মো. শিব্বির আহমেদ তাশফিক
Advertisement
বাংলাদেশের পর্যটকদের কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় জায়গা সেন্টমার্টিন দ্বীপ। কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে ৯ কিলোমিটার দক্ষিণে নাফ নদীর মোহনায় দ্বীপটি অবস্থিত। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় ৫০০০ বছর আগে টেকনাফের মূল ভূমির অংশ ছিল জায়গাটি। তবে ধীরে ধীরে এটি সমুদ্রের নিচে চলে যায়।
এরপর প্রায় ৪৫০ বছর আগে বর্তমান সেন্টমার্টিন দ্বীপের দক্ষিণপাড়া জেগে ওঠে। এর ১০০ বছর পর উত্তরপাড়া এবং পরবর্তী ১০০ বছরের মধ্যে বাকি অংশটুকু জেগে ওঠে। প্রায় ২৫০ বছর আগে আরব বণিকদের নজরে আসে দ্বীপটি। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যের সময় আরব বণিকরা দ্বীপটিতে বিশ্রাম নিতেন বলে জানা যায়।
তখন তারা এ দ্বীপের নামকরণ করেন ‘জাজিরা’। পরবর্তীতে যেটি ‘নারিকেল জিঞ্জিরা’ নামে পরিচিতি পায়। বিভিন্ন কার্বন ডেটিংয়ের মাধ্যমে জানা যায়, প্রায় ৩৩ হাজার বছর আগে এলাকাটিতে প্রাণের অস্তিত্ব ছিল। ব্রিটিশ শাসনামল ১৯০০ সালে ভূমি জরিপের সময় দ্বীপটিকে ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্ভুক্ত করে নেয়। যদিও সে সময় বার্মা ব্রিটিশ শাসনের আওতায় ছিল। তারপরও সেন্টমার্টিন দ্বীপকে বার্মার অন্তর্ভুক্ত না করে ব্রিটিশ-ভারতের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল।
Advertisement
বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের ওয়েবসাইটের তথ্যানুযায়ী, খ্রিস্টান সাধু মার্টিনের নাম অনুসারে দ্বীপটির নামকরণ করা হয়। এরপর ১৮৯০ সালে কিছু মৎস্যজীবী এ দ্বীপে বসতি স্থাপন করে। এদের মধ্যে কিছু বাঙালি এবং রাখাইন সম্প্রদায়ের লোক ছিল। এরপর ধীরে-ধীরে এটি বাঙালি অধ্যুষিত এলাকা হয়ে ওঠে। কালক্রমে দ্বীপটি হয়ে ওঠে বাংলাদেশের পর্যটনের সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থানগুলোর মধ্যে একটি।
গবেষকদের একাংশ মনে করেন, দ্বীপটিকে যখন ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্ভুক্ত করা হয়; তখন চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মার্টিনের নাম অনুসারে দ্বীপটির নামকরণ করেন। স্বচ্ছ পানি ও চারপাশজুড়ে প্রবাল পাথরবেষ্টিত মনোলোভা দ্বীপটি যেন নৈসর্গিক।
বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণ-পূর্বে মিয়ানমার সীমান্তের পার্শবর্তী ৮.৩ বর্গকিলোমিটারজুড়ে এর অবস্থান। দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন সামুদ্রিক কাছিমের প্রজনন ক্ষেত্রও। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, সেন্টমার্টিনে ৬৮ প্রজাতির প্রবাল, ১৫১ প্রজাতির শৈবাল, ১৯১ প্রজাতির মোলাস্ক বা কড়ি-জাতীয় প্রাণি, ৪০ প্রজাতির কাঁকড়া, ২৩৪ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ, ৫ প্রজাতির ডলফিন, ৪ প্রজাতির উভচর প্রাণি, ২৮ প্রজাতির সরীসৃপ প্রাণি, ১২০ প্রজাতির পাখি, ২০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণি, ১৭৫ প্রজাতির উদ্ভিদ, ২ প্রজাতির বাদুড়সহ নানা প্রজাতির বসবাস ছিল।
এসব প্রাণির অনেকটাই এখন বিলুপ্তির পথে। জলবায়ু পরিবর্তনের কঠিন সময়ে তার ওপর আবার দূষণের কারণে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে এসব জীববৈচিত্র্য। সেন্টমার্টিন দ্বীপের পাশে ছেঁড়া দ্বীপ। এ দ্বীপের চারদিকে রয়েছে প্রবাল, পাথর, ঝিুনক, শামুকের খোলস, চুনা পাথরসহ প্রায় কয়েক শত প্রজাতির সামুদ্রিক জীব।
Advertisement
অতিরিক্ত পর্যটকের চাপ, যথেচ্ছাভাবে হোটেল-মোটেল নির্মাণ, নির্বিচারে গাছ কর্তন করে বন উজাড়, মানুষের মল-মূত্রসহ নানা বর্জ্য ও প্লাস্ট্রিক সামগ্রীর বর্জ্যে দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনের পরিবেশে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
এ ছাড়া পর্যটকদের চাহিদা মেটাতে গিয়ে বৈদ্যুতিক পাম্প দিয়ে প্রতিনিয়ত সেন্টমার্টিন স্তরের মিষ্টি পানি উত্তোলন, বহুতল ভবন নির্মাণ, ভবনের পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা এবং খোলা টয়লেট নির্মাণসহ নানা পরিবেশ বিধ্বংসী কর্মকাণ্ডে এখন হুমকির মুখে রয়েছে কোরালসহ জীববৈচিত্র্য।
৮.৩ বর্গ কিলোমিটারের দ্বীপটিতে স্থায়ী বাসিন্দার সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার। এ ছাড়া প্রতিদিন গড়ে আরও ১০ হাজার পর্যটক সেখানে অবস্থান করেন। এতে ২০ হাজার মানুষের চাপ নিতে হয় দ্বীপটিকে। এতে দ্বীপটি এতটাই সংকটাপন্ন হয়ে পড়ছে যে, হারাতে বসেছে তার রূপ-সৌন্দর্য। চারদিকের বাতাসে দুর্গন্ধ।
বলতে গেলে সেন্টমার্টিন তার জীববৈচিত্র্য খোয়াতে খোয়াতে এখন মুমূর্ষু হয়ে পড়েছে। সেন্টমার্টিন দ্বীপের ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর খুবই পাতলা। এখানে অতিরিক্ত পর্যটক আগমনের কারণে পর্যটন মৌসুমে অতি মাত্রায় সুপেয় পানি উত্তোলন করা হয়। যার কারণে দ্বীপের উত্তরে অর্ধশতাধিক নলকূপে লবণাক্ত পানি দেখা দিয়েছে।
সেন্টমার্টিন দ্বীপটি মূলত কোরাল দ্বীপ। এ দ্বীপ থেকে অপরিকল্পিতভাবে কোরাল আহরণ করা হয়। যা দ্বীপটির অস্তিত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ। ২০১৯ সালের শুরুর দিকের এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, পূর্ববর্তী সাত বছরে সেন্টমার্টিন দ্বীপের কোরাল রিফের ২৫ শতাংশই হারিয়ে গেছে।
মানবসৃষ্ট নানা প্রতিবন্ধকতায় এখানে গত পাঁচ বছরে নষ্ট হয়ে গেছে সামুদ্রিক কাছিমের ডিম দেওয়ার পরিবেশ। এতে সেন্টমার্টিনের স্থানীয় বাসিন্দাদের জীবনযাপনে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। প্রায় দেখা যায়, পর্যটকরা ছোট ছোট নুড়ি, শিলাপাথর, প্রবাল, শামুক-ঝিনুক কুড়িয়ে লুকিয়ে নিয়ে আসছেন, যা তদারকি করার কেউ নেই বললেই চলে।
এ ছাড়াও পর্যটকরা পরিবেশের বহুবিধ ক্ষতি করছেন। যেমন- পলিথিন, বিয়ারের ক্যান, কোমলপানীয় ও প্লাস্টিকের পানির বোতলসহ নানা ধরনের জিনিস ফেলছে দ্বীপে। অবস্থান নেওয়া পর্যটকরা রাতে বারবিকিউর আয়োজন করে উচ্চস্বরে গান বাজায়। ফলে দ্বীপে আশ্রয় নেওয়া প্রাণিকূল ভয়ে দূরে চলে যায়। এতে দ্বীপ প্রাণিশূন্য হয়ে পড়েছে।
জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ১৯৯৯ সালে সেন্টমার্টিন দ্বীপকে পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) ঘোষণা করে সরকার। সেন্টমার্টিন দ্বীপ পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা এবং সংবেদনশীল। এখানে যদি কোনো রকম পরিবেশগত বা যেকোনো কারণে বিপর্যয় হয়, তাহলে এটি পুনরুদ্ধার করা কঠিন কাজ হবে। দ্বীপটিকে রক্ষা করার জন্য প্রাকৃতিক যে অবয়ব ছিল, তা যদি ব্যাহত হয় তাহলে দ্বীপের বিপর্যয় হবেই।
সমুদ্রের জীববৈচিত্র সংরক্ষণে কাজ করছে সেভ আওয়ার সী এবং ওয়াইল্ডলাইফ কনজারভেশন সোসাইটি নামক বেশকিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো বারবার সতর্ক করছে। তারপরও এ নিয়ে কপালে চিন্তার ভাঁজ নেই অনেকেরই। দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতিও দেখা যায় না।
সমুদ্র নিয়ে প্রায় ১৮টি মন্ত্রণালয় কাজ করার পরও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের এ বিষয়ে সঠিক ধারণা না থাকায় এবং সমন্বয়হীনতার কারণে কোনো কাজই হচ্ছে না। সে কারণে বাংলাদেশ সমুদ্র সীমানা জয় করলেও সমুদ্রের সুফল পাচ্ছে না। চোখে পড়ছে না বড় কোনো অর্জন। তাই সমুদ্র বাঁচাও আন্দোলন এখন সময়ের দাবি।
স্কুল, কলেজের সিলেবাসে বাধ্যতামূলক থাকা চাই সমুদ্র পরিচিতি। তা করা গেলে সেন্টমার্টিন ভ্রমণে গিয়ে সমুদ্রের সঙ্গে কী আচরণ করতে হবে তরুণ প্রজন্ম তা জানবে। তখন প্যাকেট, পলিথিন, বোতল, পণ্য, ক্যানসহ বিভিন্ন বর্জ্যব্যবস্থাপনার কাজ নিজেরাই করতে শিখবে। বজায় থাকবে ইকোসিস্টেম।
অনেক সময় বিদেশি পর্যটকদের সমুদ্রে এসে পরিচ্ছন্নতার কাজ করতে দেখা যায়। অথচ ভিন্ন চিত্র আমাদের বেলায়। অজ্ঞতাই এখানে প্রধান কারণ। তাই সমুদ্র বাঁচাতে এখনই সোচ্চার হতে হবে দেশের কোটি শিক্ষিত যুব সমাজকে। এজন্য জরুরি কিছু তথ্যও জেনে রাখা দরকার।
প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন জীববৈচিত্র সমৃদ্ধ অঞ্চল। তবে পরিবেশবাদী কিছু সংগঠন ছাড়া এর অযত্ন ও অবহেলা নিয়ে কাউকে চিন্তিত দেখা যায় না। সেন্টমার্টিন দ্বীপের প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য রক্ষায় যেকোনো ধরনের প্লাস্টিক মোড়কজাত খাবার, ক্যান এবং প্লাস্টিক বোতলসহ প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হওয়া জরুরি।
সেন্টমার্টিন দ্বীপ ও ছেড়া দ্বীপের আন্ডার ওয়াটার ক্লিনিংয়ের জন্য পানির নিচে যে প্লাস্টিক ও অন্যান্য ময়লা রয়েছে। তা নিয়মিত পরিস্কার করা উচিত। পর্যটকদের আগমনকে নিরুৎসাহিত না করে বরং সুন্দর নীতিমালা প্রণয়নের মাধ্যমে সেন্টমার্টিন দ্বীপকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে হবে কর্তৃপক্ষকে। তবে সম্প্রতি সেন্টমার্টিন ভ্রমণে নতুন করে কিছু বিধি-নিষেধ আরোপ করেছে সরকার। দ্বীপটিকে ‘প্রতিবেশগত সঙ্কটাপন্ন’ এলাকা ঘোষণা করে এক গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে পরিবেশ অধিদফতর। এটি বাস্তবায়ন হলেই তবে সেন্টমার্টিন দ্বীপ টিকে থাকবে শত-হাজার বছর। রক্ষা পাবে জীববৈচিত্র্যও।
জেএমএস/এসইউ/জেআইএম