মাশরাফি বিন মর্তুজার আড্ডাবাজি এবং বন্ধু বাৎসল্যের কথা কার না জানা। ছোটবেলা থেকেই ছিলেন ডানপিটে। বন্ধুদের নিয়ে হই-হুল্লোড়, চিত্রা নদীতে সাঁতার কাটা আর ঘুরে বেড়ানোই ছিল নিত্য কাজ। এসব কিছুর মাঝেই হতো ক্রিকেট খেলা। এতবেশি ডানপিটে যে, এলাকার কোন মেয়ের দিকে ফিরে তাকাবেন, মনের কোনে কোথাও প্রেম উঁকি দিবে, সে সুযোগ কোথায়! স্কুল ফাঁকি দিয়ে খেলে-বেড়ানো, বন্ধুদের নিয়ে দস্যিপনাই তো ছিল তার কাজ।
Advertisement
কিন্তু তবুও মাশরাফির জীবনে প্রেম এসেছিল। একবার নয়, দু’বার। নিজ এলাকা নড়াইলেই। প্রথম প্রেমটি কেন যেন টিকলো না। মাশরাফিও বিস্তারিত জানাননি। দ্বিতীয় প্রেমটিই পরিণয় থেকে প্রনয় সুত্রে আবদ্ধ হয়ে গেছে। সুমনা হক সুমি। মাশরাফির স্ত্রী। স্কুল জীবন থেকেই মন-দেয়া নেয়া। এরপর মাশরাফির জেদের কাছেই হার মেনে দু’ই পরিবার সিদ্ধান্ত নিলেন, দু’জনের জীবনটা এক করে দেবেন।
মাশরাফি বিন মর্তুজার প্রেম কাহিনী এবং বিয়ের অসাধরাণ গল্পই উঠে এসেছে তাকে নিয়ে লেখা জীবনীগ্রন্থ ‘মাশরাফি’তে। ক্রীড়া সাংবাদিক দেবব্রত মুখোপাধ্যয় রচিত মাশরাফির এই জীবনীগ্রন্থটি ইতিমধ্যেই বেশ সাড়া ফেলেছে। সেই বইতেই ‘এবং বিবাহ’ নামক অধ্যায়ে উঠে এসেছে মাশরাফির প্রেম এবং বিয়ের গল্প... ‘মাশরাফি’ বই থেকে সেই গল্পটাই হুবহু তুলে ধরা হলো জাগো নিউজের পাঠকদের জন্য...১কৌশিক তখন জাতীয় দলের সঙ্গে কেনিয়ায়। হঠাৎ ঝন ঝন করে বসার ঘরের ফোনটা বেজে উঠলো। ল্যান্ডফোনে কলের আওয়াজ শুনে নাহিদ (মাশরাফির মামা) অনুমান করলেন, এটা কৌশিকের ফোন। ছুটে গিয়ে ফোন তুলতেই কোন ভদ্রতার ধার না ধেরে বলল, ‘মামা, আমি বিয়ে করব।’
নাহিদ মামা একটু থতমত খেয়ে গেলেন। ভাগনে দুনিয়ার সবকিছুতেই তার সঙ্গে পরামর্শ করে, গল্প করে। কিন্তু বিয়ে-প্রেম-সংসারের বিষয়ে তো তাদের সেভাবে কখনো কথা হয়নি। আজকালও তাদের এসব কথা বলতে কেমন সংকোচ লাগে।
Advertisement
জড়তা কাটিয়ে পাল্টা বললেন, ‘সে তো ভালো কথা। দেশে আয়। মেয়ে দেখি। ভালো মেয়ে দেখে বিয়ে দিতে হবে তো।’ মাশরাফির কণ্ঠে যেন ভুত ভর করেছে। জেদের ভরে বলে চলেছে, ‘মেয়ে ঠিক করা আছে। তুমি মামির সঙ্গে আলাপ করো। সে সব বলবে নে।’
‘কোথায় মেয়ে! কার মেয়ে! দেখতে ভালো তো?’‘অত আমি বলতি পারব না। তুমি মামিরে জিজ্ঞেস করো।’ ‘আচ্ছা জিজ্ঞেস করবো নে। তুই দেশে আয়। আমি মেয়ে দেখি।’ ‘অত টাইম নেই। বিশ্বকাপ সামনে। আমি বিয়ে করে তবে বিশ্বকাপে যাব। তুমি তাড়াতাড়ি যোগাড়যন্ত্র করবা সব।’ ‘কী বলিস বাবা! এত তাড়াতাড়ি হয় নাকি?’ ‘হবে। তুমি চাইলে হবে। আরেকটা কাজ আছে...’-এবার কৌশিকের কণ্ঠটা কেমন যেন আরও ভীতু ভীতু শোনাল। ‘কী?’ ‘বাবাকে রাজি করাতে হবে। আর মেয়েদের বাড়ি রাজি করাতে হবে। এটা তোমার কাজ।’
‘মানে কী! মানে কী!’- নাহিদ সাহেব কথা শেষ করারও সুযোগ পেলেন না। ওপাশ থেকে লাইন কেটে গেছে। নাহিদ সাহেব মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে এসে সোফায় বসে পড়লেন। এক গ্লাস পানি ঢক করে খেয়ে ফেললেন। ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না, কী করতে হবে। আগে কৌশিকের মামিকে ডাকা দরকার, ‘কুহু। কুহু।’কৌশিকের মামি সেই ভেতরের রান্নাঘরে। শুনতে পাচ্ছেন না। নাহিদ মামা নিজেই এগিয়ে গেলেন, ‘কুহু, কৌশিক বিয়ে করতে চায়।’ কৌশিকের মামি হাসেন, ‘ভালো কথা তো। ছেলে বড় হয়েছে। বিয়ে দিবা না?’ নাহিদ মামা আরও অসহায় হয়ে পড়েন, ‘সে তো দেবো; কিন্তু ও নাকি মেয়ে ঠিক করে ফেলেছে? তুমি জান নাকি কিছু? দেখেছ মেয়েকে?’‘মেয়েকে তো তুমিও দেখেছো।’ ‘কী বলো, আমি কোত্থেকে দেখবো?’ কুহু মামি আরও রহস্যময় হাসি হাসেন, ‘রোজ দিন তোমার সামনে থেকে যাতায়াত করে। তুমি ভাগনের পছন্দ বুঝতে পারলে না?’ ‘রহস্য করো না। কোন মেয়ে বলো।’ ‘আরে আমাদের সুমী। তুমি দেখো নাই।’ ‘বলো কী। সে তো পিচ্চি মেয়ে।’ ‘মেয়ে পিচ্চি নেই। তোমার কৌশিকের সঙ্গে একই ক্লাসে পড়ত। এখন দেখো কীভাবে বিয়ে দেবে।’‘তাই তো! তাই তো!’ নাহিদ মামার প্রায় কেশহীন মাথায় চুল থাকলে আজ মনে হয় সেগুলো পড়ে যেতো। এ এক বিরাট দুশ্চিন্তা। এমনিতে দুলাভাইয়ের সঙ্গে সিরাজুল হক সাহেবের পরিবারের সম্পর্ক খারাপ না। আর ভদ্রলোক তো কয়েকবছর আগে মারা গেছেন। তার পরিবার, নড়াইলের অভিজাত একটা পরিবার। এ পরিবার বিয়েতে রাজি না হওয়ার কারণ নেই।কিন্তু সমস্যা হলো, এটা যে প্রেম! প্রেম শুনলেই তো দুই পরিবার বেঁকে বসবে। প্রেমের বিয়েতে কেউ কি রাজি হয় নাকি! সবচেয়ে বড় কথা এই প্রেম হলো কবে? চোখের সামনে ছেলে-মেয়ে দুটো ঘুরে বেড়ায়। নাহিদ মামা তো কখনও টের পাননি। কবে হলো প্রেম?এবার আর বসে থাকা যায় ন। জায়গায় বসে হাঁক দিলেন, ‘দুখু, দুখু।’ ‘জি’। ‘ওই পাড়ার রাজু আর অসীমক ডেকে নিয়ে আয় তো। আগে বুঝি, পানি কত দুর গড়িয়েছে।’২পানি আসলে অনেক দুর গড়িয়েছে। অনেক আগে থেকেই গড়াচ্ছে। কবে, কখন এই পানি গড়ানো শুরু হয়েছে, সে কথা অবশ্য মাশরাফি বা সুমনা হক সুমি- কেউই বলতে পারেন না। এটা সিনেমা হলে ঘটনাগুলো মিলিয়ে আমরা একটা দৃশ্যকল্প তৈরী করে নিতে পারতাম।
কৌশিকের নানাবাড়ির সামনে থেকেই সদর রাস্তা। সেই রাস্তা ধরে বই কোলে নিয়ে প্রতিদিন বিকালে প্রাইভেট পড়তে যায় সুমী। কৌশিকরা তখন রাস্তার পাশে মামার দোকানের সামনে বসে রাজা-উজির মারে। সেই সময়ই প্রেম হয়ে যেতে পারতো। কিন্তু কৌশিকরা তখন এলাকার অ্যাংরি হিরো; মেয়েদের দিকে ফিরে তাকানোর সময় কই!
Advertisement
সুমীদেরও তখন ছেলেদের দিকে ফিরে তাকানোর সময় নেই। বিশেষ করে কৌশিকদের দিকে প্রেমভরা নয়নে তাকানোর তো কোনো কারণই নেই। তখন সময়টা হলো এলাকার বড় ভাই, স্কুলের সিনিয়র, এমনি গৃহশিক্ষকের প্রেমে পড়ার। অন্তত সুমীর বান্ধবীরা তাই পড়ছিল ঝটপট করে। সেখানে সুমী তো মন চাইলেও একই ক্লাসে পড়া কৌশিকের প্রেমে পড়তে পারে না।
যদিও প্রাইভেট পড়তে যাওয়ার সময় হো হো করে হাসতে থাকা কৌশিককে দেখে মাঝে মাঝে প্রেমে পড়তে ইচ্ছে করে। ক্লাসে তো প্রায়ই যায় না। স্কুলে গিয়েই সুমী একবার ছেলেদের বেঞ্চের ওদিকে তাকায়। দেখে, কৌশিক নেই; কোথায় নাকি খেলতে গেছে। ফলে বাড়ির পাশের ছেলে, একই ক্লাসের ছেলে হওয়ার পরও দেখা মেলাই ভার সাহেবের।
তারপরও যখন স্কুলে আসে; যেভাবে বাঁদরামি করে, মেয়েদের টিপ্পনী কাটে, যেভাবে সবাইকে নিয়ে স্যারদের পেছনে লাগে, তাদের মনে হয় মাঝে মাঝে দস্যু ছেলেটা খারাপ না। কিন্তু সমস্যা হলো, সমবয়সী ছেলের প্রেমে পড়া ঠিক না! তাই মনে সবই ইচ্ছে হয়; কিন্তু প্রেমে আর পড়ে না সুমী।
সুমী প্রেমে না পড়লে কী হয়; মাশরাফি প্রেমে পড়ে। যার তার প্রেমে পড়ে। প্রায়ই প্রেমে পড়ে। প্রেমে পড়ে ইনজুরি হওয়ার কোন ব্যবস্থা থাকলে তার ইনজুরির তালিকা আরও দীর্ঘ হতো; ভাগ্যিস এই পড়ায় হাত-পা ভাঙে না। তাই স্কুলে, রাস্তায় যে মেয়েকে দেখে, তারই প্রেমে পড়ে যায়।
প্রেমে পড়া মানে অবশ্য ভালোবাসা না। সে বয়সে বাউন্ডুলে ছেলেদের আর যা হয় আর কী। সুন্দর চেহারা দেখলেই ভালো লাগে। মাশরাফি অবশ্য দাবি করেন, তিনি ক্লাস নাইন বা টেনে পড়া অবস্থায় খুব সিরিয়াস একটা প্রেমে পড়েছিলেন। উচ্চমাধ্যমিক প্রথম বর্ষ শুরু করা অবধি নাকি সে প্রেম চলমানও ছিল।
ধরা যাক নাম তার অনামিকা; এতকাল পর ‘মাশরাফির সাবেক প্রেমিকা’ বলে কাউকে পরিচয় করিয়ে দেওয়াটা অন্যায় হবে বলেই এই বিকল্প নাম খুঁজলাম। সেই প্রেমে হাবুডুবু খেতে খেতে মাশরাফি অনামিকাকে বিয়ে করে ফেলবেন বলেও ঠিক করে ফেলেছিলেন।
কিন্তু সে প্রেম টিকলো না। যাকে বলে ‘ব্রেকআপ’; কী এক কারণে তাই হয়ে গেলো। মাশরাফির দাবি, ওই প্রেমটা চালিয়ে গেলেও বিয়ে করা কঠিন হতো। বাসা থেকে কিছুতেই মানতো না। তাই ওই ব্রেকআপটা জরুরী ছিল। সদ্য প্রেম ভেঙে যাওয়ায় মাশরাফি তখন দেবদাসের মত ঘুরে বেড়ান। সময়টা সম্ভবত নিউজিল্যান্ড থেকে ইনজুরি নিয়ে ফেরার পরের প্রায় এক বছর বিরতির সময়। ওই সময়ের আগে আগে পুরনো প্রেমটা ভেঙে গেছে। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি নিয়ে বৈরাগির মতো ঘুরে বেড়ান মাশরাফি। মাঝে মাঝে ক্র্যাচে ভর দিয়ে কলেজে যান; পরীক্ষা দিতে হবে বলে বাড়ির চাপ আছে। বাড়ির চাপ না থাকলে পরীক্ষাও দিত না; অর্থহীন মনে হয় সবকিছু।
প্রাণবন্ত ছেলেটা আর মেয়েদের দিকে ফিরেও তাকায় না। মাথা নীচু করে কলেজে আসে আর চুপচাপ চলে যায়। বিকেল হলে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেয়। দেখে সুমীর মন খারাপ লাগে। কিছু বলতে পারে না- কৌশিক তো স্রেফ ক্লাসমেট; তাকে আর কী বলা যায়!
এদিকে মাশরাফির সামনে তখন নতুন আরেক সমস্যা। পরীক্ষা দেবে; প্রস্তুতি বলে কিছুই নেই। নোটপত্র লাগবে, সাজেশন লাগবে। কোথায় পাওয়া যায়। একদিন ক্লাসে পাশের ক্লাসে পাশের বাড়ির সুমীর সঙ্গে কথা হলো। সে বলল, তার কাছে সংক্ষিপ্ত সাজেশন এবং নোট আছে। চাইলে নিতে পারে মাশরাফি। সেদিনই কলেজ থেকে হেঁটে হেঁটে সুমীর সঙ্গে বাড়ি ফিরল। সেদিন বিকেলে আবার কী একটা ব্যস্ততা আছে। তাই নোট নিতে তাদের বাড়িতে আর ঢোকা হলো না। বলল, ‘সুমী, তোদের নম্বরটা দে। আমি পরে ফোন দিয়ে আসব।’
ফোন নাম্বারটা লিখে দিচ্ছে সুমী। তখনই হঠাৎ সুমীর মুখের দিকে তাকাল মাশরাফি। বুকটা ছড়াৎ করে উঠল। এতদিনের বন্ধু সুমী; ওর মুখটা এভাবে তাকিয়ে তো কখনও দেখেইনি। মুখটায় এত মায়া, মাশরাফির জন্য যেন কত ভালোবাসা জমে আছে। একটু অবাক হয়ে চেয়ে রইল মাশরাফি। দৃষ্টিটা কীভাবে যেন টের পেয়ে গেলো সুমী। লাজুক চোখে ফিরে তাকাল সে।এটাই কি সেই প্রেম!
৩‘আজ কি কলেজে যাবি, সুমী?’ ‘যাব, তুই আসবি?’ ‘হ্যাঁ। তাহলে আসার সময় নোটটা নিয়ে আসিস।’ ‘শোন। নোটের ব্যাপার কী হয়েছে; ওই যে আমাদের ক্লাসের একটা মেয়ে আছে না, লম্বা মতো। সে তো আবার প্রেম করে যশোরের একটা ছেলের সঙ্গে। সেই ছেলে এসেছিল সেদিন...’ নোটের প্রয়োজন যেন একটা উপলক্ষ মাত্র। ফোনে এমন কত অর্থহীন কথা হয়। কত অর্থহীন চোখে চেয়ে থাকা। হঠাৎ করে কলেজ ব্যাপারটাকে খুব আকর্ষণীয় মনে হতে থাকে মাশরাফির। রোজই তার নোট আনতে যাওয়া চাই; নোট আনা হয় না। অনেক কিছুই হয়।
এই পর্যায়ে এসে আমরা একটা দোটানায় পড়ে গেলাম। আমরা ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না যে, সেই প্রেমের প্রস্তাবটা কে দিয়েছিল। প্রথম বেলায় নড়াইল গিয়ে জানা গেলো, সুমীই বুঝি কাউকে দিয়ে এই মহাজাগতিক খবরটা পাঠিয়েছিলেন; কিন্তু সুমী-মাশরাফি একসঙ্গে আড্ডা দিতে দিতে কথাটা শুনলেন। শুনেই মাশরাফি ‘রে রে’ করে উঠলেন, ‘নাহ। আমি প্রস্তাব পাঠিয়েছিলাম। আমাদের এক বন্ধু ছিল; কমন ফ্রেন্ড। ওকে দিয়ে প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন।’
মাশরাফি জানতেন, এক প্রস্তাবেই কাজ হবে না। মেয়ে ‘ভাব নেওয়ার’ চেষ্টা করবে। তাই তিনিও নাকি খুব ভাব নিয়ে প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন। সেই ভাবটা কী তা জানা গেলো না। দু’জনের হাসি দেখে অনুমান করা যায় শুধু, ভাবটা বিশেষ কিছু ছিল।
থাক না; কিছু কথা গোপনই থাক। এসব কথা গোপন থাকলেও, দুটো মন যে মিলে যাচ্ছে, সে খবর কী আর গোপন থাকে! আর কেউ টের না পাক, নড়াইলের বিখ্যাত বন্ধুবাহিনী কয়েকদিনের মধ্যেই ধরে ফেলে, কিছু একটা কোথাও হচ্ছে। ইদানীং মাশরাফি কেমন উড়ু উড়ু করে। নদীর চেয়ে রাস্তা তাকে বেশি টানে, বাগানের চেয়ে কলেজ তাকে বেশি ডাকে। ব্যাপারটা কী? একদিন বন্ধুরা ধরল খুব- কী ব্যাপার রে, কৌশিক! ইদানিং সুমীর সঙ্গে খুব গুজ গুজ করিস। ‘কিছু না, কিছু না’ বলেও পার পাওয়া যায় না। শেষ পর্যন্ত সবাইকে একটু রেখে-ঢেকে বলে দিতেই হলো। তকবে একেবারে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিল, কিছুতেই এই খবর, যেন ফাঁস না হয়। অন্তত নিজের পায়ের তলে মাটিটা একটু শক্ত না করে কাউকে কিছু জানাতে চায় না মাশরাফি। আড্ডা চলুক, চোখে চোখে কথা চলুক; কিন্তু ব্যাপারটার বিস্ফোরণ ঘটাতে একটু সময় চাই।
৪২০০৫ সালেরই এপ্রিল মাসের শেষ দিকের ঘটনা। পরের মাসে মাশরাফি দলের সঙ্গে ইংল্যান্ড যাবে। আগামী সপ্তাহেই ঢাকা যেতে হবে। ঘরোয়া ক্রিকেটের খেলা আছে। জাতীয় দলের ক্যাম্প আছে। এর ফাঁকে অল্প কয়েকটা দিনের জন্য নড়াইল এসেছে মাশরাফি। আসার সময় এক গাদা জার্সি নিয়ে এসেছে। শুভেচ্ছা ক্লাবের ছোটদের জন্য, নতুন নতুন যারা দলে আসছে, তাদের জন্য ৪০-৫০টি জার্সি। সারাটা বিকেল ধরে সেই জার্সি বিলানো হলো। আস্তে আস্তে ভিড় ভেঙে গেলো। রাত হয়ে গেছে। বন্ধুরাও সব উঠছে।
রাজুকে একপাশে ডাক দিলেন মাশরাফি। ফিস ফিস করে বলল, ‘চুন্নু আর অসীমকে বল থেকে যেতে। তোদের তিনজনের সঙ্গে আলাপ আছে।’ তিন বন্ধু উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করছে। রাত গভীর হয়ে গেছে। চুন্নু জিজ্ঞেস করল, ‘কী হইছে কৌশিক?’‘একটা ঝামেলা হইছে।’ ‘কী ঝামেলা?’ ‘আমার বিয়ে করতি হবে।’ ‘সে তো ভালো কথা। বাড়িতে কথা বল। সুমীদের বাসায় প্রস্তাব পাঠা। বিয়ে হোক।’ ‘নাহ, সে সময় নাই। বাড়ী থেকে কী করে কে জানে। আমাদের নিজেদেরই বিয়ে করতে হবে।’
তিনজনের মাথায় যেন বাজ পড়ল। তিনজনই বোঝানোর চেষ্টা করল, এটা ঠিক হবে না। কিন্তু কৌশিক কিছুতেই রাজি নয়। পরদিন পহেলা মে। মাশরাফির চাই, সেদিনই বিয়ে করতে হবে। এমনকি কাজীও নাকি সে ভেবে ফেলেছে। এলাকার বড় ভাই, মিঠু ভাই এখন কাজি। তাকে ডাকলেই চলবে। কিছুতেই একমত না রাজুরা। শেষ পর্যন্ত মাশরাফির জেদের কাছে হার মানল তিন বন্ধু। ডেকে আনা হলো পরদিন মিঠু ভাইকে।
তারপর...। নাহ এটাও গোপন ব্যাপার। ২০০৫ সালেল ১ মে, নড়াইলে কিছু একটা ঘটেছিল। যেটা আমরা জানতে পারিনি। অনেক চেষ্টা করেও উদ্ধার করা যায়নি, হারিয়ে যাওয়া সেই নথি।
৫গোলাম মর্তুজা, রাজি নন। তার এক কথা, ‘মেয়ে ভালো। পরিবার ভালো। সবই বুঝলাম; কিন্তু প্রেম করে বিয়ে করবে কেন?’ এই হয়। এই মর্তুজা সাহেব নিজে দারুন এক প্রেম করে বিয়ে করেছিলেন; কিন্তু বাবা হিসেবে ছেলের ব্যাপার সেটা মেনি নিতে একটু যেন আপত্তি। তার চেয়েও বেশি আপত্তি মেয়ের পরিবারের। মেয়ের পরিবারের যত না আপত্তি, তার চেয়ে বেশি তাদের আত্মীস্বজনের।
সুমীর বাবা মারা গেছেন সেই ছোটবেলায়। মা হোসনে আরা বেগমের পরিশ্রম আর অভিভাবকত্বেই মানুষ হয়েছে সুমী। আর্থিক কষ্ট না থাকলেও বাবাকে না পাওয়ার কষ্ট ছিল ছোটবেলায়। মেয়েদের অবশ্য সেই কষ্ট পেতে দেননি মা। আত্মীয়স্বজন এসে মাকে বোঝায়, ‘ছেলে ক্রিকেট খেলে। কোথায় কী করে, তার কোনো ঠিক আছে! এমন ছেলের হাতে মেয়ে দেওয়া ঠিক হবে না।’ সুমী বোঝানোর চেষ্টা করে। নিজের বিশ্বাসের কথা বলার চেষ্টা করে; কিন্তু কাজ হয় না।
পুরো ব্যাপারটা এক করতে জীবন বের হয়ে যাচ্ছে নাহিদ মামার। মাশরাফি তো এক ফোন করেই খালাস। এখন দুই বাড়িকে রাজি করাতে প্রাণ যায়। তিনি ছোটাছুটি করছেন। কথায় বলে, লাখ কথা না হলে বিয়ে হয় না। নাহিদ মামা একাই মনে হয় কোটি কথা ব্যায় করে ফেলেছেন।
এদিকে কৌশিক দেশে চলে এসেছে। সে শুরু করল জেদাজেদি। দুই পরিবার রাজি না হলে সে নাকি নিজেই বিয়ে করে ফেলবে। কখনও না খেয়ে থাকে, কখনও কথা বলে না। আবার কখনও নিজের হাত কেটে ফেলার হুমকি দেয়। এমন চলতেই থাকতো হয়তো। শেষ পর্যন্ত নাহিদ মামা দুই পরিবারে চরম ঘোষণাটা দিয়ে দিলেন, ‘আপনারা আপসে রাজি হলে ভালো কথা। নইলে আমি ওদের বিয়ে দিয়ে দেবো। পারলে আপনারা দুই পরিবার ঠেকাতে আসবেন।’
এই হুমকির পর আর কথার দরকার হলো না। সিনেমার শেষ দৃশ্যের মতো হাসি হাসি মুখে সবাই রাজি হয়ে গেলেন। বাড়ির সামনে বিশাল সাউন্ড বক্স বসে গেলো। চরম হট্টগোলের মধ্যে বেজে উঠলো সানাই।
আইএইচএস/আরআইপি