ইসতিয়াক আহমেদ
Advertisement
চলেই এলো ডিসেম্বর মাস! আর মাত্র একমাস বাকি। উত্তরে এখনই শীত পড়তে শুরু করেছে। আর তাই পরিযায়ী পাখির মতো সবাই ছুটতে শুরু করেছে দক্ষিণে। আমরাও যে তার ব্যাতিক্রম নই। তাই আমরাও পথ ধরলাম দক্ষিণের।
আগেই থেকে ঠিক করে রাখা সেন্টমার্টিন পরিবহনের বাসে চেপে বসলাম। রাত সাড়ে ৮টার বাস যখন টেকনাফ ঘাটে পৌঁছালো তখন ভোর সাড়ে ৬টা। এরপর ফ্রেশ হয়ে পেটপূজা করে নেওয়ার পালা।
এবার ধীরে সুস্থে ছুটলাম জাহাজ পানে। উঠে পড়লাম জাহাজে। ঘড়িতে তখন সকাল সাড়ে ৯টা। একে একে সবগুলো জাহাজ যাত্রা শুরু করলো সেন্টমার্টিনের উদ্দেশ্যে।
Advertisement
সেন্টমার্টিন বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ। যা মূল ভূ-খণ্ডের সর্ব দক্ষিণে ও কক্সবাজার জেলা শহর থেকে ১২০ কিলোমিটার দূরে ১৭ বর্গ কিলোমিটারের একটি ক্ষুদ্র দ্বীপ। এই দ্বীপ কবে প্রথম শনাক্ত করা হয়েছিলো তা জানা যায়নি।
তবে কয়েকজন আরব বণিক দ্বীপটির নামকরণ করেছিলেন জিঞ্জিরা দ্বীপ নামে। এই বণিকরা চট্রগ্রাম থেকে পূর্ব এশিয়ায় যাতায়াতের সময় এই দ্বীপে বিশ্রাম নিতেন। তাই মানুষ দ্বীপটিকে জিঞ্জিরা দ্বীপ নামেই চিনতো।
১৮৯০ সালের দিকে বাঙালি ও রাখাইন সম্প্রদায়ের কিছু মানুষ এই দ্বীপে এসে বসতি স্থাপন করেন। ইতিহাস থেকে যতটুকু জানা যায়, এখানে প্রথম অধিবাসী হিসেবে বসতি স্থাপন করেছিলো মোট ১৩টি পরিবার। যারা সবাই ছিলেন মৎস্যজীবী।
কালক্রমে দ্বীপটি বাঙালি অধ্যুষিত এলাকা হিসেবে পরিণত হয়। সেখানে তারা প্রচুর পরিমাণে নারকেল গাছ রোপন করেন। একসময় স্থানটি নারকেল জিঞ্জিরা নামেও পরিচিতি পায়। ১৯৯০ সালে ব্রিটিশ ভূ-জরিপ দল এই দ্বীপকে ব্রিটিশ-ভারতের অংশ হিসেবে নেয়।
Advertisement
১৯০০ খ্রিস্টাব্দে দ্বীপটিকে যখন ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্ভুক্ত করা হয়, তখন চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মার্টিনের নাম অনুসারে দ্বীপটির নামকরণ করা হয়। তারপর থেকেই মানুষ দ্বীপটিকে সেন্টমার্টিন নামেই চেনে।
দিনের আলো নিভে এলে, শুধুই যে জোয়ারের পানি বাড়ে তাই নয়। একইসঙ্গে সেন্টমার্টিনও সেজে উঠে আলোকিত ঝলমলে এক সাজে। সেন্টমার্টিন হলো শুটকি ও তাজা মাছ প্রেমীদের জন্য এক স্বর্গ।
অগুনতি দোকান ভরা নানা মাছের শুটকি পাবেন। জোয়ারের পানি ভেজা সৈকতের ধারেই অস্থায়ী দোকানগুলো পসড়া সাজিয়ে বসে নানান তাজা সামুদ্রিক মাছ নিয়ে।
পছন্দ হলেই দামাদামি করে ফেলুন। এরপর মাছ খাওয়ার উপযুক্ত করে তোলার দায়িত্ব তাদের। ভরপুর মাছের বারবিকিউ খেলাম রাতে। এরপর রাতে রিসোর্টে ফিরে ঘুমালাম।
সকাল হতেই সেন্টমার্টিন ছেড়ে ছেঁড়াদ্বীপ পানে যাওয়ার পালা। বাংলাদেশের মানচিত্রে দক্ষিণের সর্বশেষ বিন্দু হলো ছেঁড়া দ্বীপ। দক্ষিণ দিকে এর পরে বাংলাদেশের আর কোনো ভূ-খণ্ড নেই। সেন্টমার্টিন থেকে বিচ্ছিন্ন ১০০-৫০০ বর্গমিটার আয়তনবিশিষ্ট কয়েকটি দ্বীপ আছে।
যেগুলোকে স্থানীয়ভাবে ‘ছেঁড়াদিয়া’ বা ‘সিরাদিয়া’ বলা হয়। ছেঁড়া অর্থ বিচ্ছিন্ন বা আলাদা, আর মূল দ্বীপ ভূ-খণ্ড থেকে কিছুটা বিচ্ছিন্ন বলেই এ দ্বীপপুঞ্জের নাম ছেঁড়া দ্বীপ।
প্রবাল দ্বীপের ইউনিয়ন সেন্টমার্টিন থেকে ছেঁড়া দ্বীপ প্রায় ৮ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত। দক্ষিণের এই বিচ্ছিন্ন দ্বীপে আছে প্রচুর প্রাকৃতিক পাথর। দ্বীপের প্রায় অর্ধেকই জোয়ারের সময় সমুদ্রের পানিতে ডুবে যায়।
এলাকাটি সরকারের ঘোষিত একটি ‘পরিবেশ-প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা’। এরকম এলাকায় ব্যক্তিগত বা প্রাতিষ্ঠানিক মালিকানায় জমি কেনা, এমনকি কোনো প্রকার স্থাপনা নির্মাণ আইনত নিষিদ্ধ।
সেন্টমার্টিন থেকে যদি ছেড়াদ্বীপে যেতে অনেকেই বাই সাইকেল ও মোটরসাইকেলে জার্নি করেন। যা অত্যন্ত কষ্টকর। তার চেয়ে সাগর পাড়ি দিয়ে যাওয়াই সময়সাপেক্ষ। এক্ষেত্রে তুলনামূলক সহজলভ্য উপায় হলো জনপ্রতি ১৫০ টাকা খরচে ট্রলারে যাওয়া-আসা।
ট্রলারের তুলনায় তুলনামূলক দ্রুত ও নিরাপদ উপায় হলো লাইফবোট নিয়ে যাওয়া। ভাড়া পড়বে ২০০ টাকা। আর দ্রুত গতির যাত্রায় আছে স্প্রিড বোট। এতে জনপ্রতি ৩০০ টাকা ভাড়া পড়বে।
আমরা মূলত গিয়েছি লাইফবোটে। পৌঁছাতে সময় লাগে ২০ মিনিট। ফিরে আসতে আরও ২০ মিনিট সময় লাগে। এর মাঝে আধা ঘণ্টা সময় পাওয়া যায়। এরপর ছেড়াদ্বীপ থেকে ফিরেই শেষ বারের মতো ছুটে যাওয়া সেন্টমার্টিনের স্বচ্ছ নীল পানির সৈকতে।
ছুটে চলা সময়কে সাক্ষী রেখে এবার পালা আদার ব্যাপারী হয়েও জাহাজ পানে ছুটে চলার। ফেরার পথ ধরতে হবে যে। ধীরে ধীরে নিভে আসছে দিনের আলো। গাঙচিলগুলোও ফিরে যাচ্ছে বিদায় দিয়ে।
জেএমএস/এমএস