সাহিত্য

রাইসুল এইচ চৌধুরীর তিনটি কবিতা

১. এমন একটা সময় ছিল

Advertisement

এমন একটা সময় ছিল, আমার শরীর স্পর্শ করে তুমি বলে দিতে পারতে;আমার বুকের নদীতে কী রকম কষ্টেরা খেলা করছেবুকের বাতাসে অক্সিজেনের মাত্রাটা কতটুকু কমেছে,আমার শরীরের পাঁজরে হতাশার ঘুণ পোকাটা,কত মাত্রায় আমাকে নিরন্তর দংশন করে যাচ্ছে, শরীরের ভাঁজে ভাঁজে হাহাকারের সাইরেনটা কতটা প্রকট;আমাকে স্পর্শ করে অনায়াসে তুমি তা বুঝতে পারতে।

এমন একটা সময় ছিলে, তুমি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলে দিতে পারতে;আমি দিনের পর দিন, মাসের পর মাস বছরের পর বছর দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেগাঁয়ের মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা বুড়ো বটগাছটার মতো কতটা ক্লান্ত, কতোটা পরিশ্রান্ত;নায়ের হাটের বৃদ্ধ কামারের লোহা গরম করার মতো;আমার হৃৎপিণ্ডটা কতটা উষ্ণ, কতটা লাল টকটকে হয়ে গেছে;তোমার অবহেলায়, তোমার অনাদরে,জলজ প্রাণীর মতো জলহীন থাকতে-থাকতে;আমার আঁখিপল্লব কতটা বিরান হয়েছে,তোমার মখমলে চঞ্চুর আঘাতে-আঘাতেক্ষত-বিক্ষত বায়ুকুঠুরি, আমার স্থাবর-অস্থাবর, আমার সকল চাওয়া-পাওয়া দিনে দিনে কতটা বেড়েছে- মুদির দোকানের বাকির খাতায় জমা পড়া হিসেবের মতো।

এমন একটা সময় ছিল, আমার হেঁটে যাওয়া দেখলেই তুমি বুঝতে পারতে;আমার পায়ের আঙুলের ভাঁজে লুকোনো কষ্টগুলো জমতে-জমতেআমার শিড়দাঁড়া বেয়ে কী করে পৌঁছে গেছে মাথার খুলিতে;তারপর মস্তিষ্কের নিউরনগুলোকে ক্ষত-বিক্ষত করে;আমার হৃদয়ের বাম অলিন্দ থেকে রক্ত সঞ্চালন বন্ধ করে দিয়ে,আমাকে কী করে রক্তশূন্য করেছে!

Advertisement

এমন একটা সময় ছিল, আমার শরীরের ঘ্রাণ শুঁকে দিয়ে তুমি নির্দ্ধিধায় বলে দিতে পারতে এ তাবৎ সংসারের সকল লেনাদেনা।

২. বোস কেবিন

নীলিমা, বহুদিন পর আজ বোস কেবিনেচায়ের আড্ডায় মাতোয়ারা বিকেলেমনে পড়ে গেল তোমার চোখের মাঝে বোনা সব স্বপ্নগাথা পরোটার ঝাঁজে কথা হতো চোখের ইশারায় লুকোচুরি প্রেম-প্রেম খেলেছি দু’জনে কী যে অবলীলায়! কথার ছলে ছলে তোমাকে বার বার ছুঁয়ে দেওয়া,এ ছিল আড্ডার ছলে যেন তোমাকে নিবিড় কাছে পাওয়া।

নীলিমা, চায়ের কাপে ঝড় তোলা সেই বোস কেবিনে,ইট-পাথরের দালান আর তোমার স্পর্শমাখা চেয়ারেআজও যেন আমি খুঁজে পাই তোমার সেই মিষ্টি হাতের ছোঁয়া হাতে-হাত রেখে রাত-দিন আড্ডায় কত স্বপ্নের জাল বোনা! হোস্টেল থেকে পালিয়ে তুমি ছুটে আসতে বোস কেবিনেআমি পা বাড়াতাম ঊর্ধ্বশ্বাসে তোমাকে দু’দণ্ড কাছে পেতে।

Advertisement

নীলিমা, বোস কেবিনের চায়ের কাপে কত মানুষ আজও ঝড় তোলে,কত মানুষ স্বপ্ন দেখে আজও তার প্রিয়জনকে নিয়েকত আন্দোলন দানা বেঁধেছে এই বোস কেবিনের টেবিলে, সোহরাওয়ার্দী, সুভাষচন্দ্র বসু, বঙ্গবন্ধু আর ভাসানী কত নামকরা বিখ্যাত মানুষের এখানে পড়েছে পদধূলি।

নীলিমা, আজও কি তোমার মনে পড়ে আমায় কোনো এক রোদেলা দুপুরে; বোস কেবিনের দেওয়ালে দেওয়ালে সাজানো স্মৃতির ভিড়ে,সবকিছু আছে আগেরই মতো তুমি শুধু হলে পরবাসী কংক্রিটের এই নিয়ন শহরে নীলিমা, তোমায় আজও খুঁজে ফিরি।

৩. জানে অন্তর্যামী

মেঘবালিকা, কতটা ভালোবাসি তোকেআমার হাত জানে, হাতের আঙুল জানে,আঙুলের নখ জানে,জানে আপাদমস্তক। চোখের দৃষ্টি, চোখের পাতাচোখের পাপড়ি চোখের কাজল জানেকতটা ভালোবাসি তোকে।

মেঘবালিকা, এ বুকের হৃৎপিণ্ড জানেহৃৎস্পন্দন জানেজানে বায়ুকুঠরি আমার অলিন্দ-নিলয় জানেজানে শিরা-উপশিরা ধমনী-মহাধমনী জানেকতটা ভালোবাসি তোকে।

মেঘবালিকা, আমার লোহিত রক্তকণিকারক্তের হিমোগ্লোবিন জানেজানে অনুচক্রিকা, শ্বেত রক্তকণিকাআমার নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস জানেকতটা ভালোবাসি তোকে।

মেঘবালিকা, আমার বুকের প্রতিটি পাঁজর জানেজানে মস্তিষ্ক, আমার পা জানেজানে পায়ের আঙুল আঙুলের নখকতটা পথ আমি পাড়ি দিয়েছিশুধু তোকে ভালোবাসি বলে।

এসইউ/