাশি জানালেন যে তিনিও একজন এথলেট। খুব আন্তরিকতার সঙ্গে আমাদের চা-নাশতা করালেন। ৪০ মিনিট তার সঙ্গে চললো আড্ডা। তিনি আয়রনম্যান (রানিং+ সাইক্লিং+ সুইমিং প্রতিযোগিতা) প্রতিযোগিতা সম্পর্কে আমাদের জানালেন।
ঢাকা থেকে বের হতে রাত ১০টা বাজলো। ঢাকা-মাওয়া ৮ লেনের হাইওয়ে আমার দেখা বাংলাদেশের সেরা হাইওয়ে। কেরানিগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে ছবি তোলার জন্য আমরা ট্রাইপড রাখছিলাম। এমন সময় একজন পুলিশ আমাদের ছবি তুলতে মানা করলেন।
আরও পড়ুন: সঙ্গীকে নিয়ে দুবাই ভ্রমণে যে ভুল করলে হতে পারে জেল
আমরা ট্রাইপড গুছিয়ে সেলফি তুলছিলাম। এতে ওই পুলিশ ক্ষেপে গিয়ে লাঠি নিয়ে দৌড়ে আসলেন। এসে ধমকিয়ে ছবি ডিলেট করতে বললেন তিনি। পরে ছবি ডিলেট করলাম।
এরপর মাওয়া ঘাটে পৌঁছাতে রাত ৩টা বাজলো। ট্রলার পরেরদিন সকাল ৮টায়। আশপাশে কোনো থাকার হোটেলও পেলাম না। পরে মাওয়া ঘাটের ইলিশ খেয়ে হোটেলেই বসে বসে ঝিমালাম সকাল পর্যন্ত।
তৃতীয় দিন: ট্রলারে করে পদ্মা পার ও ভয়ংকর পরিস্থিতি সম্মুখীন
তৃতীয় দিনের শুরুটা হলো মাওয়া ঘাট থেকে বরিশালের উদ্দেশ্যে রওনা। প্রথমে তারা ট্রলারে করে পদ্মা নদী পার করে। গুগল ম্যাপ দেখে হাটার সড়ক ধরে সাইকেলে যাচ্ছিলো তারা। ঘটলো এক রমাঞ্চকর ঘটনা। সড়কটি তাদের সরিষা ক্ষেতে নিয়ে গেলো। তাদের সামনে দেখতে পেল কয়েকটি বাড়ি।
আরও পড়ুন: প্রিয়জনকে নিয়ে থাইল্যান্ড ভ্রমণে ঘুরে দেখবেন যেসব স্পট
বাড়ির উঠানের সড়কটি ধরে হাইওয়েতে উঠে গেল তারা। যাত্রার তৃতীয় দিনের বর্ণনায় মেহেদী হাসান বলেন, চলে এলাম শরীয়তপুর হয়ে মাদারীপুর। এই জেলার কালকিনি উপজেলায় সাইকেল চালাচ্ছিলাম। আমাদের দেখে কয়েকজন আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন কোথা থেকে এসেছি।
সাইকেলে ভ্রমণের বর্ণনা শুনে খুব আন্তরিকতার সঙ্গে চা-নাশতার অনুরোধ করলেন। চা-নাশতা শেষে গৌরনদীর উদ্দেশ্যে রওনা করলাম। কালকিনি থেকে আমরা ঢাকা বরিশাল হাইওয়েতে উঠলাম। এই সম্পূর্ণ যাত্রার এটাই ছিল আমাদের সবচেয়ে ভয়ংকর পরিস্থিতি।
এক লেনের ঢাকা-বরিশাল হাইওয়েতে ৮০-১০০ কিলোমিটার বেগে চলা বাস, ওভারটেকিং, অন্ধকার রাত, আঁকাবাঁকা হাইওয়ে। প্রতিটি মূহুর্তে ভয়ানক পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছিলাম। ৮০ কিলোমিটার বেগে বাস যখন ওভারটেকিং করছিল মনে হচ্ছিল যেন গা ঘেঁষে যাচ্ছে।
আরও পড়ুন: পাহাড়জুড়ে বিশাল রেস্টুরেন্ট, একসঙ্গে খেতে পারেন ৫৮০০ জন
এমনও হয়েছে সামনে থেকে বাস ওভারটেকিং করতে গিয়ে আমাদের মুখোমুখি, উপায় না পেয়ে সড়ক থেকে নিচে সাইকেল নামিয়ে দিতে হচ্ছিলো। কালকিনি থেকে বরিশাল, প্রায় ৪৫ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে ধানসিঁড়ি হোটেলে ঢুকি। পথটা দুঃস্বপ্নের মতো লাগছিল।
সেখানে হোটেল মালিকের চরম বাজে ব্যবহার আমাদের জন্য খুবই অপমানজনক ছিল। বরিশালে পৌঁছানোর পর একটি চমক অপেক্ষা করছিল আমাদের জন্য। বাধনের এক বন্ধু আমাদেরকে ডেকে পাঠায় নিজ বাড়িতে। সেখানে গিয়ে বাড়ির খাবার যেন অমৃতের মত লাগছিল।
চতুর্থ দিন: পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্যে রওনা
চতুর্থ দিনের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে বাধন বলেন, ‘তিন দিনের যাত্রার ক্লান্তি, পা ব্যাথা ও শরীর ব্যাথার কারণে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম চতুর্থ দিন সাইকেল কম রাইড করবো। সেদিন দুপুরের খাওয়া শেষে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্যে রওনা হই।’
আরও পড়ুন: সিলেট গিয়ে দেখে আসুন এশিয়ার সবচেয়ে স্বচ্ছ নদী
‘আমরা জানতাম না বিশ্ববিদ্যালয়ে কার কাছে থাকবো তবে বিশ্বাস ছিল, একটি ব্যবস্থা হয়ে যাবে। অবশেষে মেহেদীর বন্ধু তন্ময়ের সহযোগিতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু হলের রকি, রিফাতের রুমে আমি আর সাদিক থাকলাম আর ২য় তলায় আরমান আর মেহেদী থাকলো।
পঞ্চম ও শেষ দিন: গন্তব্যস্থলে পৌঁছানো ও এক নতুন অভিজ্ঞতার গল্প
পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুদের থেকে সকাল ৬টার দিকে কুয়াকাটার উদ্দেশ্যে রওনা দেয় তারা। যেহেতু আগেরদিন খুব বেশি সাইকেল চালায়নি তাই পঞ্চম দিনে গন্তব্যের বাকি থাকা ৮৫-৯০কিলোমিটার শেষ করার উদ্দেশ্যে বের হয় তারা।
পথে খেজুরের রস খাওয়ার জন্য যে বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল তা ভোলার নয়। শেষ ৫০ কিলোমিটার বাতাস তাদের বিপরীতে আসছিল। সারাদিন সাইকেল চালিয়ে তারা রাত ৯টার দিকে কুয়াকাটা জিরো পয়েন্টে পৌঁছায় তারা।
আরও পড়ুন: ভূমধ্যসাগরের তলদেশে ৭০০০ বছরের পুরোনো রাস্তার সন্ধান
গন্তব্যে পৌঁছানোর পরবর্তী অভিজ্ঞতা নিয়ে আহনাফ সাদিক বলেন, ‘আমাদের ক্রস কান্ট্রি ভ্রমণ শেষ হলো। স্ট্রাভা অ্যাপের হিসাব অনুযায়ী ৬শ ১০ কি.মি যাত্রা আমরা সাইকেলে করেছি।’
‘৬১০ কিলোমিটার সাইকেল চালানোটা সত্যিই খুব চ্যালেঞ্জিং ছিলো। ভিন্ন ভিন্ন মানুষের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি। কখনো ছিল ভীতিকর আবার ছিল আনন্দঘন। আশা করি পরের বার আমরা সাইকেলে করে দেশের বাইরে যাবো।’
লেখক: শিক্ষাথী, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ
জেএমএস/জিকেএস