সালতামামি

দরপতন ও কারসাজি চক্রের দখলে শেয়ারবাজার

রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতা আর কারসাজি চক্রের অপতৎপরতায় অব্যাহত দরপতনে বছর পর করেছে দেশের শেয়ারবাজার। ফলে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের দ্বিতীয় বছর সব ধরনের সূচক পতনের পাশাপাশি বাজার মূলধন হারিয়েছে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) পক্ষ থেকে আগের প্রণোদনার সঙ্গে কিছু সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নিলেও সুফল পায়নি সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায়, শেয়ার কেলেংকারিদের বিচার শুরু এবং পুঁজিবাজারে ব্যাংকগুলোর অতিরিক্ত বিনিয়োগের সমন্বয়ের সময়সীমা বাড়ানোকে বছর জুড়ের দরপতন অব্যাহত ছিলো। এছাড়াও ২০১৫ সালের শুরুতেই প্রথম তিন মাস রাজনৈতিক অস্থিরতা দেশের পুঁজিবাজারকে কিছুটা সংকুচিত করে৷ প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তি পর্যায়ের বড় বিনিয়োগকারীদের ধীরে চলো নীতির কারণে পুঁজিবাজার তার স্বাভাবিক গতি হ্রাস পায়৷এ ছাড়াও অতিরিক্ত প্রিমিয়ামসহ দুর্বল কোম্পানিকে গণহারে আইপিও’র অনুমোদনের কারণে ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা মুখ ফিরিয়ে নেন। ফলে বছর জুড়ে ডিএসইতে লেনদেন হয়েছে ২ থেকে ৩শ’কোটি টাকার গড়ে। অন্যদিকে নিজের প্রয়োজনীয় খরচ মেটাতে না পেরে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে দেড়’শ ব্রোকারেজ হাউজ।বাজার চিত্র : প্রত্যাশা জাগিয়ে ২০১৫ সালের প্রথম দিনে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) লেনদেন হয় ২২৭ কোটি টাকা। এদিন বাজার মূলধন ছিলো ৩ লাখ ২৯ হাজার ৩৫৬ কোটি টাকা। আর ডিএসইএক্স সূচক ছিলো ৪ হাজার ৯৪১ পয়েন্ট। পহেলা জানুয়ারী থেকে টানা ৭ দিন উত্থানের মধ্যে দিয়ে লেনদেন হয়। কিন্তু ৫ জানুয়ারি কেন্দ্র করে দেশব্যাপী চলা রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় শুরু হয় দরপতন। যার ধারাবাহিকতায় বছরের শেষ দিন পর্যন্ত লেনদেন হয়। সর্বশেষ ৩০ ডিসেম্বর ডিএসইর বাজার মূলধন ছিলো ৩ লাখ ১৪ হাজার ৪৫৯ কোটি টাকা। ফলে বাজার মূলধন কমেছে ১৪ হাজার ৮৯৬ কোটি টাকা। পাশাপাশি সূচক কমেছে ৩৪৭ পয়েন্ট। ৪১ হাজার নতুন বিনিয়োগকারী : মন্দা বাজারেও কেবল আইপিওতে আবেদনের জন্য বিদায়ী বছরে ৪১ হাজার ৮০১টি বিও হিসাব বেড়েছে। যা আগের বছর অর্থাৎ ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে ছিলো ৩১ লাখ ১৮ হাজার ৪৫১টি। আর ২০১৫ সালের ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩১ লাখ ৬৬ হাজার ২৫২টিতে। জনপ্রতি একজন বিনিয়োগকারী হিসাব করা হলে ৪১ হাজার বিনিয়োগকারী বেড়েছে। অথচ আগের বছর বেড়েছিল২ লাখ ৫৭ হাজার ৯৯৯টি। সার্ভার বিপর্যয় : কারিগরি ত্রুটি ঠেকাতে শত কোটি টাকা দামে কেনা অত্যাধুনিক পদ্ধতি’র ডিএসইর নতুন সফটওয়্যারে ব্যাপক বিপর্যয়ে পড়েছিল পুঁজিবাজার। যা পুঁজিবাজারে ইতিহাসে সবেচেয়ে বড় ঘটনা। এ ঘঠনায় ডিএসইর পক্ষ থেকে দুঃখ প্রকাশ করা হয়। বিএসইসি সার্ভার বিপর্যয়ের কারণও জানতে চায়। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই বছরের শেষ দিকে আরো ২ দিন বিলম্বে লেনদেন হয়। ডিএসই’র সূত্র মতে, সফটওয়্যারটি চালুর ছয় মাস যেতে না যেতেই সর্বপ্রথম ২৪ ও ২৫ মে টানা দু’দিন দেড়িতে লেনদেন শুরু হয়। এরপর ১২ আগস্ট এবং ২২ নভেম্বর দেড়িতে লেনদেন হয়। প্রতিবারই ডিএসইর পক্ষ থেকে দুঃখ প্রকাশ করা হয়। কারসাজির বিচার : পুঁজিবাজার-সংক্রান্ত মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির লক্ষ্যে গঠন করা হয় স্পেশাল ট্রাইবুনাল। চলতি বছর ২১ জুন ১৭টি মামলা নিয়ে স্পেশাল ট্রাইব্যুনালের বিচারিক কার্যক্রম শুরু করেন বিচারক হুমায়ুন কবির (বিশেষ জজ)। ট্রাইব্যুনালে ইতিমধ্যে রায় ঘোষণা করেছেন একাধিক মামলার। রায়ে আদালত অভিযুক্তদের কারাদণ্ডের পাশাপাশি দিয়েছেন অর্থদণ্ড। ফলে পুঁজিবাজারের শেয়ার কেলেঙ্কারী চক্রের মধ্যে ভর করে ভয়ভীতি আর আতঙ্ক। কিন্তু উচ্চ আদালতে একের পর এক স্থগিতাদেশের কারণে অনেকটা স্বস্তিতে কারসাজিকারিরা।এদিকে ২১ জুন ১৭টি মামলা নিয়ে স্পেশাল ট্রাইব্যুনালের বিচারিক কার্যক্রম শুরু করলেও জুলাই মাসে চারটি ও সেপ্টেম্বরে আরও একটি মামলা নিম্ন আদালত থেকে ট্রাইব্যুনালে আসে। সব মিলিয়ে ট্রাইব্যুনালে মামলার সংখ্যা দাঁড়ায় ২২টি। এর মধ্যে পাঁচটি মামলার রায় ঘোষণা করেছেন আদালত। আসামিদের করা আবেদনে প্রেক্ষিতে উচ্চ আদালতের নির্দেশে ১৪টি মামলার কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে। দুটি মামলা ট্রাইব্যুনালের বিচারের এখতিয়ারের বাইরে হওয়ায় তা ফেরত পাঠানো হয়। বর্তমানে আর একটি মামলার কার্যক্রম চলছে ট্রাইব্যুনালে।প্রশ্নবিদ্ধ আইপিও অনুমোদন : এ বছরে ১২ কোম্পানিকে প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমের পুঁজিবাজার থেকে টাকা সংগ্রহের অনুমোদন দেয় বিএসইসি। কোম্পানিগুলো হল- ইউনাইটেড পাওয়ার জেনারেশন, বাংলাদেশ স্টিল রোলিং, তসরিফা ইন্ডাস্ট্রিজ, অলিম্পিক এক্সেসরিজ, আমান ফিড, বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্স লিমিটেড, কেডিএস এক্সেসরিজ, সিমটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ, রিজেন্ট টেক্সটাইল, ইনফরমেশন টেকনোলজি, ড্রাগন সোয়েটার অ্যান্ড স্পিনিং ও ডোরিন পাওয়ার জেনারেশন। এর মধ্যে সিমটেক্স, রিজেন্ট টেক্স বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিসহ বেশির ভাগ কোম্পানির অনুমোদন ছিলো প্রশ্নবিদ্ধ। অনুমোদন দেয়ার পর একাধিক কোম্পানির আইপিওতে বিনিয়োগকারীদের আবদেনের দিন স্থগিত করা হয়। এসব কোম্পানি এই খরা বাজার থেকে প্রায় ৮’শ কোটি টাকা তুলে নেয়। এর মধ্যে ৪৯৪ কোটি ৬৫ লাখ ৫৯ হাজার ২০০ টাকা প্রিমিয়াম সংগ্রহের অনুমোদন দেয়া হয়।  ১৪ কোম্পানি’র তালিকাভুক্তি : ২০১৫ সালে তালিকাভুক্ত হওয়া কোম্পানিগুলো হলো- ন্যাশনাল ফিড মিলস, সিঅ্যান্ডএ টেক্সটাইল, ইফাদ অটোস, শাশা ডেনিমস, জাহিন স্পিনিং, ইউনাইটেড পাওয়ার জেনারেশন, বাংলাদেশ স্টিল রি-রোলিং, তসরিফা ইন্ডাস্টিজ, অলিম্পিক এক্সেসরিজ, আমান ফিড, কেডিএস এক্সেসরিজ, সিমটেক্স ইন্ডাস্টিজ ও রিজেন্ট টেক্সটাইল। এ ছাড়া তালিকাভুক্ত হয়েছে এশিয়ান টাইগার সন্ধানী লাইফ মিউচুয়াল ফান্ড নামে একটি মিউচ্যুয়াল ফান্ড। তালিকাভুক্ত হওয়া ১৪টি কোম্পানির মধ্যে ৯টি কোম্পানি প্রিমিয়াম আদায় করেছে। বাকি ৫টি কোম্পানি অভিহিত মূল্যে শেয়ার ইস্যু করেছে। ছিলো নানা সংস্কার ও প্রণোদনা : নানা প্রণোদনার বছর ছিল ২০১৫। সরকার, নিয়ন্ত্রক সংস্থা এবং স্টক এক্সচেঞ্জসহ বিভিন্ন মহল থেকে একের পর এক প্রণোদনার জোয়ার ছিল বাজারে। সরকারের সব চেয়ে বড় প্রণোদনা আসে ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেটে। বাজেটের উল্লেখযোগ্য সুবিধাগুলো হলো- করমুক্ত লভ্যাংশের আয়ের সীমা বৃদ্ধি, করপোরেট করহার হ্রাস, আইপিওতে ২০ শতাংশ শেয়ার ছাড়ার ক্ষেত্রে কর রেয়াত সুবিধা, মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারেজ হাউসগুলোকে উৎস কর আদায় থেকে অব্যাহতি এবং ব্যাংক, বীমা কোম্পানি ব্যতিরেকে তালিকাভুক্ত কোম্পানি ১৫ শতাংশের কম লভ্যাংশের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ৫ শতাংশ করারোপ। মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারেজ হাউসসহ সংশ্লিষ্ট ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হিসাবের ৫০ শতাংশ সুদ মওকুফ করতে পারবে। বাকি ৫০ শতাংশ সুদ অ্যাকাউন্টে রেখে তিন বছরে কিস্তিতে পরিশোধের সুযোগ দেয়া হয়েছে। বিনিয়োগকারীদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পুনঃঅর্থায়ন তহবিলের আওতায় ৯শ’ কোটি টাকা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্রোকারেজ হাউসের পুনর্মূল্যায়নজনিত ক্ষতির বিপরীতে ২০১৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বিশেষ প্রভিশন সুবিধা দেয়া হয়েছে। এর ফলে গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট নেতিবাচক ১৫০ শতাংশ পর্যন্ত নেতিবাচক হলেও একসঙ্গে প্রভিশনিং করতে হবে না। ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে ৫টি সমান কিস্তিতে তা সংরক্ষণ করা যাবে। অস্তিত্ব সংকটে ব্রোকারেজ মালিকরা : অব্যাহত দরপতনে ব্রোকারেজ হাউজ চালাতে যে পরিমাণ লেনদেন হওয়া দরকার ছিলো তা না হওয়া অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে টি এ খান সিকিউরিটিজ কোম্পানি লিমিটেড, দোহা সিকিউরিটিজ লিমিটেড, মোহাম্মদ তালহা আন্ড কোম্পানি লিমিটেড, পাশা ক্যাপিটাল লিমিটেড, সি-মারটি, প্রোডেন্টাল সিকিউরিটিজ লিমিটেড, কোনমার্ক লিমিটেড, সাদিক ফাইনেন্স ম্যানেজমেন্ট, এবি সিকিউরিটজ, হাবিবুর রহমান সিকিউরিটিজ, আলফা ইক্যুইটিজ লিমিটেড, রিলাইয়েন্স ব্রোকারেজ সার্ভিস লিমিটেড, সোহরাব সিকিউরিটিজ অ্যান্ডা ট্রেড লিমিটেড, এশিয়া সিকিউরিটিজ লিমিটেড, বাবুল সিকিউরিটিজ লিমিটেড, মডার্ন ইক্যুইটিজ লিমিটেড,নাবিলুর করিম, কোয়াস্ট টু কোয়াস্ট, হাজী মোহাম্মদ আলী, ঢাকা, লতিফ, ডিএলসি, বালি,মিন আব্দুর রশিদ, আহমেদ ইকবাল হাসান ও এএইচসি সিকিউরিটিজ লিমিটেড, এ ছাড়াও দাওলাতুনেসা, পিপলস ইক্যুইটি লিমিটেড, ইউনিয়ন ক্যাপিটাল, গ্রীনডেল্ট্রা, আইডিএলসি, আনোয়ারা এবং ডেসা সিকিউরিটিজ লিমিটেডসহ দেড় শতাধিক ব্রোকারেজ হাউজ।এদিকে ৩২ লক্ষ ৫৯ হাজার ২৪৬ মিলিয়ন টাকা বাজার মুলধন নিয়ে ২০১৫ সাল শুরু করে ডিএসই৷ বছর শেষে বাজার মুলধন কমে দাঁড়ায় ৩১ লক্ষ ৫৯ হাজার ৭৫৭ মিলিয়ন টাকা৷ ২০১৪ সলের চেয়ে ২০১৫ সালে বাজার মূলধন হ্রাস পেয়েছে ৯৯ হাজার ৪৮৯ মিলিয়ন টাকা৷ শতাংশের হিসাবে এ হ্রাসের হার ৩ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ৷ দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে প্রধান সূচক ডিএসইএক্স বছর শেষে ২৩৫ পয়েন্ট কমে দাঁড়ায় ৪ হাজার ৬২৯ পয়েন্টে। ডিএসই ৩০ সূচক ৫২ পয়েন্ট কমে ১ হাজার ৭৫০ পয়েন্টে এবং শরীয়াহ সূচক ডিএসইএস ৪৩ পয়েন্ট কমে ১ হাজার ১০৭ পয়েন্টে দাঁড়ায়৷ এসআই/এআরএস/পিআর

Advertisement