আল্লাহ তাআলা বান্দার প্রতি বেশি খুশি হলে ৩টি জিনিস দান করেন। সেগুলো হলো- কন্যা সন্তান; মেহমান এবং বৃষ্টি। বর্ষা মৌসুমে অধিক বৃষ্টি হয়। বৃষ্টি বেশি হলেই অনেকে নানান কথা বলে থাকেন। কিন্তু বৃষ্টির সময় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে ৬টি করণীয় প্রমাণিত। বৃষ্টিতে পালনীয় সুন্নাত ৬টি কী?
Advertisement
প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বৃষ্টি বর্ষণ ও বজ্রপাত সম্পর্কে বলেছেন, মহা পরাক্রমশালী আল্লাহ বলেছেন-
‘আমার বান্দারা যদি আমার বিধান যথাযথভাবে মেনে চলত, তবে আমি তাদের রাতের বেলায় বৃষ্টি দিতাম আর সকাল বেলায় সূর্য (আলো) দিতাম আর কখনও তাদের বজ্রপাতের আওয়াজ শোনাতাম না।’ (মুসনাদে আহমদ)
বৃষ্টির সময়ের ৬ করণীয়
Advertisement
বৃষ্টির সময় মুমিন মুসলমানের ৬টি করণীয় রয়েছে। বৃষ্টির উপকারি ও ক্ষতিকর বিষয়গুলোও তাতে ওঠে এসেছে। হাদিসের একাধিক বর্ণনায় এ করণীয়গুলো সুস্পষ্ট-
১. বৃষ্টির সময় কল্যাণের দোয়া করা
যখন বৃষ্টি হয় তখন বৃষ্টি থেকে উপকার পেতে দোয়া করা জরুরি। বৃষ্টি শুরু হলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কল্যাণ ও উপকার পেতে ৩ শব্দের ছোট্ট একাটি দোয়া বেশি বেশি পড়তেন। তাহলো-
اللَّهُمَّ صَيِّبًا نَافِعًا
Advertisement
উচ্চারণ :‘ আল্লাহুম্মা সাইয়্যেবান নাফিআ।' (বুখারি, নাসাঈ)
অর্থ : ‘হে আল্লাহ! আপনি মুষলধারায় যে বৃষ্টি দিচ্ছেন, তা যেন আমাদের জন্য উপকারি হয়।'
এ দোয়া পড়লে আল্লাহ তাআলা বৃষ্টির ক্ষতিকর দিকগুলো দূর করে দেবেন এবং কল্যাণকর ও উপকারি বৃষ্টি দান করবেন।
২. বৃষ্টিতে অল্প সময় ভেজা
আল্লাহ তাআলা কুরআনুল কারিমের বৃষ্টির অনেক উপকারিতার কথা তুলে ধরেছেন। বৃষ্টি মানুষের জন্য রহমতস্বরূপ। আল্লাহর রহমত ও বরকত পেতে কিছু সময় বৃষ্টি ভেজার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। হাদিসে এসেছে-
হজরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, ‘আমরা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে থাকাকালীন সময়ে একবার বৃষ্টি পড়তে শুরু করে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর পরনের কাপড়ের কিছু অংশ তুলে ধরলেন যাতে করে তাঁর শরীরে কিছুটা বৃষ্টির পানি পড়ে। এরকম করার কারণ জানতে চাইলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন-
‘এটা (বৃষ্টি) এইমাত্র আল্লাহর কাছ থেকে এসেছে।’ (মুসলিম)
৩. বৃষ্টি শুরু হলে দোয়া করা
দোয়া কবুল হওয়ার বিশেষ সময়গুলোর মধ্যে বৃষ্টির সময়ও একটি। সুতরাং বৃষ্টি শুরু হলে নিজেদের জানা দোয়াগুলো পেশ করতে আল্লাহর কাছে দুই হাত তুলে রোনাজারি করা বা দোয়া করা জরুরি।
প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘দুই সময়ের দোয়া কখনও ফিরিয়ে দেওয়া হয় না। এক- আজানের পরে করা দোয়া। আর দুই- বৃষ্টির সময় করা দোয়া।’ (আল-হাকিম)
৪. বৃষ্টির জন্য দোয়া ও ক্ষতি থেকে আশ্রয় চাওয়া
ঝড়-বৃষ্টির ভারি বর্ষণের ক্ষতি থেকে বেঁচে থাকতে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চেয়ে দোয়া করাও সুন্নাত। দীর্ঘ এক হাদিসে এসেছে-
হজরত আনাস ইবনে মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, এক ব্যক্তি জুমআর দিন দারুল কাজা (বিচার করার স্থান)-এর দিকের দরজা দিয়ে মসজিদে প্রবেশ করল। এ সময় আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দাঁড়িয়ে খুতবাহ দিচ্ছিলেন। লোকটি আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে বলল-
‘হে আল্লাহর রাসুল! ধন-সম্পদ নষ্ট হয়ে গেল এবং রাস্তাঘাট বন্ধ হয়ে গেল। আপনি আল্লার কাছে দোয়া করুন যেন তিনি আমাদের বৃষ্টি দান করেন।
তখন আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুই হাত তুলে (৩ বার) দোয়া করলেন-
اللَّهُمَّ اسْقِنَا، اللَّهُمَّ اسْقِنَا، اللَّهُمَّ اسْقِنَا
উচ্চারণ : ‘আল্লাহুম্মাসক্বিনা, আল্লাহুম্মাসক্বিনা, আল্লাহুম্মাসক্বিনা।’
‘হে আল্লাহ! আমাদের বৃষ্টি দান করুন। হে আল্লাহ! আমাদের বৃষ্টি দান করুন। হে আল্লাহ! আমাদের বৃষ্টি দান করুন।
হজরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আল্লাহর কসম! আমরা তখন আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, মেঘ নেই, মেঘের সামান্য টুকরোও নেই। অথচ সালআ পর্বত ও আমাদের মধ্যে কোনো ঘরবাড়িও ছিল না।
তিনি বললেন, হঠাৎ সালআর ওই পাশ থেকে ঢালের মত মেঘ উঠে এল এবং মধ্য আকাশে এসে ছড়িয়ে পড়লো। অতঃপর প্রচুর বর্ষণ হতে লাগল। আল্লাহর কসম! আমরা ৬ দিন সূর্য দেখতে পাইনি।
পরের জুমআয় ক্ষতিকে বাঁচার দোয়া
এরপরের জুমআয় সে দরজা দিয়ে এক ব্যক্তি প্রবেশ করল। আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন দাঁড়িয়ে খুতবাহ দিচ্ছিলেন। লোকটি তাঁর সম্মুখে দাঁড়িয়ে বলল-
‘হে আল্লাগর রাসুল! ধন-সম্পদ ধ্বংস হয়ে গেল এবং রাস্তাঘাট বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। কাজেই আপনি বৃষ্টি বন্ধের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করুন।
হজরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন দুই হাত তুলে (এভাবে) দোয়া করলেন-
اللَّهُمَّ حَوَالَيْنَا وَلاَ عَلَيْنَا، اللَّهُمَّ عَلَى الآكَامِ وَالْجِبَالِ وَالآجَامِ وَالظِّرَابِ وَالأَوْدِيَةِ وَمَنَابِتِ الشَّجَرِ
উচ্চারণ : ‘আল্লাহুম্মা হাওয়ালাইনা ওয়া লা আলাইনা; আল্লাহুম্মা আলাল আকামি ওয়াল ঝিবালি ওয়াল আঝামি ওয়াজ জিরাবি ওয়াল আওদিয়াতি ওয়া মানাবিতিশ শাঝারি।’
অর্থ : ‘হে আল্লাহ! আমাদের আশে পাশে, আমাদের উপর নয়। হে আল্লাহ! টিলা, মালভূমি, উপত্যকায় এবং বনভূমিতে বর্ষণ করুন।’
হজরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, তখন বৃষ্টি বন্ধ হয়ে গেল এবং আমরা বেরিয়ে রোদে চলতে লাগলাম।’ (রাবী) শরিক রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, আমি আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহুকে জিজ্ঞাসা করলাম- এ লোকটি কি আগের সেই লোক? তিনি বললেন, আমি জানি না।’ (বুখারি)
৫. বজ্র-বৃষ্টিতে দোয়া
বজ্রপাত মহান আল্লাহ তাআলার মহাশক্তির এক ছোট নিদর্শন। এতেই মানুষ বিচলিত হয়ে পড়ে। যার ওপর বজ্রপাত হয় তার মৃত্যু অনেকটাই নিশ্চিত। বজ্রবৃষ্টি থেকে বাঁচতে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা ও দোয়া করতে বলেছেন বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। হাদিসে এসেছে-
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু তাঁর বাবা থেকে বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন বজ্রের শব্দ শুনতেন বা বিদ্যুৎ চমক দেখতেন তখন সঙ্গে সঙ্গে বলতেন-
اَللَّهُمَّ لَا تَقْتُلْنَا بِغَضَبِكَ وَ لَا تُهْلِكْنَا بِعَذَابِكَ وَ عَافِنَا قَبْلَ ذَلِكَ
উচ্চারণ : ‘আল্লাহুম্মা লা তাক্বতুলনা বিগাদাবিকা ওয়া লা তুহলিকনা বিআজাবিকা, ওয়া আ’ফিনা ক্ববলা জালিকা।’ (তিরমিজি)
অর্থ : ‘হে আমাদের প্রভু! তোমার ক্রোধের বশবর্তী হয়ে আমাদের মেরে ফেল না আর তোমার আজাব দিয়ে আমাদের ধ্বংস করো না। বরং এর আগেই আমাদের ক্ষমা ও নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে নাও।’
বজ্রপাত থেকে হেফাজত থাকার তাসবিহ
বজ্রের আক্রমণে মৃত্যু থেকে বাঁচতে ছোট্ট একটি তাসবিহ পড়ার কথা এসেছে হাদিসের বিখ্যাত গ্রন্থ মুসান্নেফে আবি শায়বায়। তাতে বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি এ তাসবিহ পড়বে-
سُبْحَانَ اللهِ وَبِحَمْدِهِ
উচ্চারণ : ‘সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহি।’
সে বজ্রপাতের আঘাত থেকে মুক্ত থাকবে। (মুসান্নেফে আবি শায়বায়)
৬. উপকারি বৃষ্টির জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ
বৃষ্টিপাত বন্ধ হলে আল্লাহর কাছে এ বৃষ্টি সবার জন্য উপকারি হতে কিংবা বৃষ্টি বন্ধ হলে আল্লাহর কাছে এ দোয়া করা সুন্নাত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলতেন, ‘যে ব্যক্তি (বৃষ্টির পর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের) এই দোয়া পাঠ করে, সে আমাকে বিশ্বাস করে আর তারকায় (তারার শক্তিতে) অবিশ্বাস করে। তাহলো-
مُطِرْنا بِفَضْلِ اللهِ وَرَحْمَتِهِ
উচ্চারণ : ‘মুত্বিরনা বিফাদলিল্লাহি ওয়া রাহমাতিহি’
অর্থ : ‘আমরা আল্লাহর দয়া ও করুণার বৃষ্টি লাভ করেছি।’ (বুখারি ও মুসলিম)
সুতরাং মুমিন মুসলমানের উচিত, বৃষ্টির সময় ও বৃষ্টি পরবর্তী সময়ে হাদিসে নির্দেশিত ৬টি সুন্নাত যথাযথভাবে পালন করা জরুরি।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে বৃষ্টির সময় ও বৃষ্টি পরবর্তী সময়ে করণীয়গুলো যথাযথভাবে পালন করার তাওফিক দান করুন। হাদিসের ওপর আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
এমএমএস/জেআইএম