হোটেল-রেস্তোরাঁর রান্নাঘরে পোকামাকড় পাওয়া গেলে তা নিয়ে অনেক বিপত্তি দেখা দেয়। এ অভিযোগে সঙ্গে সঙ্গে বন্ধও করে দেয়া হয় রেস্তোরাঁ। কিন্তু ব্যাংককের রেস্তোরাঁয় পোকা পাওয়া ও পোকা খাওয়া মামুলি ব্যাপার।
Advertisement
অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, থাইল্যান্ডের হোটেল-রেস্তোরাঁয় পোকামাকড়ের মজাদার খাবার বিক্রি হয়। আপনার জন্য কী চাই? সাপ, ব্যাঙ, টিকটিকি, পিঁপড়া, উইপোকা, শুঁয়োপোকা, শামুক সবই রয়েছে। ফুটপাতের টং দোকানেও পাওয়া যায় তেলে ভাজা ঝিঁঝিঁ পোকা।
ঘেন্না পাচ্ছে? এটাই সত্যি। বলা হয়ে থাকে, তুমি যদি এক হাজার পিঁপড়া খাও তবে একটা হাতির শক্তি লাভ করবে (তামিল প্রবাদ)। পিঁপড়া খেলে সাঁতার শেখা যায়- (বাংলা প্রবাদ)। এসব প্রচলিত প্রবাদ থাইবাসীর জানা থাকুক বা না থাকুক, পিঁপড়া খেতে খুব পছন্দ করে থাইবাসীরা। তারা পিঁপড়াকে খুব পুষ্টিকর খাবার মনে করে।
স্যুরিনের রেস্তোরাঁগুলোতে ঢুকে ওয়েটারকে শুধু একবার মুখে ‘মাতাওয়ান’ শব্দটা উচ্চারণ করলেই হয়েছে। ওয়েটার সঙ্গে সঙ্গে আপনার সামনে হাজির করবে এক বাটি পিঁপড়ার স্যুপ। পয়সা বেশি থাকলে খেতে পারেন পিঁপড়ার ডিমের তরকারি। প্রতি প্লেট মাত্র তিন ডলার। সাপের স্যুপের দামটা একটু বেশি! প্রতি বাটি আট ডলার মাত্র।
Advertisement
আরশোলা বা তেলাপোকার নাম শুনলেই ঘেন্নায় রিরি করে উঠে গা। কিন্তু ওর চাটনি থাইল্যান্ডের সুখুমবিট জেলাবাসীর অত্যন্ত প্রিয় খাবার। ওখানে গুবরে পোকার তরকারি ছাড়া অতিথি আপ্যায়ন হয় না। বড় সাইজের গুবরে পোকার ডিম বেনল্যান্ড শহরের কাঁচা বাজারে বিক্রি হয়।
থাইবাসী ছোট চিকন জালের ফাঁদ লাগানো এক ধরনের কাঠি দিয়ে জঙ্গল থেকে ধরে আনে লাখ লাখ কিলবিলে কীটপতঙ্গ। তারপর ভালোভাবে রোদে শুকিয়ে, বস্তা ভর্তি করে বিক্রির জন্য পাঠানো হয় বাজারে। গ্রামবাসী শুকনো অবস্থায় খায় এগুলো। শুকনো কীটপতঙ্গ দিয়ে ওরা মজার মজার পিঠাও তৈরি করে।
ব্যাংককের অদূরে স্যামুট প্রকার্ন এলাকায় গুসানেস ডি মেগুয়ে নামের এক ধরনের পোকার শূককীট দিয়ে মেহমানদের আপ্যায়নের জন্য তৈরি করা হয় স্বাদের কাবাব। এই দিয়ে আপ্যায়ন করা সেখানে আভিজাত্যের প্রতীক। তাজা অবস্থায় এই পোকা বাজারে কিনতে পাওয়া যায়। এছাড়াও কারিকমা কেমোরেটা নামের পোকার ডিম শুকরের চর্বিতে ভেজে তৈরি করা হয় দারুণ সব সুস্বাদু খাবার।
ব্যাংককের পূর্বাঞ্চলীয় শ্রী রাঁচা শহরবাসী, বাড়িতে অতিথি এলে তাদের সামনে এনে দেয় প্লেট ভর্তি ঝিঁঝিঁ পোকার মোরব্বা। এই খাবার পেলে অতিথিরা নিজেদের সৌভাগ্যবান মনে করেন। গ্রামবাসী প্রগোটিস ইনকিউমা নামের মথ থলেতে সংগ্রহ করে কয়লার আগুনে ঝলসে এক ধরনের খাবার তৈরি করে। এই মথে রয়েছে প্রচুর চর্বি। স্বাদ হয় একেবারে বাদামের মতো।
Advertisement
থাইবাসীর খুব প্রিয় ও মুখরোচক একটা খাবার হলো পঙ্গপালের আচার। পঙ্গপাল ধরে ওরা আচার তৈরি করে কৌটায় ভরে সারাবছর সংরক্ষণ করে রাখে। উৎসবের ভোজে গরম গরম খাবারের সঙ্গে পরিবেশন করেন।
গান্ধি পোকার নাম শুনলে ভ্রু, নাক, কপাল কুঁচকে ওঠাটাই স্বাভাবিক। এর ভয়ানক দুগর্ন্ধের কথা মনে পড়লে অনেকেরই দম বন্ধ হয়ে আসে। শত্রু দেখলে বা পরিবেশটা প্রতিকূল মনে হলে নিশ্চিন্তে দুর্গন্ধ ছড়ায় এই গান্ধি পোকা। আর সেই গন্ধে শত্রুরা ঝেড়ে দেয় পিঠটান। কিন্তু থাইল্যান্ডের মানুষরা গান্ধি পোকার দুর্গন্ধের কোন তোয়াক্কা করে না।
বরং রকমারি মুখরোচক খাবারে রসনা বিলাস করে থাকে এই গান্ধি পোকা দিয়ে। থাইবাসীরা গান্ধি পোকা তরকারীতে ব্যবহার করে খাবারে রুচি-স্বাদ বাড়ানোর জন্যে বাড়তি এসেন্স হিসেবে। উৎসব পার্বণ ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানের ভোজে এই গান্ধি পোকা ছাড়া তাদের চলেই না।
শুধু কি তাই? শুঁয়োপোকা রান্না করে তরকারি হিসেবে খাবারের চেয়ে কাঁচা খেতেই বেশি পছন্দ তারা। থাই গ্রামবাসীরা বিভিন্ন গাছের পাতা থেকে শুঁয়োপোকা সংগ্রহ করে প্রতিদিন সকালে সেগুলো বিক্রি করে মাছের মতো। উচ্চ দামে খরিদ্দাররা তরকারি ও কাঁচা খেতে কিনে নেয় এই শুঁয়োপোকা।
পিঁপড়া, উইপোকা, শুঁয়োপোকার শূককীট ও ফড়িং মাখনে ভেজে আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব নিয়ে প্রীতিভোজের আয়োজন করে খায় থাইবাসী। স্যুরিনের রাস্তাঘাটের রেস্তোরাঁ ও টং দোকানে বিশেষ রুটি বিক্রি হয়। পতঙ্গ রোদে শুকিয়ে লোহার কড়াইতে গুঁড়ো করে বানানো হয় পাউডার। তা-ই দিয়ে বানানো হয় এই রুটি।
এছাড়াও সেখানকার হোটেল রেস্তোরাঁর মেন্যুতে পাওয়া যায় মৌমাছির শূককীট, মথ, মাছ আর কাঠ ছিদ্রকারী ঘুনপোকার স্যুপ। রেস্তোরাঁয় স্যুপ হিসেবে বিক্রি হলেও গ্রামবাসী এসব পোকামাকড় কাঁচা খেতেই বেশি পছন্দ করে থাকে। কারও অবশ্য পছন্দ রোদে শুকিয়ে কিংবা আগুনের তাপে ঝলসে নিয়ে মচমচ করে খেতে।
এখানকার বুড়ো মানুষ আর বাড়ন্ত শিশুদের পুষ্টিকর স্বাস্থ্য টনিক হচ্ছে ‘এসপনগোপাস’ নামের বড় বড় গান্ধি পোকা। মোটামুটি ব্যাংককের সব হোটেলে সব সময় পাওয়া যায় সাপ আর শামুকের নানাবিধ তরকারি। ভাতের সঙ্গে সাপের রোস্টের স্বাদই আলাদা। অনেকটা মুরগির মাংসের মতো। ওখানকার ক্যাব ড্রাইভার থেকে পর্যটক পর্যন্ত প্রত্যেকের কাছে উপাদেয় এই খাবারের দাম প্রতি প্লেট চার থেকে আট ডলার মাত্র।
লেখক: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
এমএমএফ/এমকেএইচ