ডা. সেলিনা সুলতানা
Advertisement
বর্তমানে মানসিক বিভিন্ন সমস্যায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। বিশেষ করে করোনা পরবর্তী মানসিক স্বাস্থ্য ভালো না থাকায় আত্মহত্যা, ডিপ্রেশন, দুশ্চিন্তার মতো মানসিক রোগ বা সমস্যা বেড়ে গেছে।
মানসিক স্বাস্থ্য বলতে মানসিকভাবে ব্যক্তির সুস্থতাকে বোঝায়। একজন ব্যক্তি যদি চারপাশের সব স্বাভাবিক ও অস্বাভাবিকতা দেখার পর নিজেকে সুন্দর, সুস্থ ও দেশের সুনাগরিক হিসেবে পরিচিত করাতে পারেন, তখন তাকে একজন সুস্থ মানুষ হিসেবে গণ্য করা হয়।
শিশু বা ব্যক্তি শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকলে পারিবারিক, সামাজিক ও কর্মক্ষেত্রে নিজের সন্তুষ্টির সঙ্গে সঙ্গে সবার সন্তষ্টি অর্জন করতে পারেন।
Advertisement
মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়ন ঘটে মূলত পরিবার থেকেই। কারণ একটি শিশুর প্রথম বিকাশ শুরু হয় পরিবার থেকে। অতি আদর, অবহেলা, অতিশাসন শিশুর স্বাভাবিক বিকাশকে যেমন ব্যহত করে তেমনি পরিমিত আদর, ভালবাসা, শাসন, মর্যাদা ও কাজের স্বীকৃতি শিশুর স্বাভাবিক বিকাশ নিশ্চিত করে। তাই পরিবারগুলোকে সুসংগঠিত হতে হবে আন্তরিকতা সাথে।
শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক আছে কি না তা পারিবারিকভাবে বোঝার লক্ষণ কী কী?
স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি মেজাজি হওয়া, মাঝে মধ্যেই মাথা ও পেট ব্যথার অভিযোগ, ঘুমে ব্যঘাত ও দুঃস্বপ্ন দেখা, স্কুল থেকে দূরে থাকা, সামাজিকতায় লজ্জা পাওয়া, ছোট খাটো বিষয়ে রাগ করা ও ভয় পাওয়া।
কিশোর ও তরুণদের মানসিক অস্থিরতার লক্ষণ হলো আগের অনেক পছন্দের বিষয়ের ওপর থেকে আগ্রহ হারিয়ে ফেলা, বন্ধুদের সঙ্গে মারামারি, খেলাধুলার অতি আগ্রহ বা অনাগ্রহ, ‘গেইমিং’ বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশি আসক্ত হওয়া।
Advertisement
মানসিক অস্থিরতা বাড়লে নিজের ক্ষতি হয় এমন কাজ করা, ধূমপান নেশাজাতীয় দ্রব্যের প্রতি আকর্ষণ ও সবশেষে আত্মহত্যার মতো আবেগ মাখা সিদ্ধান্ত।
কেন শিশুদের মানসিক সমস্যা দেখা দেয়?
শিশুদের মধ্যে মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে বিভিন্ন কারণে। স্কুলে নানা রকমের বাজে ব্যবহার, শিক্ষকদের কাছে বকা খাওয়া, বাবা মায়ের সঙ্গে সন্তানদের আবেগগত দূরত্ব, সন্তানকে অতিরিক্ত শাসন করা বা অতিরিক্ত আদর করা, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ যেমন- বাবা মায়ের ডিভোর্স বা নিয়মিত ঝগড়া হয় এমন পরিবেশে শিশুরা বেড়ে উঠলে। এছাড়া অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস যেমন বাইরের খাবার প্রতি অতিমাত্রায় আকর্ষণে।
শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে করণীয়
শিশুর সুস্থ মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে পারিবারিক, স্কুল ও সামাজিক অবস্থা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। নিজেদের আবেগ, চাওয়া পাওয়া তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। তারা যেমন তাদের সেভাবেই বিকশিত হতে দিতে হবে। শিশুর মাঝে রাগ, ক্ষোভ, হিংসা ইত্যাদি থাকাটা স্বাভাবিক।
অন্যদের সঙ্গে শিশুকে কখনো তুলনা করা যাবে না। ভালোর জন্যই যে সবকিছু করা হচ্ছে এটা বোঝার ক্ষমতা শিশুর নেই। তার মনে হবে যদি সে অন্যদের মতো আচরণ করে তাহলে তার বাবা মা ও তাকে ভালোবাসবে। শিশু মানসিকভাবে ভেঙে পড়লে তার পাশে থাকুন। তার কথা মন দিয়ে শুনুন।
তাকে নিশ্চিত করুন যে আপনি সবসময় তার সঙ্গে আছেন ও থাকবেন। তাদেরকে মাঝে মধ্যে ভুল করতে দিন। সব সময় শিশুকে সংশোধন করতে যাবেন না, তাদেরকে জীবন, সময়, টাকা ও কঠোর পরিশ্রমের গুরুত্ব বুঝতে দিন। তাদের নিজের কাজ ও দায়িত্বের ভার নিজের কাঁধে নিতে শিক্ষা দিন। এভাবেই তার মানসিক স্বাস্থ্যকে ঠিক রাখা সম্ভব হবে।
শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যগত সমস্যার জন্য ও জীবনের কঠিন পরিস্থিতিগুলোর জন্য সব সময় শিশু-কিশোরদের দায়ী করা হয়। কিন্তু কেন তারা এ অবস্থায় পড়েছে, তা চিন্তা করা হয় না। পারিবারিক কলহের চাপে অনেক শিশুর স্বাভাবিক জীবন অস্বাভাবিক হয়ে ওঠে।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, এভাবে শিশুদের মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। যেসব শিশু মা-বাবার মনোমালিন্য দেখে বড় হয়, তারা পরবর্তীতে হতাশ, অসামাজিক ও সহিংস হয়ে ওঠে। তাদের মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি হয়। ফলে মনঃসংযোগের ঘাটতি দেখা দেয় পড়াশোনায় ও কর্মক্ষেত্রে।
বর্তমানে মানসিক রোগ সহ বিভিন্ন ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে এ প্রজন্ম। সরকার মানসিক স্বাস্থ্য সেবা জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে ও মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। দেশে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে গবেষণার ক্ষেত্র প্রসারিত করে জনগণকে সচেতন করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞসহ সংশ্লিষ্টদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। জনগণের মানসিক সুস্থতা নিশ্চিত করতে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে, যেখানে একজন কাউন্সিলর বা সাইকোলজিস্ট থাকছেন।
শারীরিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়ন, উন্নত জীবন ও সুখী সমৃদ্ধ দেশ গড়ার জন্য অপরিহার্য। মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক থাকলে কর্মদক্ষতা বাড়বে।
আজ ১০ অক্টোবর ৩১ তম বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস। ১৯৯২ সালে প্রথম পালন করা হয় এ দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো ‘সবার জন্য মানসিক স্বাস্থ্যকে বিশ্বব্যাপী অগ্রাধিকার দিন’। সারা বিশ্বে মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থা সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে ও মানসিক সুস্থতার সমর্থনে প্রচেষ্টা চালানো এদিনটির উদ্দেশ্য।
কনসালটেন্ট, নিউরোডেভলপমেন্টাল ডিজঅর্ডার এবং চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট এন্ড পেডিয়াট্রিক ডিপার্টমেন্ট, বেটার লাইফ হসপিটাল।
প্রাক্তন অটিজম বিশেষজ্ঞ, ঢাকা কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ এন্ড হসপিটাল।
জেএমএস/এমএস