আহাম্মক অহমের গল্প: উপন্যাসের নতুন অভিজ্ঞান

সালাহ উদ্দিন শুভ্র

রাশান লেখক লিও তলস্তয়ের ‘রেজারেকশন’ উপন্যাসটি পড়েছিলাম অনেক আগে। সম্প্রতি একটি বাংলাদেশি উপন্যাস পড়তে গিয়ে মনে পড়ল তার কথা। অন্তর্দহন বা অনুশোচনায় জর্জরিত মানবসত্তাকে উপজীব্য করে লেখা উপন্যাস রেজারেকশন। মানুষের ভেতর বাহির, অর্থাৎ তার মনোজগতে সু এবং কু-এর ডাকের সঙ্গে সমাজ-পরিবার ইত্যাদির বোঝাপড়া রাশিয়ার উপন্যাসে বেশ দেখতে পাওয়া যায়।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই মনোজগৎ বা মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস খুব একটা লেখা হয় না। কেউ কেউ আছেন মনোবিদ, তারা নানা মানসিক সংকটকে কেন্দ্র করে উপন্যাসের কাহিনি লেখেন। তবে তারা লেখেন কোনো নির্দিষ্ট চরিত্র বা ঘটনা নিয়ে। একটা সমাধানও পাওয়া যায় সেসব উপন্যাসে। কিন্তু সমাধান নেই কোনো, চরিত্রও সুনির্দিষ্ট নয় বরং একটা সর্বজনীন অবস্থা নিয়ে উপন্যাস পড়ার অভিজ্ঞতা ভিন্ন হওয়ার কথা। আমার সেই অভিজ্ঞতা হলো ‘আহাম্মক অহমের গল্প’ পড়তে গিয়ে। এ উপন্যাসের লেখক মোহাম্মদ আলী।

বই বের হওয়ার আগে উপন্যাস পড়ে ফেলার অনুভূতিও দারুণ। সেই সুযোগ আমাকে যারা করে দিয়েছেন, তাদের একটা ধন্যবাদ দিতেই হয়। ধন্যবাদ না দিয়েও পারা যায় না, কারণ উপন্যাসটি সুখপাঠ্য এবং ভাবনা উদ্রেককারী। এ উপন্যাসে কাহিনি আছে। কী হয় কী হয় এরপর-এমন একটা টান টান ভাবও আছে। ঝরঝরে গদ্য, উপভোগ্য সংলাপ মিলিয়ে পড়ার অভিজ্ঞতা দারুণ।

এখনকার জনপ্রিয় উপন্যাসগুলো সাধারণত প্যাঁচপ্যাঁচে আবেগ, ব্যক্তিগত প্রেম অথবা সম্পর্কের টানাপোড়েন নিয়ে লেখা। পাঠক যে কেন এ ধরনের লেখা পছন্দ করেন, তা নিয়ে গবেষণা চলতে পারে। তবে এসব উপন্যাসের অন্য যে গুণ, যেমন গদ্য-সেগুলোও বেশ আড়ষ্ট থাকে দেখেছি। ‘আহাম্মক অহমের গল্প’ মোটেও তেমন নয়। বরং এটি আরও ভিন্ন। উপন্যাস লেখার যে অভ্যস্ততা তা থেকে ভিন্ন। এই উপন্যাসের ‘ফর্ম’ আলাদা। লেখক শুরু থেকেই পাঠকের সঙ্গে বোঝাপড়ায় নেমে যান। কাহিনি বলার মাঝে মাঝেই তিনি এসে হাজির হন। এতে পাঠের মজা নষ্ট হয় না, বরং লেখক নিজেই চরিত্র হয়ে ওঠেন।

আরও পড়ুন: রাহেল রাজিবের প্রেমের কবিতা: বাস্তবতার অভিজ্ঞান

যে কোনো বই নিয়ে আলোচনা করতে গেলে পাঠকের আগ্রহ জাগে কাহিনি নিয়ে। তবে আমি তাদের সেই আগ্রহ এখানে মেটাতে চাই না। শুধু এটুকু বলব, একজন সৎ উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তার একটি পরকীয়া সম্পর্ক এখানে আছে। যৌনতা, মাদক, আমাদের সরকারি অফিস বা প্রজেক্ট কীভাবে চলে, ঘুষ লেনদেন কীভাবে হয়, বর্তমান সময়ের ভার্চুয়াল প্রেম-এসবও আছে।

যারা পড়বেন; তারা এক বসায় যদি শেষ না করতে পারেন, তাহলে উপন্যাসটি ‘ভার্চুয়ালি’ তার সঙ্গে সঙ্গে ঘুরতে-ফিরতে থাকবে।

যেমন কেউ যদি প্রেমে পড়েন, তাহলে কী হয়? প্রেমের অনুভূতি প্রিয় মানুষটি সঙ্গে না থাকলেও ঘুর ঘুর করে। এ উপন্যাসও ঘুর ঘুর করবে। আর যদি সেই প্রেম হয় গোপন, সমাজ মেনে নেবে না এমন, পরিবারে জানানো যায় না কিছুতে-তখন? তখন এক দুই ধারি তলোয়ারের মতো দুদিক থেকে কাটতে থাকে সে প্রেম। একদিকে সুখ, অপরদিকে ঘৃণা। কথা হলো এই সুখ না ঘৃণা-কে জয়ী হয় মানুষের জীবনে? কেউ আসলে স্থায়ীভাবে জয়ী হয় না।

লেখকের ভাষায় পরিস্থিতিটা এমন, ‘যাদের তাস খেলার অভিজ্ঞতা আছে, শুধু অভিজ্ঞতা নয়, যারা তাস খেলার কারণে বাসায় ফিরে বকা খেয়েছে, তারা জানে, খেলার কি নেশা। যারা তাস খেলে বকা খায়নি বা অনুতাপে ভোগেনি তাদের তাস খেলার নেশাও হয়নি কখনো। নেশা জিনিসটাই এই। একদিকে ভোগ বা মজা আর অন্যদিকে অনুতাপ বা শান্তি। এই বিপরীত দুই মেরু যেখানে আছে সেখানে নেশা হবেই। নিরীহ কাগজের তৈরি তাসও যে নেশার বস্তু হয়ে ওঠে তা এই ভোগ আর অনুতাপের সংঘর্ষের কারণে। একই কারণে নেশার বস্তু হয়ে ওঠে সিগারেট, গাঁজা, মদ, জুয়া, সমেহন, যৌনতা প্রভৃতি।’

এ ভোগ আর অনুতাপ ভার্চুয়াল রিয়্যালিটিতে আরও প্রবল। যা কিছু কিছু ঘটনায় পাঠকের কাছে আরও স্পষ্ট হবে। অর্থাৎ ভার্চুয়াল দুনিয়ায় কেউ সেক্স করে ফেলছে, ভাবছে তারা তো আর সত্যি সত্যি করছে না কাজটা, সমাজ-সংসার ঠিকই থেকে যাচ্ছে। আসলে কী তাই? এভাবে করতে করতে তা যখন অভ্যাস বা নেশায় পরিণত হয় তখন? এ প্রশ্ন থাকুক পাঠকের জন্য। আরেকটা প্রশ্ন করা যাক। কেন এমন পরিস্থিতি হয়?

আরও পড়ুন: পার্কবেঞ্চের কবিতা: মরণ ও প্রেমের সিংহাসন

লেখক বলছেন, ‘মেহেকের দোষ নেই এই সমাজ যদি অবদমিত না হত, তাহলে এইরকম প্রেমের হয়ত জন্মই হত না। হলেও সহজেই সোহেল মেহেককে বিয়ে করে ফেলত। মেহেক জানে যে সোহেল কোনদিনই তাকে বিয়ে করবে না। কাজেই তার নিজের শরীরের প্রয়োজনে টুটুলকে সাথে রাখতে হয়েছে। এটা মেহেকের দোষ নয়। দোষ হল এই অবদমিত সমাজের।’ এই মেহেক বা সোহেল এবং তাদের প্রেম ও টুটুলের পরিচয় পাঠক উপন্যাসটি পড়ে জেনে নেবেন। তবে আমি শুরুর আলোচনা দিয়ে শেষ করব ‘আহাম্মক অহমের গল্প’ নিয়ে আমার বোঝাপড়া।

মানুষের যে ইগো বা অহম, তা কত ধরনের হয়? সিগমুন্ড ফ্রয়েডকে মোহাম্মদ আলী কতটা পছন্দ করেন, তা আমি জানি না। তবে তিনি ফ্রয়েডের মতো ইগো নিয়ে ডিল করেছেন। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় এ ইগো বা অহম খুব সমস্যাজনক। অনেক সামাজিক ও ব্যক্তিগত সংকটের মূলে এ অহম। এ উপন্যাসের নামের সঙ্গে মিলিয়ে অহমই মূল চরিত্র। ভালো অহম, খারাপ অহম, সামাজিক-পারিবারিক এমন কয়েক ধরনের অহমের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে না পেরে দিশাহীন হয়ে পড়া একাধিক চরিত্র নিয়ে লেখা উপন্যাস ‘আহাম্মক অহমের গল্প’।

মানুষের ভেতরে আরও নানা সত্তার উপস্থিতি আর তাদেরই চরিত্র হিসেবে হাজির করা অর্থাৎ মানুষ নয়, অস্তিত্বহীন হয়ে থাকা মন কিংবা ভাবনা-চেতনাকে চরিত্র করে তোলার ঘটনা বাংলাদেশের সাহিত্যে পাইনি আগে। শেষ পর্যন্ত নিজের ইস্যুতে ঠিক থেকে কাহিনি গড়ে তোলার দক্ষতাও এ লেখকের আছে। আহাম্মক অহমের গল্প উপন্যাসটি পাওয়া যাচ্ছে অমর একুশে বইমেলায় দাঁড়িকমা প্রকাশনীর ৪৮৮ নম্বর স্টলে।

এসইউ/জেআইএম