সাহিত্য

আমাদের মুনতাসীর মামুন

ড. চৌধুরী শহীদ কাদের

Advertisement

৪ মার্চ ২০১৩ সাল; ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি শ্রী প্রণব মুখার্জিকে বঙ্গভবনে নৈশভোজের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন বাংলাদেশের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান। অতিথিদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি; মুনতাসীর মামুনের সামনে আসতেই বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হেসে বললেন ‘এই যে, আমাদের মুনতাসীর মামুন’। প্রণব মুখার্জিও হেসে বললেন, ‘মুনতাসীর মামুনকে আমি চিনি।’ মুনতাসীর মামুন কোভিড আক্রান্ত, উদ্বিগ্ন সারাদেশ। চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়েছেন স্বয়ং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেশের নানা প্রান্ত থেকে উদ্বিগ্ন মানুষের ফোন, ‘আমাদের স্যার কেমন আছেন?’

রাষ্ট্রপতি থেকে সাধারণ মানুষ একটিই শব্দ ব্যবহার করেন ‘আমাদের’। মুনতাসীর মামুন এখন বাংলাদেশের সবার। পরিবার, বন্ধু-বান্ধব, ছাত্র-ছাত্রী একক কারও নয়, তিনি সবার। তিনি শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের নন, সব বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ছাত্রের শিক্ষক। বাংলাদেশে আর কোনো লেখক বা গবেষক ‘আমাদের’ বলে পরিচিত হননি, রবীন্দ্রনাথ যেমন বলেছিলেন, ‘এই হোক মোর পরিচয়, আমি তোমাদেরই লোক’।

তিনিই একমাত্র ইতিহাসবিদ যিনি ইতিহাসকে জনমানসে প্রতিষ্ঠা করার জন্য চার দশক ধরে কাজ করে চলেছেন। ইতিহাসকে নিয়ে গেছেন সাধারণ মানুষের কাছে। ইতিহাস বিষয়ে এমন অবদান রাখার ইতিহাসই অধ্যাপক মামুনকে এই ‘আমাদের’ আসনে বসিয়েছে। মুনতাসীর মামুনের আজ পরিচয় দাঁড়িয়ে গেছে ইতিহাসবিদ হিসেবে। সেখানেও নানা পর্যায় আছে। কেউ কেউ জানেন তিনিই প্রথম পূর্ববঙ্গের সামাজিক সাংস্কৃতিক ইতিহাস তুলে ধরছেন, যা আগে কারও জানা ছিল না। অনেকের কাছে তিনি ঢাকা বিশারদ। তার আগে ঢাকা নগর নিয়ে এতো নিবিড়ভাবে কেউ ইতিহাসচর্চা করেননি।

Advertisement

কবি শামসুর রাহমানের মতো লোক দ্বিধাহীনভাবে বললেন, ‘আমি তাঁর লেখার অনুরক্ত পাঠক। শুধু ঢাকার ইতিহাস মুনতাসীর মামুনকে বাঁচিয়ে রাখবে যতদিন ঢাকা নগরীর অস্তিত্ব থাকবে।’ একজন লেখকের এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কী হতে পারে।

মুনতাসীর মামুন লেখক হিসেবে প্রথম যাত্রা শুরু করেন শিশু সাহিত্যিক হিসেবে। ১৯৬৩ সালে সারা পাকিস্তানে বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ শিশুলেখক হিসেবে প্রেসিডেন্টের স্বর্ণ পদক পান। বলা হয় শাহরিয়ার কবির, আলী ইমাম এবং তিনি বাংলাদেশের শিশুসাহিত্যে আধুনিকতার সূত্রপাত করেছেন। টিনএজারদের নিয়ে তাঁর শ্রেষ্ঠ উপন্যাস জয় বাংলা এখন চলচ্চিত্রায়িত হচ্ছে।

সাহিত্যের প্রতিটি শাখায় তার প্রদচারণা রয়েছে অতুলনীয়, তিনি গল্পকার, জনপ্রিয় রাজনৈতিক ভাষ্যকার, অনুবাদক, শিল্প সমালোচক, মননশীল প্রবন্ধক এবং দেশের অন্যতম শিশুসাহিত্যিকদের মধ্যে একজন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় সাড়ে চার দশক শিক্ষকতা করেছেন, দায়িত্ব পালন করেছেন বঙ্গবন্ধু চেয়ারের। সময়ের প্রয়োজনে সিভিল সমাজ প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে অনন্য ভূমিকা রেখেছেন।

মূলত ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম, কলমে ও রাজপথে নানা প্লাটফর্মে কাজ করে যাওয়াই একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে সাধারণ মানুষের কণ্ঠস্বরে পরিণত করেছে। পেয়েছেন অগণিত মানুষের ভালোবাসা এবং সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পদকসহ একাধিক স্বীকৃতি। বর্তমানে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু অধ্যাপক হিসেবে কাজ করছেন।

Advertisement

সাধারণের মানসজগতে কেউ তাকে বসিয়ে দেয়নি। মুনতাসীর মামুন সযত্নে সাধারণের হৃদয়ে এই জায়গাটি তৈরি করে নিয়েছেন নিজের কর্মে। যুদ্ধাপরাধ বিচার আন্দোলনে নেতৃত্বের ভূমিকায় থাকা তাঁর পরিচিতির আরেকটি বড় কারণ। বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধ বিচার আন্দোলন ও শাহরিয়ার কবির, মুনতাসীর মামুন প্রায় সমার্থক শব্দে পরিণত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যে অন্যতম সক্রিয় নাম হচ্ছে মুনতাসীর মামুন। স্বৈরাচারী এরশাদ শাসন থেকে বর্তমান ধারাবাহিক ভাবে লিখে গেছেন পত্র-পত্রিকায়। ঐতিহাসিক ও সমসাময়িক পরিস্থিতি বিশ্লেষণে তার ক্ষুরধার কলমের তুলনা পাওয়া ভার।

নিজের মত প্রকাশে, স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান নিতে তিনি কখনো দ্বিধা করেননি। প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর হুমকি ও আক্রমণ তার কলমের কালিকে কখনো পরাস্থ করতে পারেনি। উল্টো তার কলমের শক্তির কাছে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি পরাজিত হতে বাধ্য হয়েছে বারবার। তার লিখিত ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা সাড়ে তিনশ ছাড়িয়েছে। এখনো তার কলম সজীব ও সক্রিয়।

ছাত্রাবস্থায় সাংবাদিক হিসেবে পেশাগত জীবন শুরু করেন তৎকালীন বিখ্যাত দৈনিক বাংলা-বিচিত্রায়। এক সময় শাহাদত চৌধুরী, শাহরিয়ার কবির, মাহফুজউল্লাহ ও তিনি মিলে বিচিত্রা শুরু করেন। বিচিত্রার মতো এত জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী পত্রিকা আর বেরুইনি বাংলাদেশে।

স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস, আমাদের সংগ্রামের ইতিহাস মুনতাসীর মামুন জীবন্ত করেছেন নতুন প্রজন্মের কাছে। আলবদর, শান্তিকমিটি, রাজাকার কিংবা পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তাদের বয়ানে তুলে ধরেছেন মুক্তিযুদ্ধের ভিন্ন বয়ান। কয়েক প্রজন্মের মনোজগতে পরিবর্তনে সহায়তা করেছেন। একেবারে সাধারণ মানুষ জানেন তিনি তাদের কথা লেখেন রাজনৈতিক ভাষ্যে।

৬ জানুয়ারি ২০২০, সৌজন্য সাক্ষাতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে উপস্থিত গণহত্যা জাদুঘরের ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি ড. মুনতাসীর মামুন, সহ-সভাপতি শিল্পী হাশেম খান, ট্রাস্টি কবি তারিক সুজাত ও ট্রাস্টি সম্পাদক ড. চৌধুরী শহীদ কাদের

তাঁর বৈশিষ্ট্য আজীবন তিনি বাংলাভাষায় ইতিহাস চর্চা করেছেন। কলকাতা, দিল্লি এবং ঢাকা থেকে বেরিয়েছে সে সব বইয়ের ইংরেজি অনুবাদ। শুধু অতীত ইতিহাস নয় সমসাময়িক সময়ের ইতিহাসও তিনি লিখেছেন। নিজ দেশের ইতিহাসের খোঁজ একধরনের শেকড় সন্ধান। তিনি একাজটি করেছেন।

তিনি সংগঠন করেছেন নানারকম, লেখক ইউনিয়ন থেকে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, ঢাকানগর জাদুঘর থেকে গণহত্যা জাদুঘর, চিত্রকলা ও পুরনো সম্পদ, পুতুল, মুদ্রার সংগ্রহ তাঁর ঈর্ষণীয়। তাঁর এই সংগ্রহে সাহায্য করেছেন হাশেম খান।

কীর্তিমান মুনতাসীর মামুনের জন্ম চাঁদপুরের কচুয়ায়। তার বাবা ঐতিহাসিক মেসবাহউদ্দিন খান ছিলেন এই এলাকার সংসদ সদস্য, তিনি আজ শায়িত আছেন চির শান্তিতে। বর্তমান সংসদ সদস্য তার চাচা ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর। সারাদেশের মানুষের মতো নিজ গ্রামের মানুষও তাকে প্রাণের চেয়ে বেশি ভালোবাসেন, শ্রদ্ধা করেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী ফাতেমা মামুনের সাথে পাঁচ দশকের সংসার জীবন। দুই পুত্র, এক কন্যা, দুই নাতি, তিন নাতনি নিয়ে অধ্যাপক মামুনের ছবির মতো সুন্দর পারিবারিক জীবন। সময়ে অনেকেই খ্যাতি পান বর্তমানে, হারিয়েও যান। ১৯৭২ সালে যখন তিনি ডাকসুর প্রথম সম্পাদক ও সংস্কৃতি সংসদের সভাপতি হন সেদিন থেকেই তিনি খ্যাতির সিঁড়িতে পা রাখেন।

একাত্তরে অবরুদ্ধ এদেশের মানুষ যা করেছেন তিনিও তাই করেছেন, মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ শব্দটি জিয়াউর রহমান, হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ, খালেদা জিয়া ও মতিউর রহমান নিজামী যখন নির্বাসনে পাঠিয়েছিলেন তখন মুনতাসীর মামুন, শাহরিয়ার কবির এ শব্দটি আমাদের কণ্ঠে ফিরিয়ে এনেছিলেন। তারা যুদ্ধাপরাধীর বিচার করতে আন্দোলন করেছেন, জাতীয় গণহত্যা দিবস পালনে আন্দোলন করেছেন এবং লিখেছেন। অন্তত দুটি প্রজন্মকে মুনতাসীর মামুনের লেখা ও কর্ম অনুপ্রাণিত করেছে।

নব্বইয়ের দশকে মুনতাসীর মামুনের কলমকে অবলম্বন করে দৃঢ় ভিত্তি পায় যুদ্ধাপরাধ বিচার আন্দোলন। রাষ্ট্রযন্ত্রে স্বাধীনতাবিরোধীদের পুনর্বাসন, ইতিহাস বিকৃতি, সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা মুনতাসীর মামুনের কলম হয়ে ওঠে মুক্তির ভাষা। কখনো কলম হাতে, কখনো রাজপথে মুনতাসীর মামুনের উচ্চকিত সুর। সাধারণ মানুষের প্রতিবাদ পেল ভাষা। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন মুনতাসীর মামুনকে নতুন মাত্রায় চিনিয়েছে পাঠক মহলে। স্বৈরাচারী শাসনের প্রতিবাদে মুনতাসীর মামুনের কলম ছিল বিপ্লবী প্রতিবাদ। একতা, আজকের কাগজ, দৈনিক জনকণ্ঠ কিংবা ভোরের কাগজের রাজনৈতিক ভাষ্যকার মুনতাসীর মামুন হয়ে ওঠলেন প্রতীকী প্রতিবাদী চরিত্র। তাঁর উপ-সম্পাদকীয়ের শিরোনাম পরিণত হলো প্রবাদে। কিন্তু ২০০২-২০০১ সালে মুনতাসীর মামুনকে হাস্যকর অভিযোগে নেওয়া হয় কারাগারে। রিমান্ডে নিয়ে গিয়ে করা হলো ভয়াবহ নির্যাতন। সাধারণ মানুষ রাস্তায় নামে এর প্রতিবাদে।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চা অনেকেই করেছেন, কিন্তু মুনতাসীর মামুন মুক্তিযুদ্ধ চর্চায়- গবেষণায় সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিলেন গণহত্যাকে। ভিন্ন মহিমায় বাঙালির ত্যাগের ইতিহাসকে তিনি জনমানসে তুলে ধরেছেন। উদ্যোগ নিয়েছেন স্মৃতি সংরক্ষণের। জনমতকে প্রাধান্য দিয়ে চার দশক ধরে লিখে যাওয়া এবং চার দশক ধরে পাঠকপ্রিয় থাকা খুব স্বাভাবিক বিষয় নয়। একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের পক্ষে এটা নিতান্তই কঠিন। কিন্তু অন্তিমে মুনতাসীর মামুন সেই অসম্ভবকেই সম্ভব করলেন। ‘তুমি তো আমাদেরই লোক’ এটাই হয়ে পড়ে প্রতিষ্ঠিত সত্য।

মুনতাসীর মামুন কেবল স্বপ্নই দেখেননি, সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার জন্য সারাজীবন লড়াই করেছেন। তিনি একজন প্রকৃত শিক্ষক, প্রকৃত জ্ঞানের পূর্ব সাধক। তিনি তার স্বপ্নকে একদল স্বপ্নবাজ তরুণদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন। জ্ঞানের পূর্ব-সাধক হিসেবে তিনি গড়ে তুলতে সচেষ্ট হয়েছেন জ্ঞানের উত্তর সাধকদের। মুনতাসীর মামুন কেবল একা জ্ঞান চর্চা করেননি, তিনি করেছেন যৌথভাবে, সমষ্ঠিগতভাবে। তিনি দেখিয়েছেন জ্ঞান-চর্চা আদতে সামষ্টিক ক্রিয়া। এভাবেই তিনি ‘আমাদের’ হয়েছেন।

বাংলাদেশের ইতিহাসবিদ বললেই নাম আসে মুনতাসীর মামুনের। সাহিত্য, সংগঠন, আন্দোলন, প্রতিষ্ঠান গড়া সব মিলিয়ে তিনি নিজেই এখন একটি প্রতিষ্ঠান, বাংলাদেশের অন্যতম জনবুদ্ধিজীবী, যিনি বিরোধীদের সামনে দাঁড়িয়ে চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারেন।

প্রগতিশীল চিন্তা ও চেতনার বিকাশে মুনতাসীর মামুনের অবদান অসামান্য। যতদিন বাঙালি জাতি এবং বাংলাদেশ থাকবে ততদিন তার কর্মের মাঝে এক জ্বলজ্বলে তারকা হয়ে থাকবে কীর্তিমান মানুষ আমাদের মুনতাসীর মামুন। আজ আমাদের সময়ের সবচেয়ে সাহসী মানুষটির জন্মদিন। জন্মদিনের শুভেচ্ছা প্রিয় মুনতাসীর মামুন।

লেখক: সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ইতিহাস সম্মিলনী।

এইচআর/জিকেএস