আমাদের দেশের বৃহত্তম বিল চলনবিল। দেশের উত্তর জনপদের এক সেরা প্রাকৃতিক সম্পদ এটি। বিলটি রাজশাহী, নটোর, পাবনা ও সিরাজগঞ্জের এলাকাজুড়ে বিস্তীর্ণ। দেশের সর্ববৃহৎ এই বিলটি একসময় বছরের নয় মাস ডুবে থাকত। রূপ ধারণ করত সমুদ্রের মতো। পলি জমে জমে চলন বিল এখন আগের মতো নেউ। চলন তার বিশাল জলরাশির ঐতিহ্য হারিয়েছে। চলনবিলের তলা উন্মোচিত হয়েছে।
Advertisement
এখন চলনবিলের বুকজুড়ে রবি মৌসুমে চাষ হচ্ছে হাজার হাজার বিঘা জমিতে সরিষা। সেই সরিষা ফুল থেকে আহরিত হচ্ছে অনন্য সম্পদ মধু। এবছরও প্রায় ২০০০ হাজার মেট্রিক টন (২০ লাখ কেজি) মধু উৎপাদিত হবে বলে আশা করছেন মধু সংগ্রহকারীরা। প্রতি কেজি মধু প্রায় ২০০ টাকা দরে বিক্রি হয়। এ হিসেবে এর বাজার মূল্য প্রায় ৪০ কোটি টাকা।
চলনবিলে প্রায় এক হাজার মৌচাষি মধু সংগ্রহে এসেছেন। আর এসব মৌচাষির সাথে শ্রমিক-কর্মচারি রয়েছেন আরো তিন-চার হাজার জন। কৃষি বিভাগ বলছে চলনবিলে মৌচাষিরা মধু সংগ্রহ করে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন অন্যদিকে পরাগায়ন ভালো হওয়ায় সরিষারর ফলনও বাড়ছে। ব্যবসায়ি সংগঠনের নেতারা বলছেন মৌচাষিদের সমিতির মাধ্যমে মধু বিক্রির বাধ্যবাধকতা তুলে দিলে তারা আরও ভালো দাম পাবেন। প্রতি বছরই অগ্রহায়ণ-পৌষ-মাঘ মাসজুড়ে চলনবিলের মাঠগুলো সরিষা ফুলে ফুলে ভরে যায়। মনে হয় যেন বিশাল হলুদ চাদর বা হলুদের সমুদ্র। সময় দেশের বিভিন্ন এলাকার মৌ খামারিরা চলনবিলের সরিষার ক্ষেতে আসেন মধু সংগ্রহের জন্য।
এবছরও প্রায় এক হাজার খামারি চলনবিল এলাকার সরিষা ক্ষেতে মৌ বাক্স স্থাপন করেছেন। এলাকার মৌচাকের মৌমাছিসহ খামারিদের পালন করা মৌমাছিরা সরিষা ফুলে-ফুলে ছুটে মধু সংগ্রহে ব্যস্ত সময় পার করছে। এক সময়ের মৎসভান্ডার খ্যাত চলনবিল এখন যেন ‘মধু’র বিলে পরিণত হয়েছে।
Advertisement
মৌচাষি সমিতির সূত্রে জানা যায়, এবারও কুষ্টিয়া, চাপাই নবাবগঞ্জ, বগুড়া, যশোর, ঝিনাইদহ, খুলনা, সাতক্ষীরা, পাবনা, নাটোর ও সিরাজগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন জেলার ৮৬৯ জন মৌচাষি মধু সংগ্রহের জন্য চলনবিলের সরিষা ক্ষেতের পাশে ৮৮ হাজার ৪৩২ মৌ বাক্স বসিয়েছেন। তাদের হিসেবের বাইরেও আরও কিছু মৌ বাক্স স্থাপতি হয়েছে বলে জানা গেছে। চলতি মৌসুমে এ অঞ্চল থেকে প্রায় ৪০ কোটি টাকার মধু সংগ্রহ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
চলনবিল কেন্দ্রিক পাবনা, সিরাজগঞ্জ, নাটোর কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে চলনবিলের ১৩ উপজেলায় ১ লাখ ২০ হাজার হেক্টর জমিতে উচ্চ ফলনশীলসহ বিভিন্ন জাতের সরষের চাষ হয়েছে। ফলনও ভালো হবে বলে কৃষি বিভাগ আশা করছে।
পাবনা জেলা ও উত্তরবঙ্গ মৌচাষি সমিতির সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘চলতি মৌসুমে চলনবিল অঞ্চল থেকে ২ হাজার মেট্রিক টনেরও বেশি মধু পাওয়া যাবে। যার বাজার মূল্য প্রায় ৪০ কোটি টাকা। তিনি জানান, ব্যক্তিগতভাবে তার মোট ৫০টি মৌ বাক্স রয়েছে।
সংগৃহীত এসব মধু পাইকারি প্রায় ২০০ কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। গতবারের চেয়ে এবার মধুর দাম বেশি। ফলে মধু সংগ্রহকারীরা ভালো দাম পাবেন বলে তিনি জানান। উত্তরবঙ্গ মৌচাষি সমিতির সাধারণ সম্পাদক আহাদ আলী জানান, তিনি ১০০টি মৌ বাক্স স্থাপন করেছেন। এ থেকে প্রতি সপ্তাহে মধু উৎপাদন হচ্ছে প্রায় ২ মণ।
Advertisement
চাটমোহর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ এএ মাসুম বিল্লাহ জানান, কৃষি বিভাগও মধু সংগ্রহের বাক্স প্রদান করেছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে চলতি মৌসুমে চলনবিলের সরিষা ফুল থেকে বাণিজ্যিকভাবে এবং বিভিন্ন গাছ-পালায় প্রাকৃতিকভাবে তৈরি মৌচাক থেকে প্রায় ২০০০ মেট্রিক টন মধু সংগৃহীত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
ভাঙ্গুড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ এনামুল হক জানান, সরিষা একটি আগাম ফসল। এ উপজেলায় এবার বন্যার পানি দ্রুত নেমে যাওয়ায় কৃষকেরা সরিষা চাষ করেছেন। এরপর একই জমিতে ইরি-বোরো আবাদ হবে। এবছর কৃষকদেরকে সরিষা চাষে ব্যাপক সচেতন করা হয়েছে। কৃষি প্রণোদনা দেয়া হয়েছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় চলতি মৌসুমে সরিষার বাম্পার ফলনের সম্ভাবনা রয়েছে।
চলনবিল পাড়ের আলাইপুর গ্রামের কৃষক সুশান্ত কুমার শান্ত বলেন, এবছর তিনি ৭৫ বিঘা জমিতে সরিষা চাষ করেছেন। প্রতি বিঘায় আট থেকে নয় মণ সরষের ফলন পাওয়ার আশা করছেন। সরিষা চাষে প্রতি বিঘা থেকে ২০ হাজার থেকে ২৪ হাজার টাকা লাভ হবে বল তার আশা।
তিনিও মৌ বাক্স স্থাপন করে মধু সংগ্রহ করছেন বলে জানান। চলনবিল পাড়ের দলগাসা গ্রামের আরেক কৃষক মনিরুজ্জামান বলেন, সরিষা চাষ খুবই লাভজনক। তিনি এবছর বারি-১৪ জাতের সরিষা চাষ করেছেন। তার ক্ষেতেও বসেছে মৌ বাক্স। এতে সরিষা ফলন ভালো হওয়ার আশা করছেন তিনি।
চলনবিলের বিভন্ন মাঠে গিয়ে দেখা যায়, দেশের বিভিন্ন স্থান চলনবিলে থেকে আসা মধু আহরণকারীরা মৌমাছি পালন ও মধু আহরণে ব্যস্ত সময় পার করছেন। মধু সংগ্রহকারী ইয়াসিন কবির গোপালগঞ্জ থেকে এসেছেন চলনবিলে।
তিনি সিরাজগঞ্জ জেলার কামারখন্দ উপজেলার রসুলপুরে যাওয়ার পথে এ প্রতিনিধিকে জানান, এবার তিনি ১০০টি মধুর বাক্স স্থাপন করেছেন। গত বছর স্থাপন করেছিলেন ৮৮টি বাক্স। সমিতিতে গতবারে আবেদনের ভিত্তিতে এবার ১২টি বাক্স বেশি স্থাপনের অনুমতি পেয়েছেন। সমিতির মাধ্যমে তাকেও নির্ধারিত দরে মধু বিক্রি করতে হচ্ছে বলে তিনি জানান।
চলনবিলে মৌ বাক্স স্থাপনকারী ছুরমান আলী জানান, তিনি ৩০০টি মৌ বাক্স স্থাপন করেছেন এবং সপ্তাহে ৬ মণ মধু আহরণ করতে পারছেন। তিনি বলেন, অনেকেই মধু কিনতে মাঠে আসছেন।
তিনি আরও বলেন, কয়েকদিন আগের ঘন কুয়াশা ও বৃষ্টির কারণে অনেক মৌমাছি মারা গেছে। মৌমাছি মারা যাওয়ায় তিনি আশানুরূপ মধু উৎপাদন করতে পারবেন কিনা তা নিয়ে চিন্তিত। মধু চাষি সমিতির সদস্য আবদুর রশীদ জানান, তারা সরকারি বা বেসরকারি কোনো আর্থিক সহায়তা পান না। তাই গ্রামের ঋণদাতাদের কাছ থেকে উচ্চ হারে ঋণ নিয়ে ব্যয় নির্বাহ করতে হয়।
সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার বড়ভেটখালী গ্রামের মৌখামারী ইমদাদ হোসেন চলনবিলে এসেছেন সরিষার মধু সংগ্রহে। পাবনার চাটমোহর উপজেলার নিমাইচড়া মাঠের সরিষা ক্ষেতে ১৮০টি মৌ বাক্স স্থাপন করেছেন। প্রতি সপ্তাহে অন্তত একবার করে মধু সংগ্রহ করেন। প্রায় দুমাস ধরে তিনি চলনবিলে মধু সংগ্রহ করেন বলে জানান। এ দুই মাসে ছয় থেকে সাতবার মধু সংগ্রহ করতে পারেন।
এক এক বারে ৪-৫ মণ মধু পাওয়া যায় বলে তিনি জানান। তিনি এ মৌসুমে প্রায় ৫০ থেকে ৬০ মণ মধু পাবেন বলে আশা করছেন। তিনি জানান বর্তমানে প্রতি মণ মধুর পাইকারি দাম প্রায় ৮০০০ টাকা।
পাবনা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি সাইফুল ইসলাম স্বপন চৌধুরী বলেন, সরিষা চাষ ও মধু আহরণ একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র। বিশেষ করে চলনবিলে সরিষা আবাদের সময় শত শত টন মধু পাওয়া যায়। সরিষা ফুলের মৌসুমে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মধু আহরণকারীরা চলনবিলে আসেন মধু সংগ্রহের জন্য।
তারা সেখানে সমিতির পক্ষ থেকে বণ্টনকৃত এলাকায় বাক্স স্থাপন করে মধু সংগ্রহ করে থাকেন। সেই মধু ওই সমিতির কাছেই তারা বিক্রি করতে বাধ্য। ফলে মধু সংগ্রহকারীরা মধুর দাম বেশি পাওয়া থেকে বঞ্চিত হন। এছাড়া সরকারের কোনো নীতিমালা না থাকায় সরকার এ খাত থেকে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাই রাজস্ব আয়ের সম্ভাবনাকে সামনে রেখে সরকারকে এ খাতটিকে পৃষ্ঠপোষকতা করা উচিত।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) পাবনার উপ-পরিচালক মিজানুর রহমান জানান, চলনবিল ঘিরে পাবনা, নাটোর, সিরাজগঞ্জ জেলার ১৩টি উপজেলা রয়েছে। এসব উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে সরিষা আবাদ হয়ে থাকে।
তিনি জানান, সরিষা ক্ষেতে মধুর বাক্স স্থাপনে মৌমাছি পরাগায়নে সহায়তা করে। এতে সরিষা ফলন বেড়ে যায়। চাষি ও মৌচাষি উভয়েই লাভবান হয়ে থাকেন। তিনি জানান প্রতি বছর চলনবিল এলাকায় দেশের বিভিন্ন জেলা ধেকে মধু চাষিরা আসেন। তাদের উৎপাদিত মধু পাইকাররা কিনে বিভিন্ন কোম্পানিতে সরবরাহ করেন। তিনি জানান, গত বছর খামারিরা মধুর ভালো দাম পেয়েছেন। এবার ভালো দাম পেয়ে চাষিরা লাভবান হবেন বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। আমিন ইসলাম জুয়েল/এমএমএফ/জিকেএস