সাইফুর রহমান তুহিন
Advertisement
পর্যটকদের উপস্থিতি বিবেচনায় কক্সবাজার যে বাংলাদেশের সেরা পর্যটনকেন্দ্র, তা নিয়ে কারো দ্বিমত থাকার কথা নয়। দেশি-বিদেশি পর্যটকের পদচারণায় সারাবছর মুখরিত থাকে জায়গাটি। কক্সবাজার জেলারই আরেকটি আকর্ষণীয় স্থান হলো মহেশখালী দ্বীপ। আপনার কক্সবাজার ভ্রমণের আনন্দ দ্বিগুণ হতে পারে যদি আপনি মহেশখালীর সোনাদিয়া দ্বীপকে সফরসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করেন।
কক্সবাজার থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে মহেশখালীর অবস্থান। সোনাদিয়া দ্বীপের অবস্থান কক্সবাজার থেকে উত্তর-পশ্চিমে এবং মহেশখালী থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে। মহেশখালী থেকে সোনাদিয়া আলাদা হয়েছে একটি খালের মাধ্যমে। মহেশখালী থেকে সোনাদিয়ার দূরত্ব ৭ কিলোমিটার। মহেশখালী উপজেলার কুতুবজোম ইউনিয়নে দ্বীপটি অবস্থিত। এর মোট আয়তন ৯ বর্গকিলোমিটার। এটি উপকূলীয় ও ম্যানগ্রোভ বনভূমি দ্বারা গঠিত। বঙ্গোপসাগরের নীল পানি, লাল কাঁকড়া, কেয়া বন ও সামুদ্রিক পাখির সমন্বয়ে সোনাদিয়া দ্বীপে সব সময় এক রোমাঞ্চকর পরিবেশ বিরাজ করে।
যখন আপনি মহেশখালী থেকে সোনাদিয়া দ্বীপে যাত্রা করবেন; তখন আশপাশে তাকালে মনে হবে যেন সবকিছুই কোনো বিখ্যাত শিল্পীর নিপুণ তুলিতে আঁকা। এই চমৎকার অনুভূতির কথা সহজে ভুলতে পারবেন না আপনি। যে খালের ওপর দিয়ে যাবেন তার পানি ভীষণ স্বচ্ছ হওয়ায় আপনার মনে হতে পারে যে, আপনার বোটটি বুঝি কাঁচের ওপর দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। এসব চিত্তাকর্ষক দৃশ্য আপনাকে এক নিশ্বাসে মুক্তি দিতে পারে নাগরিক জীবনের সব একঘেয়েমি থেকে। যে খাল অতিক্রম করে সাগরে যাবেন সেটি সৃষ্টি হয়েছে সাগর থেকে এবং অনেক শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে তা দ্বীপটির অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছে। খালটির দুই তীর ঘন সবুজ অরণ্যে আচ্ছাদিত। দ্বীপে কেওড়া, হারগোজা, উড়িঘাস এবং কালো ও সাদা বাইন গাছ চোখে পড়ে।
Advertisement
যদিও সোনাদিয়া দ্বীপের কাঠামো অনেকটা সেন্টমার্টিনের মতোই। তবে সেন্টমার্টিনের মতো তেমন কোনো জনবসতি এই দ্বীপে এখনো গড়ে ওঠেনি। এখানকার বেশিরভাগ অধিবাসীই জেলে এবং সামান্য লবণ চাষিও রয়েছে। এখানে জনসংখ্যা কম হওয়ার কারণ হচ্ছে জীবনযাত্রার নিম্নমান। পণ্যদ্রব্য কেনাবেচার জন্য কোনো বাজারই এখন পর্যন্ত গড়ে ওঠেনি সেখানে। মানুষ এখনো ছোট ছোট দোকানের ওপর নির্ভরশীল। সোনাদিয়া দ্বীপের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ এখানকার স্থানীয় চা। এমনিতে খুবই সাধারণ হলেও সুস্বাদু এই চা একবার পান করলে এর স্বাদ সহজে ভুলতে পারবেন না আপনি।
সোনাদিয়া দ্বীপের পশ্চিমাংশ বেশ খোলামেলা। এ অংশে এখনো কোনো জনবসতি নেই। অনেকটা কার্পেটের মতো মসৃণ ঘাসে ঢাকা মাঠ, নির্জনতা ও তাজা বাতাস—সবকিছু আপনাকে দেবে এক অপার্থিব সুখের অনুভূতি। মনে হবে যেন সিনেমার কোনো দৃশ্য দেখছেন। অনেক পর্যটকের বিবেচনায় সোনাদিয়া দ্বীপের সৌন্দর্য সেন্টমার্টিন দ্বীপের চেয়ে এগিয়ে। দ্বীপটির কিছু অংশে তরমুজের চাষ হয়। তরমুজ চাষের মৌসুমে বেড়াতে গেলে এর লোভনীয় স্বাদ হবে আপনার জন্য বাড়তি পাওনা। দ্বীপে পর্যটকদের জন্য একটি কচ্ছপের হ্যাচারি রয়েছে। ডিম সংগ্রহ ও সংরক্ষণের পর কচ্ছপের ছোট ছোট বাচ্চা সমুদ্রে ছেড়ে দেওয়া হয়।
কীভাবে যাবেনসোনাদিয়া দ্বীপে যেতে হলে আগে আপনাকে কক্সবাজার যেতে হবে। দেশের যে কোনো শীর্ষস্থানীয় বাস স্টেশনে কক্সবাজার যাওয়ার বাস পাওয়া যাবে। যদি তা না-ও পান, তাহলে চট্টগ্রামের বাস পাবেন এবং চট্টগ্রাম হয়ে আপনাকে কক্সবাজার পৌঁছতে হবে। এরপর মহেশখালী যাওয়ার জন্য কস্তুরী ঘাট থেকে ভাড়া করতে হবে স্পিডবোট অথবা ইঞ্জিন বোট। মহেশখালীর ঘটিভাঙ্গা থেকে গোরকঘাটা পর্যন্ত ২৪ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হবে সিএনজি অটোরিকশায় করে। এরপর ইঞ্জিন বোটে সোনাদিয়া যেতে হবে। ঘটিভাঙ্গায় পৌঁছার পর খেয়া নৌকায় করে সোনাদিয়া চ্যানেল অতিক্রম করতে হবে। কক্সবাজার থেকে সরাসরি স্পিডবোটে করেও সোনাদিয়া যেতে পারেন। যদিও এতে কিছুটা বাড়তি অর্থ ব্যয় হবে, তারপরও রুটটি অনেক আরামদায়ক এবং রোমাঞ্চকরও বটে। এখানে ভ্রমণের জন্য নভেম্বর থেকে ফেব্রয়ারি হচ্ছে আদর্শ সময়।
থাকা-খাওয়াসোনাদিয়া দ্বীপে পর্যটকদের জন্য কোনো আবাসিক ব্যবস্থা এখনো গড়ে ওঠেনি। এমনকি ভালো মানের কোনো রেস্টুরেন্টও নেই। তবে এখানকার স্থানীয় লোকজন বেশ বন্ধুবৎসল এবং টাকা দিলে তারাই আপনার খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করবে। এমনকি ‘পেইং গেস্ট’ হিসেবে থাকতেও পারবেন তাদের সাথে। এসব দিক বিবেচনায় রেখে সবচেয়ে ভালো হবে খুব সকালে কক্সবাজার থেকে সোনাদিয়া যাওয়া এবং সন্ধ্যার মধ্যে আবার কক্সবাজার ফেরা। তবে রাতে না থাকলে আপনি নিশ্চিতভাবেই এখানকার নয়নাভিরাম সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত ও জোছনা রাত মিস করবেন। শুধু তা-ই নয়, শেষ বিকেলে বকের পালের ওড়াউড়িও দেখার সুযোগ মিলবে না। তাই সত্যিকারের অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমীদের উচিত হবে একটু কষ্ট স্বীকার করে হলেও অন্তত একটি রাত সোনাদিয়ায় কাটানো। আর কে জানে, সেই রাত হয়ে যেতে পারে আপনার জীবনের সেরা রাতগুলোর একটি।
Advertisement
লেখক: ভ্রমণপিপাসু
এসইউ/জিকেএস