ফিচার

ঘণ্টায় ৫৬ কিলোমিটার উড়তে পারে যে মাছ

মাছ। এই জলজ প্রাণীটি আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে জড়িয়ে আছে। পৃথিবীর যে কোনো পানিতে মাছের প্রজাতি প্রায় দু’হাজারেরও অধিক। তাই বলা যায় যেখানেই পানি, সেখানেই মাছ। আর কে না জানে, পৃথিবীর চার ভাগের তিন ভাগই তো পানির তলায়। নানান মাছের আকার ও গঠন অত্যন্ত বৈচিত্র্যময়। কারণ এদের বিভিন্ন পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে বেঁচে থাকতে হয়। একটি পূর্ণবয়স্ক ফিলিপাইন গোবি (এক প্রজাতির মাছ) এক ইঞ্চি বা তার থেকেও ছোট হয়। আবার একটি প্রাপ্তবয়স্ক হাঙর (এক প্রজাতির মাছ) লম্বায় চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ ফুট আবার কোনো কোনো সময় সত্তর ফুটও হয়ে থাকে। এদের আকার-আকৃতি, আচার-আচরণ আরও বৈচিত্র্যময়। লম্বা ইল মাছকে দেখতে মনে হয় জ্যান্ত সাপ। শঙ্কর মাছের শরীর চ্যাপটা। সাগরের সানফিশের শরীরের দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ সমান। পটকা মাছ দেখতে বলের মতো। ওদিকে অ্যান্ডুলা মাছের চোখ থাকে তাদের মাথার উপরে। শোল মাছের আবার দু’টো চোখই থাকে মাথার একদিকে। এমনকি সুদর্শন সি হর্সকে প্রথম দেখায় তো মাছ বলে মনেই হয় না। মনে হবে ঘোড়া।

Advertisement

আরও পড়ুন: খুনি শামুকের কামড়ে মরতে পারে মানুষও

আমাদের জানা মতে, আকাশে উড়ে বেড়ায় যে, তার নাম খেচর। অর্থাৎ সাধারণত খেচর প্রাণীরাই আকাশে উড়ে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, সাগরে এক ধরনের আজব মাছ আছে, যারা অনায়াসে শুণ্যে ভেসে বেড়াতে পারে। এরা হলো উড়ন্ত মাছ। এদের পাখনা দু’টো বেশ বড়। দশ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হতে দেখা যায় পাখনা। পাখনার সাহায্যেই এ মাছ উড়ে বেড়ায়। লাফ দিয়ে পানি ছেড়ে আকাশে উঠে আসার সময় পাখনা দু’টো দু’পাশে মেলে ধরে। সাধারণত পানির ভেতর সাঁতরানোর সময় উড়ন্ত মাছের রং সবুজ দেখায়। আসলে এদের পাখনার রং হালকা বেগুনি। অথচ কি আশ্চর্য! আকাশে উড়ার সময় পাখনার রং কখনো দেখায় কালচে নীল। আবার কখনো দেখা যায় সোনালি হলুদ। এই উড়ন্ত মাছের ইংরেজি নাম ফ্লাইং ফিশ। পানিতে চলাফেরার চেয়ে শুণ্যে উড়তেই এরা বেশি পছন্দ করে। আকাশে উড়ার গতিবেগও এদের আশ্চর্য রকম। ঘণ্টায় এরা ৫৬ কিলোমিটার পর্যন্ত পথ পাড়ি দিতে পারে।

উড়ন্ত মাছ ডিম পাড়ার সময় হলে তীরের নিকটবর্তী এলাকায় চলে আসে। পানি ছেড়ে শুণ্যে উঠে প্রায় দশ সেকেন্ড ভেসে থেকে তীরের কাছাকাছি গাছপালায় ডিম পাড়ে। অন্য মাছের ডিম থেকে উড়ন্ত মাছের ডিম আলাদা ধরনের। এক প্রকার আঁকশি লাগানো থাকে ওদের ডিমে। জ্যান্ত উড়ন্ত মাছ বা ফ্লাইং ফিস অহরহ দেখা যায় আন্দামানের পোর্ট ব্লেয়ার যাওয়ার পথে। জাহাজের সামনের দিকের ডেকের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে নিচে সমুদ্রের পানির দিকে তাকিয়ে থাকলে দেখা যাবে, জাহাজের গা ঘেঁষে ছোট-ছোট পাখির মতো এক বা একাধিক মাছের ঝাঁক পানি থেকে উঠে ডানায় ভর করে অনেক দূর পর্যন্ত উড়ে গিয়ে আবার সাগরের পানিতে ঝুপ করে পড়ছে। এরাই হলো ফ্লাইং ফিস বা উড়ন্ত মাছ। তবে এদের পৃথিবীর সব সাগরেই কমবেশি দেখতে পাওয়া যায়। এমনকি কয়েক প্রজাতির ফ্লাইং ফিস বাণিজ্যিকভাবে পৃথিবীর নানান উপসাগর থেকে ধরা হয়।

Advertisement

আরও পড়ুন: তীক্ষ্ণ চোখের ৯ ফুটের সাগর ঈগল

আমাদের বঙ্গোপসাগর অঞ্চলেই অন্তত: দশ প্রজাতির উড়ন্ত মাছের সন্ধান পাওয়া গেছে। অন্যান্য প্রজাতির উড়ন্ত মাছ আকারে বড় ও গভীর সাগরে থাকে। অনুমান করা হয়, বড় প্রজাতির উড়ন্ত মাছ কন্টিনেন্টাল সেলফ অঞ্চলে ও বাইরের সাগরের উপরিভাগে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে। এছাড়া ভারত মহাসাগরের পূর্ব উপকূলে ও শ্রীলঙ্কায় এদের বেশি দেখতে পাওয়া যায়। আগেই বলা হয়েছে সাগরের উপরিভাগে বসবাসকারী উড়ন্ত মাছ সাগরের পানি থেকে উপরে লাফিয়ে ওঠে। এরা কানকোর পাশে লাগানো লম্বা পাখনার সাহায্যে অনেক দূর পর্যন্ত পানির উপর দিয়ে উড়ে যায় যেতে পারে। যখন এরা পানির মধ্যে সাঁতার কাটে তখন কানকোর পাশে থাকা লম্বা পাখনা, গোটা দেহের সঙ্গে আটকে রাখে। গরম আবহাওয়া পছন্দ করে বলে এরা সাধারণত না শীত না গরম এমন সাগর এলাকায় বসবাস করে।

সাধারণ একটি উড়ন্ত মাছ লম্বায় ১৮-২৪ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। বড় প্রজাতির উড়ন্ত মাছ লম্বায় ২৩-৩৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হয়। উড়ন্ত মাছ পানির উপরে ভাসমান বস্তুর চারদিকে ডিম ছাড়ে। এই ভাসমান বস্তুর মধ্যে আছে মাছ-ধরা জাল, দড়ি, জলজ উদ্ভিদ, ভাসমান কাঠের টুকরো ইত্যাদি। আকার অনুযায়ী প্রতিটি স্ত্রী মাছ পাঁচ হাজার থেকে বার হাজার ডিম দেয় একসঙ্গে। স্ত্রী মাছ ভাসমান বস্তুর চারদিকে আঠালো ফিতার মতো ডিম পাড়ে। পুরুষ-মাছ এই ডিমের উপর তাদের শুক্রাণু ঢেলে দেয়। যার ফলে ডিম নিষিক্ত হয়। নিষিক্ত হওয়ার প্রায় ১০০ ঘণ্টা পরে ডিমের ভেতর থেকে বাচ্চা বেরিয়ে আসে। এই বাচ্চা মাছ সাগরের পানির উপর ভাসতে থাকে। ক’দিন বাদে কিছুটা বড় হয়ে অপরিণত উড়ন্ত মাছের আকার নেয়। প্রায়ই দেখা যায় জেলেরা সাগরের পানি থেকে জাল ও মাছকে আকৃষ্ট করার জন্য পাতা ভাসমান বস্তু তুলে নেয়। এতে জমে-থাকা অনেক ডিম নষ্ট হয়ে যায়। উড়ন্ত মাছের খাবার হচ্ছে ছোট ছোট মাছ। খাবার শিকার করে সাধারণত রাতে। এই মাছ এক থেকে তিন বছর পর্যন্ত বাঁচে।

জেলেদের উড়ন্ত মাছ ধরার পদ্ধতি একেক দেশে একেক রকম। তাও আবার নির্ভর করে মাছের আকার ও প্রজনন সময়ের উপর। পরিচিত ছোট প্রজাতির উড়ন্ত মাছকে সাধারণত প্রজননের সময় ছোট ফাঁসের জাল বা ছাঁকুনি জাল দিয়ে ধরা হয়। এই মাছদের প্রজননে আকৃষ্ট করার জন্য জেলেরা নির্দিষ্ট জায়গায় ভাসমান বস্তু ফেলে রাখে। অনেকে আবার বেশি মাছ আকৃষ্ট করার জন্য মাছের টুকরো ও তেল ভাসমান বস্তুর কাছে পানির উপর ঢেলে দেয়। অপেক্ষাকৃত বড় প্রজাতির উড়ন্ত মাছ প্রজননের সময় ছাড়া অন্য সময়ে বড়শির সাহায্যে বা আলাদাভাবে তৈরি ফাঁসি-জালে ধরা হয়। চার মিটার থেকে পনেরো মিটার নৌকা উড়ন্ত মাছ ধরার কাজে ব্যবহার করা হয়। যেহেতু উড়ন্ত মাছ উপকূল থেকে বেশি দূরে থাকে না, তাই মাছ ধরার নৌকাগুলো খুব সকালে মাছ ধরতে যায় ও মাছ নিয়ে সন্ধ্যার দিকে ফিরে আসে। খরচে পোষায় না বলে মাছ ধরার নৌকাগুলো বরফ নিয়ে যায় না। ফলে নৌকাগুলো যখন মাছ ধরে ফিরে আসে, তখন মাছের অবস্থা বিনা বরফে খুব একটা ভালো থাকে না। তাই অনেক সময় খুব অল্প দামে মাছ বেচতে হয় জেলেদের। কখনো কখনো লবণ দিয়ে শুকিয়ে শুটকি মাছ করা হয় এগুলোকে।

Advertisement

আরও পড়ুন: আকাশে কত তারা?

এই উপমহাদেশে প্রায় বছরে চারশ’ টন উড়ন্ত মাছ ধরা হয়ে থাকে। এদের মধ্যে আকারে ছোট উপক‚লবর্তী অঞ্চলে বসবাসকারী উড়ন্ত মাছ ভারত মহাসাগরের পূর্ব উপকূলে ও শ্রীলঙ্কায় দীর্ঘদিন থেকে ধরা হচ্ছে। জেলেরা এদের আকৃষ্ট করে এক জায়গায় জড়ো করেওছাকনি জাল দিয়ে ধরে ফেলে। এদের মধ্যে দুই প্রজাতির বড় উড়ন্ত মাছ রয়েছে। এগুলো হলো-সাটন উড়ন্ত মাছ ও স্পটেড উড়ন্ত মাছ। এগুলো বঙ্গোপসাগরের পূর্ব উপকূলে ফাঁসি জালে ধরা পড়ে। যদিও বঙ্গোপসাগরে উড়ন্ত মাছের উপস্থিতি খুবই কম। বছরে মাত্র মে থেকে জুলাই এই দু’মাস এদের দেখা মেলে। এসময়টা অবশ্য এই মাছের ডিম ছাড়ার সময়। এসময় মাছগুলো ডিম পাড়তে জড়ো হয় উপকূল অঞ্চলে। ক’দিন পরেই উড়ন্ত মাছ আবার সাগরের ভেতরে চলে যায়।

সুস্বাদু বলে বিভিন্ন দেশের মানুষ উড়ন্ত মাছ খুবই পছন্দ করে। নারকেলের দুধ দিয়ে উড়ন্ত মাছের ঝোল উপকূলবাসীর প্রিয় খাবার। মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ টাটকা উড়ন্ত মাছ খায়। আর গরিব শ্রেণির মানুষ খায় শুকানো উড়ন্ত মাছ। ক্রেতারা যেন এই মাছকে পাখি বলে ভাবতে না পারে সেজন্য উড়ন্ত মাছের কানকোর কাছের পাখনা কেটে বাজারে বিক্রি করা হয়। আন্তর্জাতিক বাজারে উড়ন্ত মাছের ডিমের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। জাপান প্রতিবছর ইন্দোনেশিয়া থেকে উড়ন্ত মাছের ডিম আমদানি করে থাকে।

লেখক: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক। এম.ফিল স্কলার, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

কেএসকে/জেআইএম