ধর্ম

হে আল্লাহ! আমাকে ক্ষমা করে দিন!

সন্ধ্যা হলেই ধ্বনিত হবে- হে আল্লাহ! আমাকে ক্ষমা করে দিন! লাইলাতুল কদরের রাতে রোজাদার মুমিন মুসলমান কান্নাজড়িত কণ্ঠে ক্ষমা প্রার্থনায় আত্মনিয়োগ করবে।

Advertisement

লাইলাতুল কদরশবে কদর মহান আল্লাহর দেয়া মর্যাদার রাত। দুনিয়ায় উম্মতে মুহাম্মাদির জন্য সেরা উপহার। এ জন্য রমজান মাসের শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোতে বিগত জীবনের সব গোনাহ থেকে ক্ষমা পাওয়ার রাত ‘লাইলাতুল কদর’ তালাশ করতে বলা হয়েছে। রোজাদার মুমিন মুসলমান এ আশায় শবে কদরের বিশেষ দোয়াসহ রোনাজারি ও ক্ষমা প্রার্থনায় আত্মনিয়োগ করবে আর বলবে-اللَّهُمَّ إِنَّكَ عُفُوٌّ تُحِبُّ الْعَفْوَ فَاعْفُ عَنِّيউচ্চারণ : ‘আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আউয়্যুন, তুহিব্বুল আফওয়া, ফাফু আন্নি।’অর্থ : হে আল্লাহ! নিশ্চয়ই আপনি ক্ষমাশীল। ক্ষমা করে দিতে ভালোবাসেন। সুতরাং আমাকে ক্ষমা করে দিন।

শবে কদর কী?ফার্সি শব অর্থ হচ্ছে রাত। আর আরবি কদর শব্দটির দুটি অর্থ হয়। এক- পরিমাণ ও পরিমাপ। এ থেকেই তাকদির শব্দটি উৎপন্ন হয়েছে। দুই- সম্মান ও মহিমা। আরবি ভাষায় শব্দটি উভয় অর্থেই ব্যবহার হয়। শবে কদর বা লাইলাতুল কদর শব্দ দুইটি কুরআনেও এই দুই অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।

হাজার মাসের চেয়েও শ্রেষ্ঠআল্লাহ বলেন, এ রাত হাজার মাস থেকেও উত্তম। সময়ের গণনায় হাজার মাস সমান ৮৩ বছর চার মাস। শবে কদরের এক রাতের ইবাদত-বন্দেগি হাজার মাস তথা ৮৩ বছর ৪ মাস ইবাদত বন্দেগির সমান।

Advertisement

এ মর্যাদা দেওয়ার কারণ কী?লাইলাতুল কদরের অল্প সময় ইবাদতে অনেক সময় ইবাদতের সাওয়াব পাবে মুমিন মুসলমান রোজাদার। এর কারণ কী?আগের নবি-রাসুলদের উম্মতরা অনেক বেশি হায়াত পেত। অথচ উম্মতে মুহাম্মাদির হায়াত অন্য নবি-রাসুলের উম্মতদের তুলনায় অনেক কম। গড় হিসাব করলে দেখা যায়- সর্বোচ্চ ৭০-৮০ বছর। সুতরাং উম্মতে মুহাম্মাদি যদি লাইলাতুল কদর পেয়ে যায় তবে, অন্য নবি-রাসুলের উম্মতদের থেকে অনেক বেশি ইবাদত-বন্দেগি ও ক্ষমা প্রার্থনা সুযোগ পেয়ে ধন্য হবে। লাইলাতুল কদর পাওয়া গেলে সময় যেমন কম তেমনি মেহনতও কম। আবার এর প্রাপ্তি অনেক বেশি। আর এ কারণেই মহান আল্লাহ কুরআন নাজিলের উপলক্ষকে কেন্দ্র করে উম্মাতে মুহাম্মাদিকে দান করেছেন মর্যাদা ও বরকতের রাত ‘লাইলাতুল কদর’।

‘শবে কদর’ কোন রাতে?রমজানের মর্যাদা ও বরকত এবং ইবাদত-বন্দেগির প্রতি একনিষ্ঠ করতে লাইলাতুল কদরের সুনির্দিষ্ট তারিখ জানানো হয়নি। হাদিসের বিখ্যাত গ্রন্থ বুখারির এক বর্ণনায় এসেছে-‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে স্বপ্নের মাধ্যমে শবে কদরের নির্দিষ্ট তারিখের সন্ধান দেয়া হয়েছিল। তিনি উম্মতকে এই সুসংবাদ দেওয়ার জন্যই আসতে ছিলেন। এমতাবস্থায় রাস্তায় দুজন লোককে বিতর্ক করতে দেখা যায়। যার ফলে সেই নির্দিষ্ট রাতটির কথা তিনি ভুলে গেলেন।

মুহাদ্দিসিনে কেরাম বলেন, ‘ওই দুইজন ব্যক্তি হচ্ছে- হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে হাদরাদ এবং কাআব ইবনে মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু। কোনো একটা বিষয় নিয়ে তারা তর্ক করছিল। ফলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সে রাতের নির্দিষ্ট তারিখ চিরতরে ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে।

তবে নির্দিষ্ট তারিখ না বললেও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম লাইলাতুল কদর সম্পর্কে সুস্পষ্ট তথ্য দিয়েছেন। একাধিক হাদিসে সে বর্ণনা ওঠে এসেছে-> রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আমি কদরের রাতের সন্ধানে (রমজানের) প্রথম ১০ দিন ইতিকাফ করলাম। এরপর ইতিকাফ করলাম মধ্যবর্তী ১০ দিন। তারপর আমার প্রতি ওহি নাজিল করে জানানো হলো যে, তা শেষ ১০ দিনে রয়েছে। সুতরাং তোমাদের যে ইতিকাফ পছন্দ করবে, সে যেন ইতিকাফ করে। তারপর মানুষ (সাহাবায়ে কেরাম) তাঁর সঙ্গে ইতেকাফে শরিক হয়।’ (মুসলিম)

Advertisement

> > ‘তোমরা রমজানের শেষ দশকের বিজোড় রাতগুলোতে শবে কদরকে সন্ধান করো। (মুসলিম)। সে হিসেবে এ রাতগুলো হলো- ২১, ২৩, ২৫, ২৭ ও ২৯।।

> রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, 'রমজানের শেষ ১০ দিনে তোমরা কদরের রাত তালাশ কর।' (বুখারি)

> তাফসিরে মাজহারিতে এসেছে-

আরবিতে ‘লাইলাতুল কদর’ নয়টি শব্দে গঠিত। আর সুরা কদরে ‘লাইলাতুল কদর’ শব্দটি তিনবার এসেছে। ৯ কে ৩ দিয়ে গুণ করলে ২৭ হয়। তাই ২৭ রমজান শবে কদর হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

তবে একথা সুস্পষ্ট ও সত্য যে-শবে কদর সম্পর্কে আজও কোনো চূড়ান্ত তারিখ নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। শবে কদর নির্ধারণের ব্যাপারে চল্লিশের অধিক মতামত রয়েছে বলেছেন আল্লামা জালালুদ্দিন সুয়ুতি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি। তবে এসব মতামত থেকে সারকথা দুইভাবে বিভক্ত হয়েছে। তাহলো-> শবে কদর শুধু রমজান মাসেই সীমাবদ্ধ। যারা শবে কদরকে স্রেফ রমজান মাসেই সীমাবদ্ধ মনে করেন, তাদের কারোর মতামত হলো, শবে কদর শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোর যে কোনো একটিতে সংঘটিত হয়।অনেকে বলেন প্রত্যেক বেজোড় ৫ রাতের মধ্যে যে কোনো একটি নির্দিষ্ট রাতে সংঘটিত হবে লাইলাতুল কদর। যেমন- ২৫ তারিখে শবে কদর হলে প্রত্যেক বছর ২৫ তারিখেই নির্দিষ্ট হবে।

কেউ কেউ বলেন, প্রতি বছর একই তারিখে শবে কদর হওয়ার মতটি সঠিক নয়; বরং এক বছর ২৫ হলে পরের বছর ২১, ২৩, ২৭, ২৯ তারিখও হতে পারে।

তবে অনেক ইসলামিক স্কলারের মত হলো- শুধু রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রাতেই শবে কদর হবে, বিষয়টি এমন নয়। বরং পুরো রমজান মাসের যে কোনো রাতেই শবে কদর হতে পারে। হাদিসে এসেছে-হজরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে শবে কদর সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেছেন, এটি সমস্ত রমজানেই রয়েছে। তাদের মতে, রমজানের ১, ১৭ অথবা ১৯ তারিখে শবে কদর হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

> শবে কদর সারা বছরের যে কোনো রাতে হতে পারে।যারা বলেন, শবে কদর স্রেফ রমজান মাসেই সীমাবদ্ধ নয়, তাদের কাছে সারা বছরের যে কোনো মাসের যে কোনো রাতেই শবে কদর হতে পারে। এই মতের পক্ষে আছেন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ ও হজরত ইমাম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহিসহ অধিকাংশ কুফাবাসীর উলামায়ে কেরাম। তবে ইমাম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহির মতে শবে কদর অন্য মাস অপেক্ষা রমজান মাসেই সংঘটিত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

শবে কদরের তারিখ অনির্দিষ্ট কেন?আল্লাহ তাআলা আগেই এই মহিমান্বিত শবে কদরের এক মুহূর্ত ইবাদতকে হাজার মাসের ইবাদতের চেয়ে অধিক পূণ্যময় বলে ঘোষণা দিয়েছেন। এতে করে মানুষ শবে কদর পাওয়ার জন্য অদম্য বাসনায় নিমগ্ন থাকবে এবং অধিক মাত্রায় ইবাদত ও রিয়ারত করে নিজেকে আল্লাহর দরবারে সমর্পণ করবে। এরপর বান্দা আল্লাহর সন্তুষ্টি ও অফুরন্ত নেয়ামতসমূহ পেয়ে ধন্য হবেন।

তাই শবে কদরের তারিখ যদি নির্দিষ্ট ও জানিয়ে দেওয়া হতো তবে মর্যাদার এই রাতের গুরুত্ব কমে যেত এবং মানুষও সমস্ত ইবাদত-বন্দেগি ছেড়ে দিয়ে শুধু নির্ধারিত রাতেই ইবাদত-বন্দেগি করতো।

লাইলাতুল কদরের আলামাততবে লাইলাতুল কদরের সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণের ঘোষণা জানা না থাকলেও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সা্লাম এ রাতের কিছু লক্ষণ ঘোষণা করেছেন। তাহলো- হজরত জাবের রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আমাকে লাইলাতুল কদর দেখানো হয়েছিল, এরপর তা ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে, আর তা হচ্ছে শেষ দশকে। সে রাত হবে সাদা-উজ্জ্বল, নাতিশীতোষ্ণ হবে। না গরম, না ঠাণ্ডা। যেন আলোকিত চাঁদ নক্ষত্রগুলোকে আড়াল করে আছে। ফজর উদিত হওয়ার আগ পর্যন্ত সে রাতে শয়তান বের হতে পারে না।’ (মুসতাদরেকে হাকেম)

হাদিসের বর্ণনা অনুযায়ী বুঝা যায়, ‘লাইলাতুল কদরের নির্দিষ্ট তারিখ ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে, তবুও আমরা যাতে শবে কদর পেতে পারি, সে জন্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিছু আলামত বলে দিয়েছেন। এই সম্পর্কে অন্য হাদিসে এসেছে-হজরত কাআব রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসুলুল্লাহ ল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের কিছু আলামত বলে দিয়েছেন, আমরা তার মাধ্যমেই শবে কদরকে অনুধাবন করি। এরপর তিনি একটি আলামত বললেন যে, শবে কদরের দিন সূর্যের তাপ কম হবে। কারণ, লাইলাতুল কদরের রাতে অধিক সংখ্যক ফেরেশতার আগমন ও প্রত্যাবর্তনের কারণে সূর্য তাদের পাখার আড়ালে থেকে যায়, এ কারণে সূর্যের কিরণে তেমন তাপ থাকে না।’

এছাড়াও আরও কিছু আলামত রয়েছে। তাহলো-> সেই রাতের কুরআন তেলাওয়াত অন্য রাতের তুলনায় অধিক তৃপ্তিদায়ক হবে।> সেই রাতের ইবাদত-বন্দেগি অন্য রাতের তুলনায় অধিক একাগ্রতার সাথে হবে।> ইবনে হাজার আসকালানির মতে, সেই রাতে সমস্ত মাখলুক আল্লাহ পাকের সিজদারত থাকবে।> প্রত্যেক স্থানে নূরের জ্যোতি চমকাতে থাকবে।> অন্ধকারের মধ্যেও নূরের জ্যোতি বিদ্যমান থাকবে।> সেই রাতে ফেরেশতাদের সালাম ও কথাবার্তা শুনতে পাওয়া যাবে।> সেই রাতের শেষ ভাগে হালকা বৃষ্টি হয়ে থাকবে।

শবে কদরের আমল ও দোয়াআত্মশুদ্ধির মাস রমজান। মাসজুড়ে রহমত বরকত, মাগফেরাত ও নাজাতের মাধ্যমেই মুমিন মুসলমান আত্মশুদ্ধি অর্জনে সক্ষম হয়। আর এর পূর্ণতা আসে লাইলাতুল কদরের মর্যাদার রাতে। তাই এ রাতে মাধ্যকে সার্বিক কল্যাণ পেতে বেশি বেশি আমল ও দোয়ায় নিজেকে নিয়োজিত করা জরুরি। তাহলো-> আল্লাহর সন্তুষ্টি পেতে সাওয়াবের কাজে আত্মনিয়োগ করা।> বরকত পাওয়ার আশায় অল্প হলেও আর্থিক ত্যাগ ও কুরবানি স্বীকার করা।> বেশি বেশি কুরআন তেলাওয়াত করা। কারণ, এই রাতেই কুরআন নাজিল হয়েছিল।> বেশি বেশি দরুদ পাঠ করা।> বেশি বেশি জিকির-আজকার করা।> বেশি বেশি নফল নামাজ পড়া।> বিশেষ করে সালাতুত তাসবিহ আদায় করা।> এ রাত জেগে তাহাজ্জুদ পড়া।

মনে রাখা জরুরি, লাইলাতুল কদের নির্দিষ্ট নিয়ম ও রাকাআতে নামাজ পড়ার কোনো সুনির্ধারিত নিয়ম বা হুকুম নেই।

শবে কদর পেলে কী দোয়া পড়তে হবে এমন এক প্রশ্নে বিশ্বনবি সুস্পষ্ট বক্তব্য তুলে ধরেছেন। হাদিসে এসেছে-হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেন, আমি হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলাম, যদি আমি জানতে পারি অমুক রাত শবে কদর, তখন আমি কী দোয়া পড়বো? তিনি বললেন, এই দোয়া পড়বে-اللَّهُمَّ إِنَّكَ عُفُوٌّ تُحِبُّ الْعَفْوَ فَاعْفُ عَنِّيউচ্চারণ : ‘আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আউয়্যুন, তুহিব্বুল আফওয়া, ফাফু আন্নি।’অর্থ : হে আল্লাহ! নিশ্চয়ই আপনি ক্ষমাশীল। ক্ষমা করে দিতে ভালোবাসেন। সুতরাং আমাকে ক্ষমা করে দিন।

সুতরাং মুমিন মুসলমানের উচিত, পরিপূর্ণভাবে শবে কদরকে অনুসন্ধান করা। শবে কদর পেয়ে নিজেদের সৌভাগ্যশালী করে নেওয়া।

হে আল্লাহ! আপনি মুসলিম উম্মাহকে পবিত্র লাইলাতুল কদর দান করুন। মহামারি করোনা থেকে বিশ্ববাসীকে হেফাজত করুন। রমজানের রহমত বরকত মাগফেরাত ও নাজাত দানে প্রত্যেক রোজাদারকে ধন্য করুন। আমিন।

এমএমএস/এমএস