সমাজে অপরাধ প্রবণতা কমাতে সুন্নাতের অনুসরণ ও অনুকরণের বিকল্প নেই। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অপরাধমুক্ত সমাজ বিনির্মাণে ৫টি মূলনীতি ঘোষণা করেছেন। সুন্নাহর আলোকে ঘোষিত ৫ মূলনীতি কী?
Advertisement
১. সুন্নাহর আলোকে মানসিক চিকিৎসা দেওয়াআধুনিক বিজ্ঞান মনে করে সমাজের অপরাধ প্রবণতা কমাতে মানসিক চিকিৎসার বিকল্প নেই। সুন্নাহ থেকেও প্রমাণিত যে, অপরাধমুক্ত সমাজ গঠনে মানসিক চিকিৎসা জরুরি। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক কুরাইশ যুবককে অপরাধ প্রবণতা থেকে, গুনাহ থেকে মুক্ত করতে মানসিকভাবে প্রচেষ্টা করেছিলেন। যার ফলে ব্যভিচারের মতো অপরাধ ও গুনাহের কাজ থেকে ফিরে এসেছিল সেই কুরাইশ যুবক।
কুরাইশ যুবক প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে ব্যভিচারের অনুমতি চায়। কিন্তু বিশ্বনবি যুবকের এই অনুমতি চাওয়ায় মোটেই বিদ্বেষ পোষণ করেননি বরং ধর্ষণ-ব্যভিচাররোধে তিনি যুবকের সঙ্গে কথা বললেন। তার মানসিক চিকিৎসায় কিছু বিষয়ে মতামত জানতে চাইলেন। বিশ্বনবির অনুপম মানসিক চিকিৎসা ও কৌশল যুবককে ব্যভিচার থেকে নিবৃত্ত রেখেছিল। হাদিসের বর্ণনায় ঘটনাটি এভাবে ওঠে এসেছে-‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এক কুরাইশ যুবক ব্যভিচারের অনুমতি চায়। উপস্থিত সাহাবায়ে কেরাম ওই যুবকের ওপর রাগান্বিত হয় এবং শাস্তি দিতে চায়। কিন্তু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দৃষ্টিভঙ্গি এক্ষেত্রে ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। তিনি শান্তচিত্তে যুবককে তাঁর একেবারে কাছে আসতে বললেন। এরপর তার মানসিক চিকিৎসায় তাকে কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলেন-> তুমি কি তোমার মায়ের জন্যে এটা (ব্যভিচার) মেনে নেবে?যুবক জবাব দিল- ‘না’।তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘(অন্য) লোকেরাও এটা তাদের জন্য পছন্দ করবে না; অনুমতি দেবে না।
> এরপর তিনি যুবককে আবার জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি এটা (ব্যভিচার) তোমার কন্যা, বোন ও চাচির জন্য অনুমোদন করবে?এবারও যুবক জবাব দিল- ‘না’।রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবারো বললেন, ‘(অন্য) লোকরাও এটা তাদের জন্য অনুমোদন করবে না।’
Advertisement
> এরপর তিনি (প্রিয় নবি) যুবকটির হাত ধরে বললেন, ‘আল্লাহ্ তার (যুবকের) পাপ মাফ করে দিন, তার অন্তর পবিত্র করুন এবং তাকে সহিষ্ণু করুন (তার এই কামনার বিরুদ্ধে)। সাহাবাগণ বলেন, এরপর থেকে ওই যুবক কোনো দিন অন্যায়ের দিকে পা বাড়ায়নি।’ (মুসনাদে আহমদ, তাবরানি, মাজমাউয যাওয়াইদ)
২. অপরাধীর আত্মসম্মানে আঘাত না করারাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সময়ে কেউ কোনো অপরাধ করলে তিনি তার নাম উল্লেখ না করেই মানুষকে সতর্ক করতেন। হাদিসে এসেছে-হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে যখন তার সাহাবির ব্যাপারে কোনো অভিযোগ পৌঁছাত, তখন তিনি (নাম-পরিচয় উল্লেখ করে) বলতেন না- ‘অমুকের কী হলো!’ বরং তিনি বলতেন, মানুষের কী হলো তারা এমন কাজ করে!’ (আবু দাউদ)
কারো অপরাধ সবার সামনে প্রকাশ পাওয়ার আগে যদি তাকে ব্যক্তিগতভাবে সতর্ক করার সুযোগ থাকে। আর পরিচয় প্রকাশ না করে তাকে সতর্ক করা হয় তবে অপরাধ প্রবণতা অনেকাংশেই কমে যায়। আর এমনটিই বলেছেন স্বয়ং বিশ্বনবি।
৩. অপরাধমূলক কাজের প্রচারণা না করাঅপরাধ প্রবণতা বাড়িয়ে দেয় এমন কাজের প্রচার-প্রচারণা না করার নির্দেশ দিয়েছেন বিশ্বনবি। কেননা অপরাধমূলক কাজের প্রচার না করলে অপরাধ প্রবণতা ও গুনাহের কাজ কমে যায়। তাই সামাজিকভাবে অপরাধীর দোষ-ত্রুটি ও অপরাধের প্রচার নিষিদ্ধ করেছেন বিশ্বনবি। যেন অপরাধী ব্যক্তি অনুতপ্ত হয়ে সঠিক পথে ফিরে আসার সুযোগ পায়। হাদিসে এসেছে-হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেঠেরনবী (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি তার কোনো মুসলিম ভাইয়ের দোষ গোপন করল, আল্লাহ কেয়ামতের দিন তার দোষ গোপন করবেন। আর যে তার কোনো মুসলিম ভাইয়ের দোষ প্রকাশ করে দেবে, আল্লাহ তার দোষ প্রকাশ করে দেবেন; এমনকি তাকে নিজ ঘরে অপমানিত করবেন।’ (ইবনে মাজাহ)
Advertisement
৪. আত্মসংশোধনের সুযোগ দেওয়াঅপরাধ বা পাপ ঠেকাতে অপরাধীকে আত্মসংশোধনের সুযোগ দেওয়ার দিকনির্দেশনা দেয় ইসলাম। তাই কেউ অপরাধ বা পাপের কাজ করলে তার ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে তাকে আত্মসংশোধনের সুযোগ দিতে বলেছেন বিশ্বনবি। হাদিসে এসেছে-হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ব্যভিচারে লিপ্ত দাসীকে দুইবার সংশোধনের সুযোগ দান করার কথা বলেছেন। এর পরও সংশোধন না হলে তাকে বিক্রি করে দিতে বলেছেন। (বুখারি)
৫. ক্ষমা পাওয়ার আশ্বাস দেওয়াঅপরাধ বা পাপ করলেও ক্ষমা পাওয়া যাবে মর্মে অপরাধীকে আশ্বাস দেওয়া। যাতে সে পাপ বা অপরাধ থেকে ফিরে আসে। অপরাধ থেকে ক্ষমার আশ্বাস পেলে অপরাধী ব্যক্তি দ্রুত অন্যায় থেকে ফিরে আসে। হাদিসে এসেছে-রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘পাপ পরিহার করো, আল্লাহ তোমার পাপকে পুণ্যে পরিণত করবেন। (তখন) আবু তুয়াইল রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, আমরা তো বিশ্বাসঘাতক এবং পাপাচারীও? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘হ্যাঁ’ আল্লাহ মহান। কোনো কিছু তার সীমার (ক্ষমতার) ঊর্ধ্বে নয়।’ (তাবারানি)
সুতরাং মানুষের উচিত, সমাজের অপরাধ প্রবণতা কমাতে, পাপ কাজ থেকে মানুষকে ফেরাতে হাদিসের দিকনির্দেশনা মোতাবেক উল্লেখিত পাঁচটি উপায় অবলম্বন করা। এর মাধ্যমেই মানুষ পাপ কাজ থেকে ভালো কাজে ফিরে আসার উপায় খুঁজে পাবে।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে হাদিসে নির্দেশিত উল্লেখিত উপায়গুলো অনুসরণ ও অনুকরণ করে অপরাধমুক্ত সমাজ গঠনের তাওফিক দান করুন। পাপের কাজ ছেড়ে ভালো পথে ফিরে আসার তাওফিক দান করুন। আমিন।
এমএমএস/এমএস