জাগো জবস

যেভাবে বিসিএসের প্রস্তুতি নিয়েছিলেন ইমরান

ইমরান হাসান ৩৭তম বিসিএসের শিক্ষা ক্যাডারে (ইংরেজি) ১২তম হয়ে উত্তীর্ণ হন। তিনি ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন। বাবা আবুল কাশেম সরকারি স্কুলের শিক্ষক, মা তাসলিমা আক্তার গৃহিণী। ইমরান ২০০৭ সালে গফরগাঁও সরকারি হাই স্কুল থেকে এসএসসি, ২০০৯ সালে ঢাকা নটর ডেম কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। পরে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।

Advertisement

বর্তমানে তিনি চাঁদপুর সরকারি কলেজে ইংরেজি প্রভাষক হিসেবে কর্মরত। সম্প্রতি তার বিসিএস জয়, ভবিষ্যৎ স্বপ্ন ও সফলতার গল্প শুনিয়েছেন জাগো নিউজকে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আনিসুল ইসলাম নাঈম—

জাগো নিউজ: আপনার শৈশব কেমন কেটেছে? ইমরান হাসান: ছোটবেলায় সহশিক্ষা কার্যক্রমে সরব ছিলাম। কলেজ থেকে ডিবেটিং করা শিখেছি। খেলাধুলার পাশাপাশি স্কুল ক্লাব ও বিভিন্ন সংগঠন করতাম। বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয় নিয়ে ডিবেট করতাম। যেগুলো বড় হয়ে চাকরির ক্ষেত্রে ভাইবার জন্য কাজে দিয়েছে। ছোটবেলায় বাবা-মা ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন দেখাতেন। আসলে সেই স্বপ্ন দেখেই বড় হয়েছি। কখনও শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন ছিল না। কিন্তু বড় হয়ে চাকরির পরীক্ষা দিতে দিতে বুঝতে পারলাম বাস্তবতা ভিন্ন।

জাগো নিউজ: পড়াশোনায় কোনো প্রতিবন্ধকতা ছিল কি?ইমরান হাসান: পড়াশোনায় সচরাচর যেসব প্রতিবন্ধকতা থাকে, আমার ক্ষেত্রে সেসব ছিল না। পরিবার থেকে যথেষ্ট সাপোর্ট পেয়েছি। আর পরিবার আর্থিকভাবে সচ্ছল থাকার কারণে তেমন সমস্যা হয়নি।

Advertisement

জাগো নিউজ: বিসিএসের স্বপ্ন দেখেছিলেন কখন থেকে?ইমরান হাসান: সম্মান ৩য় বর্ষ থেকে যখন ৪র্থ বর্ষে উঠলাম; তখন দেখতাম হলের বড় ভাইরা চাকরি পরীক্ষার প্রস্তুতি নেন। তাদের দেখে চাকরির পড়ার জন্য অনুপ্রেরণা পাই। তাদের থেকে গাইড নিয়ে পড়া শুরু করি। পড়ার জন্য নিজের থেকে ভালো কোন পার্টনার নেই। বিভিন্ন কোচিং সেন্টার, বড়দের কাছ থেকে গাইডলাইন পাওয়া যাবে; তবে পড়ালেখা নিজেরই করতে হয়।

জাগো নিউজ: বিসিএস যাত্রার গল্প শুনতে চাই, প্রস্তুতি কীভাবে নিয়েছেন?ইমরান হাসান: আমি শহর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে থাকতাম। সকালে শহর থেকে একটি বাসে ভার্সিটিতে যেতাম। দিনে দুটি ক্লাস ছিল, সকালে একটা আর বিকেলে একটা। বিকেলে ক্লাস করে সন্ধ্যার আগে বাসায় ফিরতাম। প্রস্তুতি নেওয়ার খুব কম সময় পেতাম। আমার পক্ষে ৮-১০ বা ১৫ ঘণ্টা পড়ার সুযোগ ছিল না। প্রতিদিন ৩-৪ ঘণ্টা করে পড়ার সুযোগ হতো। আমি বিসিএসের জন্য আলাদা করে প্রস্তুতি নেইনি। প্রথমে মূলত চাকরির জন্য প্রস্তুতি নিয়েছি। বাজারে যেসব গাইড পাওয়া যায়। সেখান থেকে এক সেট গাইড কিনে নেই। তারপর পড়া শুরু করলাম। প্রথমে টপিক ধরে ধরে পড়লাম, যেমন- বাংলাদেশ বিষয়াবলী, বাংলাদেশের অতীতকাল, মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগ—এভাবে টপিক ধরে পড়তাম। টপিক ধরে পড়ার পর বিভিন্ন কোচিংয়ে এক্সাম ব্যাচ থাকে। ব্যাচে পরীক্ষা দেওয়া শুরু করলাম। আমার পক্ষে কোচিং করা সম্ভব ছিল না। কারণ মাস্টার্স পড়ছিলাম। তাই বাসায়ই পড়তাম আর কোচিংয়ে এক্সাম ব্যাচগুলোয় পরীক্ষা দিতাম। যখন পরীক্ষা দিতাম; তখন দেখতাম ম্যাথের অংশটুকু খারাপ হয়েছে। আমি বুঝতাম যে, ম্যাথের অংশটুকুর প্রস্তুতি ভালো হয়নি। তখন বাসায় থেকে ম্যাথের অংশটুকু নিয়ে পড়াশোনা করতাম। তারপর আবার এ বিষয়ের ওপর কোচিংয়ে আরেকটি পরীক্ষা দিতাম; তখন দেখতাম ম্যাথের অংশ ভালো হয়েছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক অংশ খারাপ হয়েছে। তখন আমি মার্ক করতাম, আন্তর্জাতিকের এ অংশটুকু পড়া হয়নি। তারপর বাসায় গিয়ে আবার আন্তর্জাতিক অংশটুকু পড়া শুরু করতাম। কোচিং এক্সাম ব্যাচগুলোয় পরীক্ষা দিচ্ছিলাম। পরীক্ষায় যে অংশে খারাপ হচ্ছিল, ওই অংশ বাসায় গিয়ে পড়তাম।

এভাবে চালিয়ে যাওয়ার পর আমার মনে হয়েছিল, আমি চাকরির পরীক্ষায় টিকতে পারি। তখন আমার মাস্টার্স চলছিল। আমি কয়েকটি ব্যাংক ও বিসিএসে চাকরির পরীক্ষা দিলাম। তখন বিসিএসসহ ব্যাংকগুলোয় প্রিলিমিনারি রেজাল্ট পজিটিভ এসেছে। প্রিলিতে সবগুলোয় উত্তীর্ণ হওয়ার পর আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেল। তারপর যখন বিসিএস রিটেন পরীক্ষা এলো; তখন আমার মাস্টার্স পরীক্ষা চলছিল। ডিপার্টমেন্টের স্যারদের সঙ্গে কথা বলে ডিপার্টমেন্ট পরীক্ষা ১৫ দিন পেছানো হয়েছিল। ইংরেজি থেকে আমিসহ ৩ জন রিটেন দিয়েছিলাম। রিটেনের প্রস্তুতির ক্ষেত্রে ম্যাথ, ইংরেজি ও বিজ্ঞান ভালো জানা জরুরি। আমি নটর ডেম থেকে বিজ্ঞান নিয়ে পড়েছি। ম্যাথ নিয়েও তেমন দুর্বলতা ছিল না। ইংরেজিতে অনার্স করায় ইংরেজি ভালো জানা ছিল। তখন বেশি জোর দিয়েছি ম্যাথ ও বাংলাদেশ বিষয়াবলীতে। রিটেনে ৩ জনের মধ্যে শুধু আমি টিকলাম। যখন রিটেন দেওয়া শেষ হলো; তখন মাস্টার্স শেষ হয়ে যায়। ভাইবার জন্য যথেষ্ট সময় পেয়েছি। ভাইবাও ভালো হয়েছে। ৩৭তম বিসিএসে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুধু আমি ক্যাডার পেয়েছি।

জাগো নিউজ: পর্দার আড়াল থেকে কেউ অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে? কাকে বেশি মনে পড়ে?ইমরান হাসান: বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় শাখাওয়াত জামিল নামে একজন শিক্ষক আসেন। তখন তিনি ৩৪ বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডার পেয়েছিলেন। স্যার শিক্ষা ক্যাডার পেয়েও আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে ছিলেন। পরে ৩৫ বিসিএস দিয়ে প্রশাসন ক্যাডার পান। তখন প্রশাসন ক্যাডার হিসেবে যোগ দেন। মূলত স্যারই আমার অনুপ্রেরণার উৎস ছিলেন।

Advertisement

জাগো নিউজ: শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিসিএস নিয়ে বেশি উদ্দীপনা দেখা যায়। অনেকেই বিসিএসকে জীবনের একমাত্র লক্ষ্য মনে করেন—এমনটি হওয়া উচিত?ইমরান হাসান: কখনোই এমনটি হওয়া উচিত নয়। এতে শিক্ষার্থীর সম্ভাবনাকে অনেক ছোট করে দেয়। আমি যখন চাকরির পরীক্ষাগুলো দিয়েছিলাম; তখন বিসিএস আমার লক্ষ্য ছিল না। বিসিএস প্রধান লক্ষ্য থাকলে যে কারো পা ফসকে যেতে পারে। বিসিএস একটি যুদ্ধ। এখানে সিটের তুলনায় অনেক বেশি শিক্ষার্থী পরীক্ষা দেয়। তাই যে কোনো ভালো ছাত্রের পা ফসকে যেতে পারে। বিসিএস ভালো চয়েস হতে পারে, তবে একমাত্র লক্ষ্য হিসেবে দেখা ঠিক হবে না।

জাগো নিউজ: যারা বিসিএসে আসতে চান, তাদের জন্য কী পরামর্শ দেবেন?ইমরান হাসান: নিজেকে কখনো ছোট মনে করা যাবে না। সব সময় আত্মবিশ্বাস রাখতে হবে। কোনো কারণে আত্মবিশ্বাস কমে গেলে ফাইনাল প্রস্তুতিতে বেঘাত ঘটবে। মানুষের সব স্বপ্ন সত্য হয় না, তারপরও চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। চেষ্টা করলে বিসিএস না হোক, সফলতা আসবেই। একজন শিক্ষার্থী নিজেই নিজের বন্ধু ও প্রতিদ্বন্দ্বি। বিসিএসে প্রিলি, রিটেন, ভাইবা, মেডিকেল টেস্ট ও পুলিশ ভেরিফিকেশন নিয়ে প্রায় ৩ বছরের জার্নি। যারা এ সময় ধৈর্য ধরে থাকতে পারেন, তারাই সফল হবেন।

জাগো নিউজ: একজন শিক্ষক হিসেবে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?ইমরান হাসান: আমি একজন ভালো গল্পকার হতে চাই। একজন শিক্ষক তার শিক্ষার্থীদের ভালো গল্প দিয়ে মোটিভেট করবে। ভালো শিক্ষক হওয়া একটা বড় গুণ। প্রত্যেক শিক্ষার্থী মনে রাখবে, এরকম শিক্ষক খুব কম পাওয়া যায়। এরকম হতে চাই, যাতে সবাই মনে রাখবেন। প্রতিদিন ক্লাস নেওয়ার পর মনে করি, ক্লাসটা যদি আরেকটু ভালো নিতে পারতাম। এ আক্ষেপ নিয়ে প্রতিদিন ক্লাস করি। আমি একটি সেরা ক্লাস নিতে চাই, যাতে আক্ষেপটা আর না থাকে।

জাগো নিউজ: করোনা দুর্যোগে আপনার ভূমিকা কী?ইমরান হাসান: করোনার সময় জেলা প্রশাসনের নির্দেশনায় বড় পরিকল্পনা ছিল। চাঁদপুরে যখন করোনা বেড়ে যায়; তখন ছুটি বাতিল করে আমাদের মাঠে নামানো হয়। মানুষ যেন ঘর থেকে বাইরে না যায়, করোনা যেন না ছড়ায়। ক্লাস বন্ধের সময় শিক্ষার্থীদের অনলাইনে ক্লাস নিয়েছি। যাদের অনলাইন ক্লাস করার সামর্থ ছিল না, তাদের আর্থিক সহায়তা করেছি। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সব সময় মানসিক সমর্থন দিয়েছি।

এসইউ/জেআইএম