ফিচার

ডিজেল-পেট্রল কেন এত দরকারি?

আধুনিক যন্ত্রসভ্যতা টিকিয়ে রাখতে ডিজেল-পেট্রল আজ এতই দরকারি যে, এই সভ্যতাকে পেট্রলিয়ামের সভ্যতা বললেও কারো হয়তো আপত্তি থাকবে না। রাস্তা দিয়ে হু-হু করে ছুটে যাচ্ছে ট্রাক, প্রাইভেট কার, বাস, পিকআপ, মোটরসাইকেল। এসব চালাতে যে পেট্রল বা ডিজেল প্রয়োজন হয় তা আমরা পেয়ে থাকি পেট্রলিয়াম থেকে। শুধু কি তাই? প্লেনের তরল জ্বালানিও আসে পেট্রলিয়ামের পাতন থেকে। গ্রামে বাতি জ্বালানোর কেরোসিন, পাকা রাস্তা বানানোর পিচ এসবও আমাদের যোগান দেয় পেট্রলিয়াম। তাছাড়া কলকারখানায় হরেকরকম যন্ত্রপাতি চালাতেও পেট্রলের জুড়ি মেলা ভার।

Advertisement

এখানেই শেষ নয়। আমাদের জামা-প্যান্ট কিংবা শাড়ি তৈরি হয় যে টেলিরিন থেকে অথবা আধুনিক কায়দায় চেয়ার সাজাতে যে ফরমাইকা লাগে কিংবা কৃত্রিম রাবারের কথাই ধরা যাক। এসব কিছুই মেলে পেট্রলিয়াম থেকে। এসব কথা শুনলে হয়তো অনেকেরই অবাক লাগবে। চোখ কপালে উঠবে। নানান ওষুধপত্র, বিস্ফোরকপদার্থ, অ্যালকোহল, অ্যামোনিয়া, রাসায়নিক পদার্থ এমনকি মেয়েদের ঠোঁটে ব্যবহারের লিপিস্টিক তৈরির জন্যও পেট্রলিয়াম একটি অপরিহার্য উপাদান। এক কথায় এসব জিনিসের যোগানদার হল পেট্রক্যামিক্যালস।

খনি থেকে যে কাঁচা অর্থাৎ ক্রড পেট্রলিয়াম পাওয়া যায় তা কিন্তু সেই অবস্থায় কোনো কাজেই লাগে না। তাই সেটাকে শোধন অর্থাৎ পরিষ্কার করতে হয়। পেট্রলিয়াম শোধন করার সময় আমরা যে রকমারি জিনিস পাই তাকেই বলা হয় পেট্রক্যামিকেলস। এই পেট্রক্যামিক্যালসও নানান কাজে লাগে। মোমবাতির মোম কিংবা পোকামাকড় মারার ওষুধপত্রও পেট্রকেমিক্যালস দিয়ে তৈরি হয়। পাথরের ভেতরে পেট্রলিয়ামের সঙ্গী হয় যে প্রাকৃতিক গ্যাস তা যোগান দেয় আমাদের রান্নার গ্যাস।

কিন্তু অবাক হলেও সত্যি, গবেষকরা বলেন- গোটা পৃথিবীতে এখন যতটা পেট্রলিয়াম মজুত আছে, বর্তমান হারে খরচ করে গেলে তা ফুরাতে সময় লাগবে আর মাত্র ৭৫ বছর। বড় জোর ১৫০ বছর। আর কয়লা হয়তো ১৫০ বছর পাওয়া যাবে। তারপর? তখন কলকারখানা চালানো কিংবা বিদ্যুৎ তৈরির জ্বালানি পাওয়া যাবে কোত্থেকে? এসব সমস্যা সমাধানের জন্য বিজ্ঞানীরা বহুদিন থেকেই গবেষণা চালিয়ে আসছেন। রসায়নবিদরা দেখেছেন হিভিয়াব্রাজিলিয়েনসিস নামে এক ধরনের রাবার গাছ ব্রাজিলে জন্মায়। সেই গাছের রস থেকে পেট্রলিয়ামের মতো জ্বালানি তৈরি করা মোটেই শক্ত কাজ নয়। তাছাড়া আখের রস থেকেই প্রায় সব জাতের পেট্রকেমিক্যালস পাওয়া যেতে পারে। এসবই হচ্ছে নতুন প্রচেষ্টা।

Advertisement

পৃথিবীর বুক থেকে পেট্রলিয়াম ও কয়লা ফুরিয়ে গেলে মানুষ আর তা তৈরি করতে পারবে না। কিন্তু পৃথিবীতে যতদিন মানুষ, মাটি আর পানি থাকবে, আখ বা রাবার গাছও ততদিন ফলবে। পেট্রলিয়ামের বিকল্প তৈরি করা হয়তো তেমন শক্ত হবে না। একটু ঘুরিয়ে বলা যায়, পেট্রলিয়াম তখন গাছে ফলবে। আজগুবি হলেও কথাটা বোধ হয় মিথ্যে হবে না।

সাধারণভাবে পেট্রলিয়াম বলতে বোঝায় খনিজ তেল। তবে বিজ্ঞানীরা একে ভাগ করেছেন তিন ভাগের তরল বাদামি রঙের খনিজ তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস, কঠিন কালো চটচটে বিটুমিন ও পিচ। খনিজ তেল হরেক রঙের হতে পারে। হালকা সবুজ, হলুদ, গাঢ় বাদামি, এমনকি কালো হলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। তেলের ভেতরে প্যারাফিন থাকলে রং হয় হালকা, কিন্তু অ্যাসফ্যাল্ট মেশানো তেলের রঙ গাঢ়। খনিজ তেলের আর একটি গুণ এর নিজস্ব প্রভা। যার ফলে ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যেও পেট্রলিয়াম ঝকমক করে ওঠে।

পাতন প্রক্রিয়ায় এক ধরনের খনিজ তেলে তলানি হিসেবে পড়ে থাকে প্যারাফিন। হালকা রঙের মোম জাতীয় জিনিস এই প্যারাফিন। এইরকম তেলের কদর খুব। কারণ এই তেল পরিশোধন করা বেশ সহজ। পেট্রলিয়ামের উৎপত্তি নিয়ে বিভিন্ন মতবাদ রয়েছে। সবচেয়ে আধুনিক মতবাদটি হচ্ছে সমুদ্রের নিচে পাললিক শিলার ভেতরে আদিম সামুদ্রিক প্রাণি ও উদ্ভিদ থেকে নানা ধরনের রাসায়নিক কান্ডকারখানার ফলে সৃষ্টি হয়েছে খনিজ তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস।

বিজ্ঞানীদের ধারণা প্রাগৈতিহাসিক যুগে পৃথিবীর মহাদেশগুলোর বহু অংশই সমুদ্রের জলের নিচে ডুবে ছিল। বড়-বড় গাছের বিশাল অরণ্য আর অনেক নাম না জানা খুব ছোট-ছোট ডায়াটম, অ্যালগি জাতীয় সামুদ্রিক জীব সমুদ্রের কিনারায় সবার অলক্ষ্যে বেড়ে উঠেছিল। বিশ লাখ থেকে সাড়ে ছয় কোটি বছর আগে টারশিয়ারি যুগে সমুদ্রের নিচে মাটি আর বালি জমে সৃষ্টি হচ্ছিল যে পাললিক শিলা তারই স্তরে-স্তরে সামুদ্রিক প্রাণি বা গাছপালাও ক্রমে জমা পড়তে শুরু করে।

Advertisement

পেট্রলিয়ামের স্বভাব ও গঠনপ্রকৃতি নিয়ে বিজ্ঞানীরা এখন অনেক কিছু জানলেও এখনো পর্যন্ত কারো পক্ষেই ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব নয় ঠিক কোথায় পেট্রলিয়াম পাওয়া যাবে। কারণ মাটির উপরে দাঁড়িয়ে পাতালের গভীরে লুকানো পেট্রলিয়ামের খবর জানা যাবে কী করে? অতীতে মানুষ খনিজ তেলের খোঁজ করত ভূমিতে। যেখানে নিজের চোখে দেখা যেত পাথরের ফাটল চুইয়ে পেট্রলিয়াম রেরিয়ে আসছে, কিংবা খোঁজ করা হতো ঘন বাদামি কালো রঙের বিটুমিন। যা হয়তো পেট্রলিয়ামের তলানি হিসেবে ভূ-পৃষ্ঠের ওপরে পড়ে রয়েছে।

তবে বর্তমানে পেট্রলিয়ামের খনির সন্ধান পাওয়াটা খুবই কষ্টসাধ্য একটা ব্যাপার। পর্বতের কোনো শৃঙ্গ জয়ের মতো পেট্রলিয়াম-অভিযানও একটি রুদ্ধশ্বাস অভিযান। কোথাও তেল অনুসন্ধানকালে সেখানে তেলের অনুসন্ধান মিলবে কী মিলবে না তা নির্ভুলভাবে বলা প্রায় কখনোই সম্ভব নয়। কারণ সেখানে ভাগ্যের হাতও কিছুটা থেকেই যায়।

কোনো অঞ্চলে পেট্রলিয়ামের অনুসন্ধান করতেই প্রায় ২-৩ বছর সময় লেগে যায়। ভূপদার্থ বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন জটিল যন্ত্রপাতির সাহায্যে সমীক্ষা চালিয়ে বুঝতে চেষ্টা করেন ভূ-পৃষ্ঠের নিচে পাথরের স্তরটিতে পেট্রলিয়াম থাকার সম্ভাবনা ঠিক কতটুকু। এই ধরনের সমীক্ষা শেষ হলে সেই অঞ্চলটির ভূ-তাত্ত্বিক মানচিত্র এঁকে ফেলা হয়। তারপর শুরু হয় ড্রিলিংয়ের কাজ।

আধুনিক প্রযুক্তিবিদ্যায় তেলকূপ খননের জন্য লম্বা ইস্পাতের পাইপের সঙ্গে খাঁজকাটা ড্রিলিং বিট লাগানো থাকে। শক্তিশালী মোটরের সাহায্যে ড্রিলিং পাইপকে ঘোরানো হয়। ড্রিলিং পাইপের সঙ্গে ড্রিলিং বিট ঘুরতে-ঘুরতে মাটি ও পাথর কেটে নামতে থাকে পাতালের দিকে। এভাবে কত দূর ড্রিলিং করতে হবে তার নির্দিষ্ট কোনো সীমা নেই। তবে পৃথিবীর দীর্ঘতম ড্রিলিংয়ের দূরত্ব ১০ কিলোমিটারকেও ছাড়িয়ে গেছে। ড্রিলিং শেষ হলে ড্রিলিং পাইপের পরিবর্তে সরু পাইপ প্রবেশ করানো হয়। এই সরু পাইপের সাহায্যেই তেল উত্তোলন করা হয় এবং পাইপের সঙ্গে সংযুক্ত বিভিন্ন ভালবের সাহায্যে তেল উত্তোলনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা হয়।

সমুদ্রের নিচে পেট্রলিয়াম খোঁজার পদ্ধতি অনেকটা স্থলভাগের অনুসন্ধানের মতো হলেও কাজের পদ্ধতিতে কিছুটা অমিল আছে। সমুদ্রের তলায় পেট্রলিয়াম অনুসন্ধানের দায়িত্বটা প্রথমে ডুবুরি ভূ-তাত্ত্বিকদের দেওয়া হয়। ডুবুরিরা পানির নিচের পাথরের নমুনা নিয়ে আসেন এবং দরকারমতো ছবিও তুলে আনেন। এরপর পেট্রলিয়াম পাওয়ার সম্ভাবনা থাকলে অনুসন্ধান শুরু হয়।

সমুদ্রে তেলকূপ খননের কাজ করা হয় ভাসমান প্ল্যাটফর্ম বা পাটাতন থেকে। কোথায় কূপ খনন করতে হবে তা ঠিক হয়ে গেলে, স্থাপন করা হয় ভাসমান পাটাতন এবং এরপরই শুরু হয় ড্রিলিংয়ের কাজ। তবে সমুদ্রের নিচে তেল-অনুসন্ধানের কাজ প্রচুর ব্যয়বহুল। যে পেট্রলিয়াম বা খনিজ তেল তেলকূপ থেকে তোলা হয় তা পরিষ্কার না করে ব্যবহার করা যায় না। কারণ এই কাঁচা খনিজ তেলের সঙ্গে মিশে থাকে হাজাররকমের জিনিস, আলকাতরা, পাথরের টুকরা, গ্যাস ইত্যাদি। পেট্রলিয়ামের মধ্যে যে নানারকম জিনিস আছে তার প্রত্যেকটি আলাদা-আলাদা ব্যবহার আছে। তাই নানা কাজে ব্যবহারের আগে পেট্রলিয়াম শোধন করে নিতে হয়। এই শোধনের কাজ যেখানে করা হয় তার নাম পেট্রলিয়াম রিফাইনারি বা তেলশোধনাগার।

শোধনাগারে খনিজ তেলের বিভিন্ন হাইড্রোকার্বনগুলো আলাদা করা হয় ধাতুর তৈরি লম্বা পাত্রে। এই ধাতুর পাত্র লম্বায় প্রায় ৩০-৪০ মিটার। কাঁচা অপরিশুদ্ধ খনিজ তেল ফুটিয়ে প্রায় গ্যাসীয় অবস্থায় পাইপের সাহায্যে। এই ধাতব পাত্রের মধ্যে চালনা করা হয়। এই পাত্রের মধ্যে তাকের মতো পরপর অনেকগুলো ধাতুর পাত্র সাজানো থাকে। প্রত্যেকটি পাত্রের নিচে কিছু-কিছু ছিদ্র থাকে যাতে নিচের অংশ থেকে খনিজ তেলের গ্যাস বিনা বাধায় স্বচ্ছন্দে ওপরের তাকে চলে যেতে পারে।

এই ধাতুর পাত্রের নিচের স্তরের তাপমাত্রা বেশি (৩০০০ সে.) এবং উপরের স্তরের তাপমাত্রা কম (২০০০ সে.) থাকে। তাপমাত্রার এই পার্থক্যের জন্য নিচের ধাতব পাত্রগুলো জমা হয়। তেলের ভারি অংশ আর ওপরের পাত্রগুলোতে জমা হয় তেলের হালকা অংশগুলো। এভাবে ওপর থেকে নিচের পাত্রগুলোতে পরপর পাওয়া যায় পেট্রল, কেরোসিন, ডিজেল আর বিটুমিন। আলাদা-আলাদা উচ্চতায় রাখা বিভিন্ন পাত্রে পাতনপ্রক্রিয়ায় ঠান্ডা হয়ে জমা পড়লে এসব উপাদান সংগ্রহ করা হয় পাইপের সাহায্যে। এসব উপাদানের মধ্যে পেট্রল, কেরোসিন কিংবা ডিজেল যে রকমারি কাজে লাগে তা তো সবারই জানা।

কেএসকে/এমএস