সুমনা গুপ্তা
Advertisement
‘বাবা’ এমনই এক শব্দ, যা সন্তানের মনে নির্ভরতার পরশ বুলিয়ে দেয়। পৃথিবীতে যদি সত্যি মানবরূপী কোনো বটবৃক্ষ থাকে, যিনি ছায়া দিয়ে তার সন্তানকে আগলে রাখেন; তিনি হলেন বাবা। জীবনের জটিল সময়ে বুকের ছাতি দিয়ে সব ঝড় ঝঞ্ঝাকে যিনি মোকাবিলা করার সাহস জোগান, অনুপ্রেরণা দেন, তিনি বাবা। বাবা মানেই এক বিশালতার নাম, যার বিশালতার কাছে সবকিছু ম্লান হয়ে যায়। বাবা মানেই আশ্রয় আর নির্ভরতার এক নির্ভরযোগ্য আশ্রয়স্থল।
আজ বিশ্ব বাবা দিবস। প্রতিবছর জুন মাসের তৃতীয় রোববার দিবসটি পালন করা হয়। বাবাকে শ্রদ্ধা বা ভালোবাসা জানানোর জন্য কোনো বিশেষ দিবসের দরকার হয় না। তবুও একটি বিশেষ দিনে ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ হয়তো প্রগাঢ় ও অনুভূতিটাকে নতুন মাত্রা দেয়।
শৈশবে যখন আদর্শলিপি পড়া শিখিনি, ঠিক তখন থেকেই বাবার ভরাট কণ্ঠে মদনমোহন তর্কালঙ্কারের ‘আমার পণ’ কবিতাটির উচ্চারণ শুনে জীবনের প্রথম পাঠ শুরু হয়। জীবনে সৎভাবে বেঁচে থাকার মন্ত্র। তখন এতটা না বুঝলেও এটি বুঝতে পারতাম, আমাকে ভালো মানুষ হতে হবে। দরাজ কণ্ঠের সেই পাঠ আর শিক্ষা আমায় পথ চলতে শিক্ষা দেয় নতুন করে। ‘সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি,/সারাদিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি।/আদেশ করেন যাহা মোর গুরুজনে,/আমি যেন সেই কাজ করি ভালো মনে।’
Advertisement
২০১৮ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি আমার বাবা শংকর প্রসাদ গুপ্ত পরলোকগমন করেন। বাবা যতদিন বেঁচে ছিলেন; ততদিন আমাকে মানুষ হওয়ার শিক্ষা দিয়েছেন। তাই আজও নিজেকে নারী নয়, মানুষ ভাবতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। খুব ছোটবেলায় তাই আমার সব বান্ধবী যখন দুই ঝুঁটি বেঁধে স্কুলে যেত, আমি তখন বয়কাটেই মানানসই। বাবা বলতেন, লেখাপড়া করে জ্ঞান অর্জন না করতে পারলে লড়াই করবে কী করে? পায়ের নিচের মাটিটা শক্ত রাখা খুব দরকার। আজ বুঝি, সত্যি পায়ের নিচের মাটি কী! আজ বুঝি, লড়াই করে বেঁচে থাকার মানে কী।
বাবার কাছ থেকে শিখেছি, কীভাবে অন্যায়ের সঙ্গে আপস না করে থেকে মাথা উঁচু করে বাঁচতে হয়। আজও মনে পড়ে বাবার আবৃত্তি করা কাজী নজরুল ইসলামের সেই বিখ্যাত লাইন, ‘গাহি সাম্যের গান/মানুষের চেয়ে বড়ো কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান...।’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘প্রশ্ন’ কবিতার লাইন, ‘ভগবান, তুমি যুগে যুগে দূত পাঠায়েছ বারে বারে/দয়াহীন সংসারে,/ তারা বলে গেল ‘মা করো সবে’, বলে গেল ‘ভালোবাসো’/অন্তর হতে বিদ্বেষবিষ নাশো।’
শৈশবে যদি জীবনের পাঠ হয়তো এভাবেই শেখাতে হয়। আজ এ সময়ে দাঁড়িয়ে মনে হয়, এ জীবনের পথচলার মহামন্ত্রটি যদি বাবা না শেখাতেন, হয়তো জীবনে অনেক আগেই থমকে যেতে হতো। ধর্মীয় ভেদাভেদ নয় বরং মানুষ হওয়ার পাঠই পেয়েছি সব সময়। মাঝে মাঝে এখন ভাবি, এমন করে আমি কি পারব আমার সন্তানকে শেখাতে? ঠিক জানি না। তবে বাবার আদর্শ ধারণ করি।
মনে পড়ে ছোটবেলায় আমার বান্ধবীদের বাবারা স্কুলে গিয়ে খাতা চেক করে দেখতেন তার সন্তানের পরীক্ষার মার্কস ঠিক আছে কি না। আমি অনেকদিন বলতাম, তুমি কেন যাও না? বাবা বলতেন, শিক্ষক তোমার গুরু। বিদ্যা গুরুমুখী। শিক্ষককে সম্মান না করলে শিক্ষা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। কঠিন কথাগুলোর গভীরতা আজ বুঝতে পারি। জীবনের পাঠ এভাবে বাবারাই দিতে পারেন।
Advertisement
বাবা বলতেন, যে গাছ যত ফলবতী, তা মাটির দিকে তত ধাবমান। বিনয়ী মানুষরা হলো এই গাছগুলোর মতন। বিনয় মানুষকে মহৎ করে। যারা প্রকৃত জ্ঞানী তারা বিনয়ী হন, ভদ্র হন। বিনয়কে হৃদয়ে ধারণ করার কথা শেখাতেন। শিক্ষকতা করতেন বলে সারাজীবন সাদা শার্ট পরতেন। বলতেন, সাদা শুভ্রতার প্রতীক। শিক্ষকের কাজ হলো আলো আর শুভ্রতা ছড়ানো। কত ছাত্রছাত্রীর পরীক্ষার ফিস যে নিজের পকেট থেকে দিয়েছেন, তা গুনে বলা সম্ভব নয়।
দেশকে ভালোবাসতেন, মানুষের দুঃখে দুঃখী হতেন বাবা। মুক্তিযুদ্ধ, স্বদেশ আর নিজ মাতৃভূমির প্রতি স্বজাত্যবোধের শিক্ষাটিও বাবাই বপন করেছিলেন। না, কোনো পুঁথিগত শিক্ষায় নয়, গল্প শুনে শুনেই জেনেছি এ দেশটির জন্য আমার পিতৃপুরুষের অবদান। দেশটির প্রতি তাদের আত্মত্যাগের কথা। জেনেছি ‘জননী, জন্মভূমি স্বর্গাদপি গরিয়সী’। কীভাবে আমার বাবা এ দেশের স্বাধিকার আন্দোলনের সঙ্গে, স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ আর বাবা-মায়ের একসঙ্গে অংশগ্রহণ সবকিছুই আমার কাছে জীবন্ত কিংবদন্তি।
মাঝে মাঝে মনে হয়, আমিও একজন মুক্তিযোদ্ধা, চেতনায়, মননে, চিন্তায় এবং বিশ্বাসে। তাই আজও কোথাও মুক্তিযোদ্ধাদের অবমাননা সহ্য করতে পারি না। রক্তের ভেতর আগুন জ্বলে যায়। আজও দেশটিকে ভালোবেসে যারা জীবনের সুখ বিসর্জন দিয়েছেন, তাদের প্রকৃত সম্মান করতে পেরেছি কি?
আজও দেখি বৃদ্ধাশ্রমে কীভাবে অনেক বাবা-মা মানবেতর জীবনযাপন করেন। তাই আসুন মানবিক হই, বাবা যে ছায়ায় সন্তানকে লালন-পালন করেন, শেষ বয়সে তাদের প্রকৃত সম্মানটুকু নিশ্চিত করি। তাদের শ্রদ্ধার সঙ্গে ভালোবাসি, তাদের নির্ভরতার জায়গা হয়ে উঠি। বাবা দিবসে শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা পূর্ণতা পাক, দৃঢ় হোক পরিবারের বন্ধন। পৃথিবীর সব বাবার প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
এসইউ/জেআইএম