ফিচার

গরমে নাভিশ্বাস চরমে, সতর্ক হোন এখনই

বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে বাংলাদেশে তাপমাত্রা বাড়ায় অসহনীয় গরমে মানুষের হাঁসফাঁস অবস্থা। তার ওপর চরমে উঠেছে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ। সংক্রমণ এড়াতে এই গরমে ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম, মাস্ক, পিপিই, হ্যান্ড গ্লোভস ইত্যাদি ব্যবহার করতে হয়। কিন্তু এভাবে গরমে এসব ব্যবহারে মাইক্রোক্লাইমেট তৈরি হওয়ায় গরম অনুভবের পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

Advertisement

গরম, ঘাম আরও বেশি অনুভূত হচ্ছে। ইতোমধ্যে ঢাকায় তাপপ্রবাহে জনজীবনে দুর্ভোগ নেমে এসেছে। গরমে কাজ করা অসহনীয় হয়ে উঠেছে। গরমে রোদের তেজে পথ চলতে অতিষ্ঠ লাগে। একটু পরিশ্রমেই দেহজুড়ে নামে ক্লান্তি। সুস্থ মানুষের প্রাণ হাঁসফাঁস করে। ঘামে-ময়লায় নিজের শরীর, নিজের কাছেই চিটচিটে নোংরা লাগে। সব মিলিয়ে এক বিচ্ছিরি অবস্থা!

তাপমাত্রা কি আরও বাড়বে?এদিকে আবহাওয়া অধিদফতর বলছে, ঢাকায় সাত বছরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড উঠে এসেছে। সম্প্রতি তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে ৩৯.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। দেশের রংপুর বিভাগ ছাড়া প্রায় সব অঞ্চলেই তীব্র গরম অনুভূত হচ্ছে। সর্বোচ্চ ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে যশোরে। বাকি অঞ্চলগুলোর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাপমাত্রা ৩৭, ৩৮, ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন, ‘এই দুর্ভোগ এখনই কমছে না। তাপমাত্রা সবে তো বাড়তে শুরু করেছে মাত্র। আরও বাড়তে পারে। চলতি মাসেই তাপপ্রবাহ আরও ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়বে। থাকবে আগামী মাসের শুরু পর্যন্ত। এরপর কিছুটা ঝড়-বৃষ্টি হয়ে তাপমাত্রা কমে আসতে পারে বৈকি! তবুও কমবে না গরম। ঝড়-বৃষ্টি কমলে আবারও বাড়তে পারে তাপমাত্রা।

Advertisement

তাপমাত্রা যখন বিপজ্জনক যুক্তরাজ্যের আবহাওয়া অফিসের অধ্যাপক রিচার্ড বেটস হুঁশিয়ার করে বলেন, ‘জলবায়ুর পরিবর্তন মোকাবিলায় দ্রুত পদক্ষেপ না নেওয়া হলে বিশ্বের উষ্ণতম অঞ্চলগুলো আরও বেশি গরমের পরিস্থিতি দেখতে পারে। এই তাপ এখনকার চেয়ে প্রায় ৪ গুণ বেশি হবে। যা আমাদের জন্য হবে খুবই অসহনীয়। এতে ঝুঁকিতে পড়বে লাখ লাখ মানুষের জীবন।’ চলতি বছরের শুরুতে প্রকাশিত সমীক্ষায় সতর্ক করে এমন তথ্য দেওয়া হয়েছে। যাতে আরও বলা হয়েছে, ‘তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার ফলে ২১০০ সালের মধ্যে প্রায় ১০২ কোটি মানুষের জীবনে এর প্রভাব পড়বে।’

সমীক্ষায় বলা হয়, ‘আগামী দিনে বিশ্বে লাখ লাখ মানুষ গরমের বিপজ্জনক অবস্থায় পৌঁছে যাবে। তাপমাত্রা বিপজ্জনক মাত্রায় বাড়ায় অনেক মানুষ মারাও যেতে পারে।’ বিশেষ করে বিভিন্ন খামারের খোলা জায়গা, কারখানা, হাসপাতাল, বাড়ির ও দালানের ভেতরে কাজ করা মানুষদের মধ্যে হিট স্ট্রেস কিংবা হিট স্ট্রোকের প্রভাব বেশি পড়তে পারে। এসব এলাকায় বাতাসে আর্দ্রতা বেশি হওয়ায় মানুষের দেহ ঠিকভাবে ঠান্ডা হতে পারে না।’

বিজ্ঞানীরা বলেন, ‘মানুষের মগজের হাইপোথ্যালামাসে রয়েছে সুন্দর স্বয়ংক্রিয় কুলিং সিস্টেম বা তাপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। এই থার্মো রেগুলেশন সিস্টেমের বদৌলতে গরম খুব বাড়লেও আমাদের শরীরের তাপমাত্রা বাড়ে না। সব সময় একই থাকে। কোনো কারণে তাপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ভেঙে পড়লেই কেবল বাড়তে থাকে শরীরের তাপমাত্রা।’ শরীরের অতিরিক্ত তাপমাত্রা কমানোর জন্য মূল অঙ্গগুলো কাজ করতে না পারায় মূল অঙ্গগুলোর কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। তখন হিট স্ট্রেসের শুরু।

বিশেষজ্ঞের মতে, এসময়ে বাংলাদেশের আবহাওয়ায় আর্দ্রতা বেশি থাকায় অতিরিক্ত ঘাম হয়। এতে সবার শরীরের ভেতরের পানি সমতার ব্যাঘাত ঘটে। ফলে পানিশূন্যতার কারণে মাথা ব্যথা, দুর্বলতা, চামড়া খসখসে হওয়া, কাজে অমনোযোগিতা দেখা দেয়।’ গবেষকরা বলেন, ‘অতিরিক্ত গরম মানুষের জরুরি সিদ্ধান্ত নেওয়ার দক্ষতা কমিয়ে দেয়। যা মনোবলকে প্রভাবিত করে।’ গরমে তাই আট ঘণ্টার পুরো একটা শিফটে কাজ করা সত্যিই অস্বস্তিকর।

Advertisement

গরমে কী খাবেন?গরমের এই সময় শুধুমাত্র সতর্ক থেকে অনেক বিপদ এড়ানো যেতে পারে। হিট স্ট্রেস থেকে বাঁচতে, সর্বক্ষণ সতেজ থাকতে হলে কাজ শুরু করার আগে প্রচুর পরিমাণে পানি পান করে নিতে হবে। কাজে নিয়মিত বিরতি নেওয়া এবং বিশ্রাম নেওয়ার পরে আবার প্রচুর তরল পান করতে হবে। পুষ্টি বিজ্ঞানীদের মতে, ‘বারো থেকে পনেরো গ্লাস পরিমাণ পানি কিংবা পানীয় খাবার খেতে হবে। যার মধ্যে থাকতে পারে স্বাভাবিক পানি, ফলের রস, শরবত, লাচ্ছি, সফট ড্রিংকস, চা-কফি, তরমুজ, শসা ইত্যাদি।’ ক্যাফেইনড, কার্বোনেট পানীয় গ্রহণ থেকে বিরত থাকতে হবে এবং কম চিনি দিয়ে লেবুর সরবত, ডাবের পানি, জামের রস, জাম্বুরার জুস, লেবুর পানি বেশি বেশি গ্রহণ করতে হবে।

তাপ উৎপাদনকারী খাবার যেমন: পালং শাক, গোল মরিচ, মুলা, পেঁয়াজ, রসুন, বিট, আনারস, পাকা আম, নারকেল ইত্যাদি খাওয়া কমাতে হবে। অতিরিক্ত গরম মসলাযুক্ত, লবণাক্ত, চিপস, ভাজাপোড়া, ভাজি ইত্যাদি খাওয়া কমিয়ে চর্বি ছাড়া খাবার গ্রহণ করা স্বাস্থ্যসম্মত। তেলে ভাজা খাবার এই সময়ে হজমে সমস্যা তৈরি করতে পারে। এই থেকে পেটে গণ্ডগোলসহ ত্বকেও দেখা দিতে পারে নানারকম প্রদাহ। সবচেয়ে ভালো হয় প্রাণিজ উৎস বাদ দিয়ে উদ্ভিদ উৎস বিশেষ করে তাজা এবং কাঁচা সবজি খাওয়া। গরমে ডাল ও ডালের তৈরি খাবার বেশি খাওয়া ভালো। ছোলা সিদ্ধ, ছোলা ভাজা, মটরশুটি খেতে পারেন। কারণ এসবে রয়েছে অ্যাসেনশিয়াল ফ্যাটি অ্যাসিড। যা এ সময় শরীরের জন্য বেশ উপকারী।

গরমের খাদ্যতালিকায় টাটকা শাক-সবজি ও ফল-মূল নিয়মিত রাখা জরুরি। শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় ভিটামিন, ফ্লুইড, মিনারেলস ইত্যাদি সরবরাহ করে শাক-সবজি ও ফলমূল। প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় সালাদ রাখার চেষ্টা করুন। অতিরিক্ত মসলা জাতীয় খাবার এড়িয়ে চলুন। গরমের দিনগুলোতে গরু বা খাসির মাংস সপ্তাহে বড়জোর দু’দিন খেতে পারেন। তবে চর্বিযুক্ত মাংস এড়িয়ে চলতে হবে। মাছে-ভাতে বাঙালি, তাই মাছ তো খেতেই হবে। বড় মাছ খাওয়ার চেয়ে ছোট মাছ খাওয়া গরমে বেশি উপকারী। সপ্তাহে অন্তত একদিন মাছ-মাংস ছাড়া শুধু নিরামিষ খাওয়ার অভ্যাস করার চেষ্টা করুন। মিষ্টি বা মিষ্টি জাতীয় খাবার- গুড়, খেজুর, চিনি ও মধু যতোটা সম্ভব কম খাবেন। দুধ খেতে পারেন, তবে তা হতে হবে পাস্তুরাইজড অর্থাৎ ননীমুক্ত। গরমে অতিরিক্ত ঘাম থেকে পরিত্রাণের জন্য লেবু বা লেবু জাতীয় খাদ্য বেশি গ্রহণ করা স্বাস্থ্যসম্মত।

গরমে কী খাবেন না শরীর বিজ্ঞানীদের মতে, ‘গরমে পানির তৃষ্ণা পাওয়ার আগেই পানি পান করা উচিত। এতে শরীর থেকে অতিরিক্ত ফ্লুইড বের হয়ে পানিশূন্যতার সৃষ্টি করে শরীর অবশ হয় না।’ করোনাকালে মনে রাখা দরকার- যতই গরম লাগুক, এই গরমে বরফ ঠান্ডা পানীয় খাওয়া চলবে না। রোদ থেকে তেতে-পুড়ে এসে হঠাৎ করে ঠান্ডা পানি খাবেন না। বাথরুম, গোসলখানায় ঢুকবেন না। একটু জিরিয়ে নিয়ে পানি খান, গোসল করুন সমস্যা নেই। রোদ থেকে এসে দুম করে আইসক্রিম, কুলফি, ফ্রিজের ঠান্ডা পানি, বরফ পানি ভুলেও ছোঁবেন না। যেকোনো ঠান্ডা জ্বরকে ‘ভাইরাস ফিভার, আপন মনে সেরে যাবে’ এমন ভেবে বিপদ ডেকে আনবেন না। ব্যস্ততার মধ্যেও একটু সময় বের করে নিকটস্থ সরকারি হাসপাতালে যোগাযোগ করে অবশ্যই করোনাভাইরাসের টেস্ট করিয়ে নিন।

সতেজ থাকার উপায়এ ছাড়াও কিছু বিষয় আছে, যা অনুসরণ করলে গরমে সুস্থ, সতেজ থাকা সহজ হয়। যেমন- সকাল ১১টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত সূর্যের আলোর তীব্রতা বেশি থাকে। এ সময় রোদে ত্বকের ক্ষতি হয় এবং ত্বক পুড়ে যায়। এ সময় জরুরি কাজ না থাকলে বাইরে বের না হওয়াটাই ভালো। বাইরে বেরুলেও সরাসরি যেন সূর্যের আলো না পড়ে সেদিকে নজর দিতে হবে। যাতে সরাসরি রোদের মধ্যে থাকতে না হয়। তাই অবশ্যই ছাতা বা সানগ্লাস ব্যবহার করুন। এ সময় চওড়া কিনারাযুক্ত টুপি-ক্যাপও ব্যবহার করা যেতে পারে। একটানা রোদে হাঁটবেন না বা কাজ করবেন না। মাঝে-মধ্যে বিশ্রাম নিন।

যারা অফিসে কাজ করেন, তারা অফিসের কাজের সময় টেবিলে এক প্যাকেট টিস্যু রাখুন। শরীর ঘেমে গেলে টিস্যু দিয়ে ঘাম মুছে নিতে সুবিধে হয়। সব সময় সাদা বা হালকা রঙের ঢিলেঢালা সুতির কাপড়ের পোশাক পরুন। যারা মাঠে-ঘাটে কাজ করেন, তারা মাথায় মাথাল জাতীয় টুপি ব্যবহার করতে পারেন, যা রোদ থেকে রক্ষা করবে। যেকোনো ধরনের ব্যায়াম বা হাঁটার শুরুতে এবং শেষে পানি খেতে হবে। অতিরিক্ত গরম থেকে আসার পর, ঘরে রাখা স্বাভাবিক পানি দিয়ে অবশ্যই চোখে এবং নাকে ঝাপটা দিতে হবে। মুখের এবং শরীরের লালচে ভাব কমানোর জন্য একটু খোলা জায়গায় বসা, বাতাস করা যেতে পারে। কিছুক্ষণ পর এক গ্লাস মোটামুটি ঠান্ডা স্যালাইন পানি খেলে আরাম পাবেন।

করোনাকালীন এ গরমে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার প্রতি বেশি নজর দেওয়া উচিত। এ সময় শরীরে ঘাম বেশি হয়। শরীরে ঘাম আর ময়লা মিশে আঠালো অবস্থা তৈরি করে। এতে শরীরে ব্যাকটেরিয়ার উপদ্রব শুরু হয়। ব্যাকটেরিয়ার প্রভাবে ঘাম থেকে দুর্গন্ধের উৎপত্তি হয়। আর এ থেকে রক্ষা পেতে গরমে প্রতিদিন অন্তত দু’বার সাবান দিয়ে ভালো করে গোসল করা দরকার। গরমের দিনে মাথায় ময়লা ও ধুলোবালি জমে। এ থেকে শুরু হয় খুশকি। তাই অন্তত একদিন পরপর চুল শ্যাম্পু করে নিন।

গরমের সময় প্রসাধনী একটু ব্যবহার করতে হবে। যেমন- বাহুমূলে ব্যবহার করতে পারেন ডিওডোরেন্ট। অতিরিক্ত ঘাম থেকে রক্ষা পেতে হলে ট্যালকম পাউডার ব্যবহার করলে উপকৃত হবেন। এছাড়াও বডি স্প্রে ও পারফিউম ব্যবহার করে সজীব ও সতেজ থাকতে পারেন। বাইরে থাকলে অবশ্যই মাস্ক পরুন। হাঁচি-কাশির সময় নাক-মুখ ঢেকে রাখুন। ঠান্ডা ও ফ্লু আক্রান্ত মানুষ থেকে দূরে থাকুন। বাইরে থেকে এসে ২০ সেকেন্ড ধরে মুখমণ্ডল, হাত-পা ভালোভাবে ধোয়া নিশ্চিত করুন।

লেখক: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

এসইউ/এমকেএইচ