চিকিৎসা মহান পেশা হিসেবেই স্বীকৃত বিশ্বে। মানুষের প্রাণ বাঁচানোই চিকিৎসকদের কাজ। তবে চিকিৎসক হয়ে প্রাণ বাঁচানোর বদলে একের পর এক প্রাণ নিয়েছেন এক সিরিয়াল কিলার। জানা যায়, ২৫০ এরও বেশি মানুষ মারা গিয়েছে তার হাতে। সিরিয়াল কিলারের তকমাও পেয়েছিলেন সে সময়।
Advertisement
সময়টা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঠিক পরপর। প্রায় শখানেক খুন করার অপরাধে পুলিশের হাতে ধরা পড়েন এক ব্যক্তি। নতুন এক সিরিয়াল কিলারের আগমন শহরে বেশ ভীতির সৃষ্টি করেছিল। মানুষ থেকে প্রশাসন সবাই এই সিরিয়াল কিলারকে একজন মানসিক বিকারগ্রস্তই ভাবতে শুরু করেন। তবে চমকপ্রদ তথ্য হচ্ছে এই খুনি ছিলেন একজন চিকিৎসক। যে সে হাতুরি চিকিৎসক নন, বেশ নাম করা চিকিৎসক ছিলেন সে সময়। সবাই হতবাক হয়ে যান তার এই পরিচয়ে।
সেই সিরিয়াল কিলার ডাক্তারের নাম হ্যারল্ড শিপম্যান। ভিক্টিমরা সবাই মৃত্যুর আগে তারই চিকিৎসাধীন ছিলেন। এই ঘটনা নাড়িয়ে দিয়েছিল গোটা যুক্তরাষ্ট্র। তবে কেন তিনি একের পর এক খুন করে গেছেন নিজের অসহায় রোগীদের সে প্রশ্নের উত্তর মেলেনি আজও। মানুষের প্রাণ বাঁচানোই যে পেশার মূল কথা, সেই পেশায় থাকা একজন মানুষের এই রক্তলোলুপতা আজও আমাদের ভয় আর বিস্ময় ঘনিয়ে তোলে।
তবে একদিনে হ্যারল্ডের মনে এমন পশুর জন্ম নেয়নি। শৈশব থেকেই তার জীবন কেটেছে ভালোবাসাহীন। যা ধীরে ধীরে হ্যারল্ডকে করে তুলেছে হিংস্র। ১৯৪৬ সালের ১৫ জানুয়ারি নটিংহামের এক শ্রমজীবী পরিবারে জন্ম হ্যারল্ডের। তার বাবা ছিলেন একজন ট্রাক ড্রাইভার। কাজের জন্য গাড়ি নিয়ে তিনি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছুটে বেড়াতেন। ফলে বছরের অর্ধেক দিনই তিনি থাকতেন বাড়ির বাইরে।পরিবারের প্রতি তার টানও কম ছিল। তাই ছেলেবেলা থেকেই শিপম্যান বাবার ভালোবাসা কোনোদিনই সেভাবে পাননি।
Advertisement
যুদ্ধবিধ্বস্ত শ্রমজীবী পরিবারের বেঁচে থাকার নিরন্তর লড়াই খুব ছোট থেকেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন শিপম্যান। ছোটবেলা থেকেই হ্যারল্ডের একমাত্র সঙ্গী ছিলেন তার মা। একমাত্র মায়ের আদরেই বেড়ে উঠেছিলেন ছোট্ট শিপম্যান। তবে তাও বেশিদিন কপালে জোটেনি তার। ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে তার মা ভেরা ভেট্রন যখন মারা যান তখন শিপম্যানের বয়স মাত্র সতেরো বছর।
জীবনের শেষ দিকে ভেরা ক্যানসারের তীব্র যন্ত্রণা কমাতে দিনের পর দিন মরফিন ইঞ্জেকশন নিতেন। মায়ের শেষ দিনগুলোতে তাঁর পাশে থেকে হ্যারল্ড স্বচক্ষে দেখেছেন মায়ের প্রাণঘাতী কষ্ট আর তা লাঘবের জন্য ডাক্তারের নির্দেশে বারবার মরফিন ইঞ্জেকশন নেওয়া। এই ঘটনাই তীব্র রেখাপাত করে হ্যারল্ডের পরবর্তী জীবনে।
ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনা ও খেলাধুলায় দুর্দান্ত ছিলেন হ্যারল্ড শিপম্যান। স্কুল জীবনে যুব রাগবি দলের সদস্য ছিলেন তিনি এবং স্কুল জীবনের শেষ বছরে তিনি স্কুলের অ্যাথলিট দলের ভাইস প্রেসিডেন্ট হন। শারীরিক সক্ষমতায় সহপাঠীদের থেকে অনেকটাই এগিয়ে ছিলেন হ্যারল্ড। ১৯৭০ সালে লিডস থেকে ডাক্তারি পাস করে ইয়র্কশায়ারে পোর্টফ্রেট জেনারেল ইনফরমারিতে কাজ শুরু করেন হ্যারল্ড।
১৯৭৪ সালে পশ্চিম ইয়র্কশায়ারের আব্রাহাম অরমেরড মেডিক্যাল সেন্টারের জেনারেল প্রসিকিউটর (জিপি) হিসেবে প্রথম স্থান লাভ করে সবাইকে চমকে দেন তিনি। তবে এত সাফল্যেও মায়ের মৃত্যু তাকে কিছুতেই স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে দেয়নি। বিভিন্ন ধরনের অদ্ভুত গবেষণার মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে রাখতেন। এমনই এক গবেষণার জন্য প্যাথিডিন নামক এক ধরনের নিষিদ্ধ ড্রাগ জোগাড় করতে গিয়ে প্রেসক্রিপশন জালিয়াতির কর্মকাণ্ডে ধরা পড়েন তিনি। বেশ মোটা টাকা জরিমানাও হয়। মানসিক অস্থিরতা কমাতে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় রিহ্যাবিলিটেশনে। বেশ কিছুদিন সেখানে থাকার পর নিজেকে শুধরে আবার মূল পেশায় ফিরে আসেন হ্যারল্ড। আর এখান থেকেই মূল কাহিনির শুরু।
Advertisement
আশির দশকের শুরুতে হাইড শহরে ডাক্তারি চেম্বার সাজিয়ে জাঁকিয়ে বসেন হ্যারল্ড। বাড়তে থাকে পশারও। কিন্তু ছেলেবেলার দিনগুলোর স্মৃতি প্রতিনিয়ত কুড়ে কুড়ে খেত তাকে। মায়ের দীর্ঘ অসুস্থতা ও মৃত্যু, অর্থকষ্ট, শৈশবের স্নেহবঞ্চিত জীবন সবকিছুই ভয়ংকর ছায়া ফেলেছিল শিপম্যানের জীবনে। তবে সেই মানসিক চাঞ্চল্য সাধারণের চোখে ধরা পড়ত না।
অসাধারণ দক্ষতায় তিনি ক্যামোফ্লেজ করে রাখতেন নিজেকে। আপাতভাবে সুস্থ আর সাফল্যময় এক জীবন। এমনকি সমাজে মানসিক ব্যাধিগ্রস্তদের সঙ্গে কেমন আচরণ করা উচিত তা নিয়ে ১৯৮৩ সালে টেলিভিশনে একটি বক্তৃতা দিয়ে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন। যা সেসময় গুণীমহলে বেশ প্রশংসিত হয়।
চেম্বারে বসার পর সবকিছু ভালই চলছিলো। রোগীদের ভিড়ও ছিল প্রচুর। ডাক্তার হিসেবে হাইড শহরে বেশ জাঁকিয়েই বসেছিলেন হ্যারল্ড। সেসময় হাইড শহরের ‘ফ্র্যাঙ্ক মেসি অ্যান্ড সন্স’ নামক এক সংস্থা ছিল, যেখানে মানুষের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া দেখভাল করা হত। সংস্থার কর্ণধার ছিলেন ডা. লিন্ডা রেনল্ডস। কিছুদিন ধরেই একটা ব্যাপারে খটকা লাগছিল তার। তিনি লক্ষ্য করেছিলেন, ইদানীং অন্ত্যেষ্টির জন্য যত মৃতদেহ আসছে তাদের মধ্যে হ্যারল্ড শিপম্যানের কাছ থেকে আসা মৃতদেহের সংখ্যা অনেক বেশি।
প্রথমে ব্যাপারটিকে বিশেষ আমলে নেননি তারা। এটা হতেই পারে যে শহরের বিশিষ্ট ডাক্তারের কাছে রোগীর ভিড় যেমন বেশি, তেমনই কোনো কারণে তার রোগীদের মধ্যে মৃতের সংখ্যাও বেশি। পুরো ব্যাপারটাকেই প্রথমে ডা. লিন্ডা কাকতালীয় ভেবে উড়িয়ে দেন।
কিন্তু ব্যাপারটা বেড়েই চলে। আরও একটা জিনিস লক্ষ করেন ডা. লিন্ডা। তিনি দেখেন, যতজনের ক্রিমেশন ফর্ম সাইনের জন্য ইদানীং তার কাছে পাঠানো হয়, তারা সবাই বৃদ্ধা এবং সবারই চিকিৎসা করেছেন ডা. হ্যারল্ড শিপম্যান। তিনি খেয়াল করে দেখেন কয়েক মাসের মধ্যে এরকম প্রায় ১০ জন বৃদ্ধার মৃতদেহের রিপোর্ট তার কাছে জমা পড়েছে। এবার সন্দেহ কিছুটা দানা বাঁধে। এ ব্যপারে তদন্ত করার সিদ্ধান্ত নেন ডা. লিন্ডা। কিন্ত প্রথম প্রথম যথেষ্ট প্রমাণের অভাবে হাত গুটিয়ে নেয় পুলিশ। নাম কা ওয়াস্তে কিছু রুটিন অনুসন্ধানের পর ১৯৯৮ সালের ১৭ এপ্রিল তদন্ত বন্ধ করে দেওয়া হয়।
অবশ্য এত সহজে দমে যাওয়ার পাত্র নন ডা. লিন্ডা। এছাড়া তদন্ত বন্ধ হওয়ার পরপরই আরও তিনটি মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। তারা সবাই বৃদ্ধা এবং তারা সবাই ছিলেন শিপম্যান। মারা যাওয়া শেষ রোগীর নাম ছিল ক্যাথলিন গ্রান্ডি। তার ডেথ সার্টিফিকেটে সই করার সময় স্পষ্ট কারণ না দেখিয়ে স্রেফ বয়সজনিত কারণেই গ্রান্ডির মৃত্যু হয়েছে বলে লিখে দেন শিপম্যান। এই ঘটনার পর আবার নড়ে চড়ে বসে প্রশাসন। সমালোচনার মুখে পড়ে প্রথমে অনভিজ্ঞ পুলিশকর্মীদের হাতে এই কেসটির দায়িত্বভার ছেড়ে রাখার সিদ্ধান্তটিও।
সন্দেহ প্রগাঢ় হয় যখন গ্রান্ডির মেয়ে অ্যাঞ্জেলা উডরাফ দেখেন যে তার মা নিজের সব সম্পত্তিই ডাক্তার শিপম্যানের নামে লিখে দিয়ে গেছেন। তার সম্পত্তির পরিমাণ নেহাত কম ছিল না। তখনকার দিনের হিসাবে তিন লাখ ছিয়াশি হাজার পাউন্ড। উডরাফ পুলিশে রিপোর্ট করেন এবং ফের অনুসন্ধান শুরু হয়। তদন্ত করতে খোঁড়া হয় কবর। গ্রান্ডির শবদেহ বের করে ফের কাটাছেঁড়া করা হলে তার শরীরে অত্যধিক পরিমাণে ডায়ামর্ফিন পাওয়া যায়। রাসায়নিকটির পুরো নাম ডায়ামরফিন হাইড্রোক্লোরাইড। যা কোনো বয়স্ক লোকের শরীরে অতিরিক্ত মাত্রায় প্রবেশ করালে মৃত্যু অনিবার্য।
মুহূর্তের মধ্যেই মৃত্যুর রহস্য অনেকটা সহজ হয়ে আসে। ১৯৯৮ সালের ৭ সেপ্টেম্বর শিপম্যানকে গ্রেফতার করা হয়। তাঁর বাড়ি থেকে সম্পত্তির উইল জালিয়াতির কাজে ব্যবহৃত একটি টাইপরাইটারও আবিষ্কৃত হয়। পুলিশের তৎপরতা আরও বেড়ে যায়। গত কয়েক মাসে শিপম্যানের দাখিল করা ডেথ সার্টিফিকেটে নাম আছে এমন ১৫টি মৃতদেহকে ফের কবর খুঁড়ে বের করে মর্গে পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়।
ময়নাতদন্তের পর স্পষ্ট হয়ে যায় যে, পনেরটি লাশের প্রত্যেকের শরীরেই বেশি মাত্রায় ডায়ামর্ফিনের প্রয়োগ হয়েছিল। শিপম্যান মারাত্মক রকমের বেশি ডায়ামর্ফিন রুগির শরীরে ঢুকিয়ে তাদের খুন করতেন এবং পরে মেডিক্যাল রিপোর্ট জাল করে নানা ধরনের অসুখের কারণ দেখিয়ে তাদের ডেথ সার্টিফিকেট দিতেন। পুরো ব্যপারটাই সরকারি গোয়েন্দারের কাছে পানির মতো পরিষ্কার হয়ে যায়। সন্দেহের কোনো অবকাশ থাকেনা যে এই ১৫টি মৃত্যুর পেছনে ডাক্তার শিপম্যানই দায়ী। কিন্তু কেন তিনি অকারণ এতগুলো নিরীহ মানুষকে খুন করলেন তার কোনো সদুত্তর সেভাবে পাওয়া যায়নি।
মানসিক চিকিৎসকদের মতে, নিজের অত্যন্ত প্রিয় মানুষকে চোখের সামনে কষ্ট পেয়ে মারা যেতে দেখে এক অদ্ভুত রাগ তৈরি হয়েছিল হ্যারল্ডের মনে। নিজের মাকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে পারেননি তিনি। কিন্তু মায়ের ওই মরফিন নিতে নিতে দগ্ধে দগ্ধে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার প্রতিশোধ নিতেই যেন আরও বেশি অপরাধপরায়ণ হয়ে ওঠেন তিনি। মা হারানোর যে যন্ত্রণা তিনি পেয়েছিলেন তা তিনি সেটাই যেন ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন সমাজের বুকে।
তখনকার দিনে প্রযুক্তি অতটা উন্নত ছিল না। হ্যারল্ডের অপরাধ হয়তো কোনোদিনই ধরা পড়ত না, যদি না তিনি টাকার লোভে উইলগুলো নিজের নামে করাতেন। এই উইল জাল করা নিয়ে দুটো তত্ত্ব দাঁড় করেছিলেন প্রেসক্রিপশন ফর মার্ডার বইটির লেখকদ্বয়- ব্রায়ান হুটল্ এবং জাঁ রিচি। প্রথম তত্ত্বটি ছিল, টানা খুনখারাপির ফলে জীবনের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছিলেন শিপম্যান। ক্রমশ পৃথিবীতে বেঁচে থাকার ইচ্ছেটি ক্ষীণ হয়ে আসছিল তার জীবনে। দ্বিতীয় তত্ত্বটি হয়তো অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্য, সেই মত অনুসারে পঞ্চান্ন বছর বয়সে সবকিছু আত্মসাৎ করে তল্পিতল্পা গুটিয়ে ইংল্যান্ড ছেড়ে পালানোর মতলব এঁটে রেখেছিলেন তিনি।
১৯৯৯ সালের ৫ অক্টোবর সিরিয়াল কিলার শিপম্যানের বিচার শুরু হয়। মোট ১৫টি খুনের দায় চাপানো হয় তার ঘাড়ে। যদিও মনে করা হয়, তার অসুস্থ মনের শিকার হয়েছিল ২৫০ এরও অধিক লোক। যাদের আশি শতাংশই নারী এবং বয়স্ক। তার হাতে খুব হওয়া সবচেয়ে কম বয়সী ছিলেন একজন পুরুষ। তার বয়স ছিল ৪১ বছর।
২০০০ সালের ৩১ জানুয়ারি পনেরো জনকে হত্যা এবং ক্যাথলিন গ্রান্ডির উইল জাল করার দায়ে জুরি তাকে দোষী সাব্যস্ত করে। আদালত শিপম্যানকে পনেরোটি খুনের দায়ে আজীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে। আদালত তাদের রায়ে এমন ব্যবস্থা করে যেন শিপম্যান কখনোই ছাড়া না পায়। চার বছর জেল খাটার পর ২০০৪ সালের ১৩ জানুয়ারি জেলখানাতেই আত্মহত্যা করেন শিপম্যান।
সূত্র: হিস্ট্রি অব ইয়েসটারডে
কেএসকে/এএসএম