পুকুরপাড়ে সবজি ও দেশীয় ফলের আবাদ করে পাবনার ঈশ্বরদীর মাছ চাষিদের ভাগ্য বদলে গেছে। মাছ চাষের ৩৫ থেকে ৪০ ভাগ লভ্যাংশ আসে পুকুরপাড়ে সবজি ও দেশীয় ফল-মূলের আবাদে।
Advertisement
উপজেলার দাশুড়িয়া ও মুলাডুলি ইউনিয়নের প্রায় ৬ শতাধিক পুকুরপাড়ে মাছ চাষিরা পরিকল্পিতভাবে সবজি ও দেশীয় ফলের আবাদ করছেন। দাশুড়িয়া ও মুলাডুলি ইউনিয়নের প্রায় ১০ গ্রামজুড়ে পদ্ম ও চামগড়া বিল। বছরজুড়েই জলাবদ্ধতার কারণে এ বিলের বেশিরভাগ জমিতে একসময় কোনো ফসল ফলতো না। বিলের অল্প জমিতে ফসল হলেও সেগুলো এক ফসলি জমি। তাই মালিকরা এসব জমিতে পুকুর খনন শুরু করেন।
মাত্র ১০ বছরের ব্যবধানে দুই বিলে প্রায় ৬ শতাধিক পুকুর খনন করা হয়। এসব পুকুরের পাড় চওড়া করে তৈরি করা হয়। যাতে পুকুরে মাছ চাষের পাশাপাশি পাড়ে সবজি ও দেশীয় ফলের চাষ করা যায়। ‘ফসলি জমি নষ্ট করে পুকুর খনন করে কৃষকদের ক্ষতিগ্রস্ত করা হচ্ছে’-এ ধারণার আমূল পরিবর্তন ঘটিয়েছেন মাছ চাষিরা। মাছের পাশাপাশি সবজি ও ফল চাষ করে অনেকের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়েছে।
আরও পড়ুন: প্রতি মাসে পুকুরের যেসব যত্ন নেওয়া জরুরি
Advertisement
উপজেলার কৃষি অফিসের প্রচেষ্টায় কয়েক বছর ধরে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে পুকুরপাড়ে সবজি চাষ। ‘সাথী ফসল’ হিসেবে শুরু হলেও এখন মূল ফসলের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে। পুকুরের পাড় ও মাচায় সবজি আর নিচে পানিতে মাছ চাষ হচ্ছে।
এখানে উৎপাদিত সবজি পুরোটাই বিষমুক্ত। ফলে এর চাহিদাও আছে স্থানীয় বাজারে। পুকুরের পাড়ে সবজি চাষ লাভজনক হওয়ায় সব পুকুরপাড়ে চাষাবাদ বাড়ছে। ফলে স্থানীয়দের চাহিদা মিটিয়ে উৎপাদিত সবজি পাশের উপজেলার হাট-বাজারে বিক্রি হচ্ছে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, পুকুরপাড়সহ আবাদযোগ্য কোনো জমি যেন পতিত না থাকে। সেজন্য মাঠপর্যায়ে কৃষি কর্মকর্তারা তৎপর। কৃষি উপ-সহকারী কর্মকর্তারা পুকুরপাড়, বাড়ির আঙিনা, পরিত্যক্ত জমিতে ফসল চাষে উদ্বুদ্ধ করছেন।
আরও পড়ুন: লালশাক চাষে লাভবান কৃষক আবদুর রহমান
Advertisement
উপজেলার দাশুড়িয়া ও মুলাডুলি ইউনিয়নের বিলগুলো ঘুরে দেখা যায়, বিশাল বিলের যতদূর চোখ যায়, সবুজের হাতছানি। পুকুরপাড়ের মাচায় ঝুলছে লাউ, কুমড়া, শসা, ঝিঙা, শিম, বরবটি, পুঁইশাক। পাশাপাশি ঢ্যাঁড়শ, করলা, বেগুনসহ বিভিন্ন সবজি চাষ হচ্ছে। এ ছাড়াও পুকুরপাড়ে দেশীয় কলা ও পেঁপের ব্যাপক ফলন হয়েছে।
দাশুড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য রফিকুল ইসলাম মাঝি জাগো নিউজকে বলেন, ‘মারমী, শ্যামপুর, সুলতানপুর, হাতিগড়াসহ ১০ গ্রামের মধ্যবর্তী পদ্ম ও চামগড়া বিলজুড়ে প্রায় ৬০০ পুকুর। এসব পুকুরে মাছ চাষের পাশাপাশি পুকুরপাড়ে সবজি চাষ করে চাষিদের দিন বদলে গেছে। এখন তারা স্বাবলম্বী।’
মাছ চাষি ও কৃষকরা জানান, পুকুরের পাড়ে বিশেষ পদ্ধতিতে বাঁশ ও প্লাস্টিকের নেট দিয়ে ঝুলন্ত মাচা তৈরি করা হয়। তারপর সবজির আবাদ করে বাড়ন্ত গাছ মাচার ওপর ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এতে জায়গা কম লাগে ও অল্প পরিচর্যায় ভালো ফসল পাওয়া যায়। পুকুরের পাড়ে সমন্বিত সবজি আবাদ করে এখন তাদের মুখে হাসি ফুটেছে।
আরও পড়ুন: ৬০ হাজার টাকার মাছ চাষে কোটিপতি ওসমান
উপজেলার মারমী গ্রামের মাছ চাষি সেলিম হোসেন জানান, তার ৬৮ বিঘার দুটি পুকুর। দুই পুকুরের পাড় বেশ চওড়া। বছরজুড়েই পুকুরপাড়ে লাউ, শিম, ঝিঙা, বরবটিসহ নানা ধরনের সবজির পাশাপাশি কলা ও পেঁপের আবাদ হয়। গত বছর তিনি ৪ লাখ ৫৫ হাজার টাকার কলা, পেঁপে ও সবজি বিক্রি করেছেন। পুকুরের মাছ চাষের প্রায় ৩৫ ভাগ লাভ এসেছে সবজি ও দেশীয় ফলের আবাদে।
মাছ চাষি সবুর খান জানান, চার বিঘার পুকুরে মাছ চাষের পাশাপাশি পাড়ে শিম, বেগুন, পেঁপে ও কলার আবাদ করেছেন। কলা, পেঁপে ও সবজি বিক্রি করে মাছের খাবার কেনার টাকা হয়। ফলে বাড়ি থেকে টাকা এনে মাছ চাষে ব্যয় করতে হয় না। এখানকার পুকুরের মালিকরা পাড়ে সবজি আবাদ করে বেশ লাভবান হয়েছেন।
দুটি পুকুরে মাছ চাষ করেন মারমী গ্রামের সুজন দেওয়ান। তিনি জাগো নিউজকে জানান, মাছ চাষের পাশাপাশি কলা, পেঁপে, বেগুন ও শিমের আবাদ করেছেন। বিষমুক্ত এসব সবজি পরিবারের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি বাজারে বিক্রি করে মাছ চাষে ব্যয় করা যায়। যারা পুকুরে মাছ চাষ করেন; তারা যদি পুকুরপাড় ফেলে না রেখে সবজি ও দেশীয় ফল আবাদ করেন, তাহলে ফল-মূল বিক্রি করে মাছ চাষের খরচ কমে যাবে।
আরও পড়ুন: কুড়িগ্রামে ৫০০ হেক্টর জমিতে আগাম আলুর চাষ
উপজেলা মৎস্য সম্প্রসারণ কর্মকর্তা জাকিয়া সুলতানা জাগো নিউজকে জানান, ২০১৭-১৮ সালের জরিপ অনুযায়ী এ উপজেলায় পুকুর আছে ২৪৭৬টি। বর্তমানে পুকুরের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে নির্দেশনা এসেছে। তাই পুকুরের পাড়ে সবজি ও দেশীয় ফলের চাষাবাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে সুফল পাওয়া গেছে। অনেকেই লাভবান হয়েছেন।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মিতা সরকার জাগো নিউজকে বলেন, ‘আবাদযোগ্য সব জমি চাষাবাদের আওতায় আনতে কৃষি বিভাগ কাজ করে যাচ্ছে। উপজেলার প্রতিটি পুকুরের পাড় যেন চাষাবাদের আওতায় আনা হয়, সেজন্য কৃষি উপ-সহকারী কর্মকর্তারা মাঠপর্যায়ে কাজ করে যাচ্ছেন।’
শেখ মহসীন/এসইউ/জেআইএম