বিশাল এক পাহাড়। এর উপরেই আছে এক জাগ্রত শিবমন্দির। সাধু-সন্নাসীসহ হিন্দু সম্প্রদায়ের ভক্ত অনুরাগীদের তীর্থ স্থান এটি। সেইসঙ্গে পর্যটকদের জন্যও রোমাঞ্চকর এক স্থান। এই পাহাড়ের সৌন্দর্য দেখতে দেশের দুর-দুরান্ত থেকে পর্যটকরা ভিড় জমান। অনেকেই বিশাল এই পাহাড়ে উঠতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে নিচে নেমে যান। আবার অনেকেই পাহাড় জয় করার আনন্দ নিয়ে সেখান থেকে ফেরেন।
Advertisement
বলছি চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের চন্দ্রনাথ পাহাড়ের কথা। অনেকেই হয়তো এরই মধ্যে এক বা একাধিকবার ঘুরে বেড়িয়ে এসছেন এই পাহাড় থেকে। চট্টগ্রাম শহর থেকে ৩৭ কিলোমিটার উত্তরে, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক থেকে সাড়ে ৩ কিলোমিটার পূর্বে চন্দ্রনাথ পাহাড়ের অবস্থান। এর সর্বোচ্চ চূড়ার উচ্চতা ১১৫২ ফুট বা ৩৬৫ মিটার।
চন্দ্রনাথ মন্দিরের রহস্য
পৌরাণিক স্মৃতিবিজড়িত অসংখ্য মঠ-মন্দির আছে এই পাহাড়ে। প্রতিবছর ফাল্গুন মাসে শিবচতুর্দশী মেলা হয় চন্দ্রনাথ পাহাড়ে। দেশ-বিদেশের অনেক সাধু-সন্ন্যাসী আসেন মেলায়। প্রচলিত আছে, নেপালের এক রাজা স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে পৃথিবীর পাঁচ কোণে পাঁচটি শিবমন্দির নির্মাণ করেন। এর মধ্যে চন্দ্রনাথ পাহাড়ের শিবমন্দির অন্যতম।
Advertisement
ধর্মগ্রন্থ ও ইতিহাস মতে, এখানে মহামুনি ভার্গব বসবাস করতেন। অযোদ্ধার রাজা দশরথের পুত্র রামচন্দ্র তার বনবাসের সময় এখানে এসেছিলেন। তারা আসবেন জানতে পেরে মহামুনি ভার্গব এখানে স্নানের জন্য তিনটি কুণ্ড সৃষ্টি করেন। এরপর রামচন্দ্রের স্ত্রী সীতা এই কুণ্ডে স্নান করেন। এরপর থেকেই স্থানের নামকরণ করা হয় সীতাকুণ্ড।
যেটিতে রাম স্নান করেছিলেন সেটির নামকরণ করা হয় রামকুণ্ড। তবে বর্তমানে কুণ্ডগুলো শুকিয়ে গেছে। ইটের দেয়াল দিয়ে চিহ্নিত করে রাখা হয়েছে স্থানগুলোকে। চন্দ্রনাথ মন্দিরের পাদদেশে আছে উল্টা পাতালকালী মন্দির, ক্রমধেশ্বরী কালী মন্দির, ভোলানন্দগিরি সেবাশ্রম।
আরও আছে কাছারি বাড়ি, গিরিশ ধর্মশালা, বিবেকানন্দ স্মৃতি পঞ্চবটি, মহাশ্মশানভবানী মন্দির, অন্নপূর্ণা মন্দিরসহ আরও অনেক সনাতনী স্থাপনা। চন্দ্রনাথ মন্দিরে যাওয়ার পথে ব্যাসকুণ্ডের পশ্চিম পাড়ে এবং ভৈরব মন্দিরের বাম পাশে একটি বিশাল বটবৃক্ষ আছে। এটি অক্ষয় বট নামে পরিচিত।
চন্দ্রনাথ পাহাড় ভ্রমণে যা দেখবেন
Advertisement
চন্দ্রনাথ পাহাড়ের চূড়ায় উঠলেই শিব মন্দিরের দেখা পাওয়া সম্ভব। তবে এর জন্য আপনাকে পাড়ি দিতে হবে ২২০০ এরও বেশি সিঁড়ি। কোনো কোনো স্থানের সিঁড়িগুলো এতোটাই পিচ্ছিল ও সংকীর্ণ যে ওঠা বিপজ্জনক হতে পারে। আর বুঝতেই পারছেন, সামান্য এদিক-সেদিক হলে পা পিছলে পড়বেন পাহাড়ের খাদে।
১৫ মিনিট ওঠার পর একটি ছোট ঝর্ণা দেখতে পাবেন। যার দুই পাশে দুটি পথ যা উঠে গেছে একদম পাহাড়ের চূড়োয়। বাম পাশের পথ দিয়ে ওঠা সহজ। ডান পাশের পথ দিয়ে নামা সহজ। তাই বাম পাশের পথ ধরে উপরে উঠতে থাকুন।
এই রাস্তাটা সম্পূর্ণ পাহাড়ি পথ এবং কিছু ভাঙা সিঁড়ি আছে। আর ডান পাশের পথটার প্রায় পুরোটাই সিঁড়িপথ যেটা দিয়ে ওঠা বেশ কঠিন। অনেকে এই পথ দিয়ে উপরে উঠতে গিয়ে অর্ধেক পথে ফিরে আসে।
তবে এত কঠিন পথ পাড়ি দিতে হলেও আশেপাশের সবুজে ঘেরা অকৃত্রিম মনোমুগ্ধকর দৃশ্য আপনাকে মুগ্ধ করবে। পাহাড়ে ওঠার ফাঁকে ফাঁকে ছবি তুলে প্রকৃতির সঙ্গে নিজেকে ফ্রেমবন্দী করে রাখতে পারেন। মাঝে মাঝে থেমে বিশ্রাম নিতে পারবেন চায়ের দোকানগুলোতে।
গরম চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে পাহাড়ি সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন। সেইসঙ্গে কোলাহলহীন পাহাড়ের কোলে বসে পাখির ডাক, বাতাসে গাছের পাতার শব্দ সব শুনতে পাবেন। কারণ স্থানটি এতোই নিরিবিলি যে সেখান থেকে এই কোলাহল ও ব্যস্ততার জীবনে আর ফেরত আসতে ইচ্ছে করবে না।
পাহাড়ের খাঁজে বেশ কয়েকটি টং দোকান দেখতে পাবেন। সেখানে বসে টুকটাক খাবার কিনে খেতে পারবেন। এ ছাড়াও একটি ভাতের হোটেল আছে। খেতে চাইলে পাহাড়ে ওঠার সময় অগ্রিম অর্ডার করে যেতে হবে। পরবর্তীতে পাহাড় থেকে নামার সময় খেয়ে আসতে পারবেন। ব্যাগে যথেষ্ট পরিমাণে পানি ও স্যালাইন রাখুন। কারণ মন্দিরে পানি পাওয়া কঠিন। আর পাওয়া গেলেও দাম প্রায় দ্বিগুণ।
প্রায় দেড় ঘণ্টা আরোহণের পর চন্দ্রনাথ মন্দির পৌঁছানোর আগে বিরুপাক্ষ নামের আরেকটি মন্দির পড়বে। চাইলে সেখানে কিছু সময় বিশ্রাম নিয়ে নিতে পারেন৷ এখান থেকে সীতাকুণ্ড শহরের ও সমুদ্রের এক অদ্ভুত দৃশ্য আপনি দেখতে পাবেন।
তবে সব কষ্ট মুহূর্তেই ভুলে যাবেন চন্দ্রনাথ মন্দিরের উপরে উঠে আশেপাশের দৃশ্য দেখার পর। চারপাশ শুধু সবুজ আর সবুজ। যেন কোনো শিল্পী তার নিপুণ হাতে রংতুলিতে আঁকা। সীতাকুণ্ডের প্রায় পুরোটাই দেখতে পাবেন এখান থেকে। দূরে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে এক ঐশ্বরিক অনুভূতিতে আপনার মন প্রাণ জুড়িয়ে যাবে মুহূর্তেই। মন্দিরটি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থান। মন্দিরের ভেতরে শিব লিঙ্গ রাখা আছে। এর আশেপাশে অনেক সাধু-সন্নাসীরা বসে ধ্যান করেন। কেউ কেউ পূজো করে থাকেন। তাই এখানে হইহুল্লোড় না করে নিরবতা বজায় রেখে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিন। কারণ পরের পথটা আরও বেশি ভয়ানক, আরও বেশি রোমাঞ্চকর।
উল্টো কালীবাড়ি কিছুক্ষণ
চন্দ্রনাথ মন্দির পর্যন্ত অনেক পর্যটক গেলেও এরপরের পথটায় সহজে কেউ যায় না। তাই অনেকটা অজানা আর অচেনাই রয়ে গেছে এই পথটা। চন্দ্রনাথ মন্দিরের পেছন দিকে বেশ দুর্গম ও ভয়াবহ পাহাড়ি পথ বেয়ে নিচে নামতে হয়।
কিছু কিছু জায়গা এতটাই সরু যে সেখান থেকে পা পিছলে পড়লে আর রক্ষা নেই। তাই সাবধানে ধীরে ধীরে নিচে নামুন এবং এক্ষেত্রে ট্রেকিং স্যু আবশ্যক। নইলে বিপদ ঘটতে পারে যেকোনো সময়। বৃষ্টি হলে এই রাস্তাটা পাড়ি দেয়া রীতিমতো অসাধ্য সাধন হয়ে যায়।
প্রায় ৪০ মিনিট নিচে নামার পর দেখতে পাবেন পাহাড়ি ছড়া। সেখানে চাইলে গোসল করে নিতে পারেন। সেখান থেকে আরেকটু সামনে দেখতে পাবেন একটা গোল বিশালাকার পাথর, উপরে লাল কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে।
যেই পথে উল্টো কালীবাড়ি গিয়েছিলেন সে পথেই চন্দ্রনাথ মন্দিরে ফিরে আসুন। সেখান থেকে এবার ডান দিকের সিঁড়িপথ ধরে নিচে নামুন। এই পথটা পুরোটাই সিঁড়িপথ হওয়ার নামতে সুবিধা। তবে তাড়াহুড়ো করবেন না।
পাহাড়ের পাদদেশে এসে সিনএনজি নিয়ে আবার সীতাকুণ্ড বাজারে চলে আসুন। সেখানে শ্রী গোবিন্দ হোটেলে চাইলে নিরামিষ খাবার খেয়ে নিতে পারেন। সন্ধ্যার বাসে করে ঢাকায় চলে আসুন।
প্রয়োজনীয় তথ্য
চন্দ্রনাথ পাহাড়ের উচ্চতা খুব বেশি না হলেও এর চূড়ায় ওঠার পথটি বেশ সরু এবং দুর্গম। কেউ তাড়াহুড়া করে পাহাড়ে ওঠার চেষ্টা করবেন না। তাতে যেকোনো বড় দুর্ঘটনা হতে পারে। তাছাড়া পাহাড়ে উঠতে, নামতে নির্দিষ্ট পথ অনুসরণ করুন। উল্টো পথে কখনো উঠতে কিংবা নামতে চেষ্টা করবেন না।
যেভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের বাসে গেলে সীতাকুণ্ড নামা যায়। চট্টগ্রাম শহরের অলঙ্কার মোড় থেকেও বাসে আসা যায়। জনপ্রতি ভাড়া ৩০-৪০ টাকা। সিএনজি চালিত অটো রিকশা নিয়েও যেতে পারেন চট্টগ্রাম শহর থেকে। ভাড়া পড়বে ৩০০-৪০০ টাকা।
থাকার জায়গা
সীতাকুণ্ডে থাকার জন্য ভালো মানের কোন হোটেল নেই। সাধারণ মানের যে কয়টি হোটেল আছে, তাতেও মেলার সময় কক্ষ পাওয়া দুরুহ। সামান্য কয়েকটি হোটেল পুণ্যার্থীদেরই প্রয়োজন মেটানোর জন্য পর্যাপ্ত নয়। তাই সীতাকুণ্ডে ভ্রমণে গেলে চট্টগ্রামে থাকাই সবচেয়ে ভালো। চট্টগ্রাম শহরে থাকার জন্য বিভিন্ন মানের প্রচুর হোটেল আছে।
জেএমএস/এমকেএইচ