মানসিক স্বাস্থ্য হলো আমাদের মন, আচরণগত ও আবেগপূর্ণ স্বাস্থ্যের অপরিহার্য এবং অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। আমরা কী চিন্তা করি, কী অনুভব করি এবং জীবনকে সামলাতে আমাদের চিন্তা-চেতনা কীভাবে ব্যবহার করি- এগুলোই আসলে আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের অর্থবহ অংশ। একজন মানসিকভাবে সুস্থ মানুষ নিজের সম্পর্কে যথাযথ ধারণা রাখেন এবং কখনোই মাত্রাতিরিক্ত আবেগ, যেমন রাগ, ভয়, হিংসা, অপরাধবোধ বা উদ্বেগ দ্বারা আবিষ্ট হন না। জীবনে যখন যেরকম পরিস্থিতি উদ্ভুত হয়, তা সামলে নেওয়ার ক্ষমতা তারা রাখেন।
Advertisement
মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা শুধু বাংলাদেশেই নয় বরং বিশ্বব্যাপী একটি ক্রমবর্ধমান সামাজিক ও স্বাস্থ্য সমস্যা। মানসিক স্বাস্থ্য কোনো অংশেই শারীরিক স্বাস্থ্যের চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। শারীরিক সুস্থতার ক্ষেত্রে কেউ সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হলে তার পরিপূর্ণ কর্মশক্তি থাকে এবং তিনি ভালো কাজে আত্মনিয়োগ করতে পারেন। একই রকমভাবে কেউ মানসিকভাবে সুস্থ থাকলে তিনিও পূর্ণোদ্যমে অনেক ভালো কাজ করতে পারেন। অর্থাৎ পরিপূর্ণ সুস্থতার জন্য শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য উভয়েরই সুস্থতার সংযোগ আবশ্যক। একে অবহেলা করে কখনোই সামগ্রিক সুস্থতা অর্জন করা সম্ভব নয়। শারীরিক রোগ-ব্যাধি যেমন ব্যক্তির শারীরিক স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করে; তেমনই ব্যক্তি যখন বিভিন্ন নেতিবাচক আবেগ, যেমন- উদ্বেগ বা ভয় দ্বারা আবিষ্ট থাকেন; তখন এই আবেগগুলো তাকে মানসিকভাবে অসুস্থ করে দিতে পারে, যেমন- ডিপ্রেশন বা বিষণ্নতা, জেনারেল অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার বা সাধারণ উদ্বেগজনিত ব্যাধি, বাইপোলার মুড ডিসঅর্ডার, অবসেসিভ কমপালসিভ ডিসঅর্ডার প্রভৃতির আবির্ভাব।
পরিতাপের বিষয় এবং বাস্তবতা হচ্ছে- আমরা শরীরের সুস্থতা নিয়ে যতটা উদ্বিগ্ন থাকি এবং সুস্থতার ব্যাপারে যতটা নজর রাখি, মনের সুস্থতার ব্যাপারে আমরা যেন ঠিক ততটাই উদাসীন। বয়স্ক মানসিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মধ্যে ৯২.৩ শতাংশ নানা কারণে মানসিক চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত। শিশু-কিশোর বয়সী মানসিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ৯৪.৫ শতাংশই চিকিৎসাসেবার আওতার বাইরে। এমনকি যেসব শিশু-কিশোর মানসিক প্রতিবন্ধিতার চিকিৎসা পায়, তাদের প্রায় ২৯.২ শতাংশেরই চিকিৎসা অসম্পূর্ণ থেকে যায়।
নিবিড় এবং নিগূঢ় সত্য হলো, সুস্থ শরীর ছাড়া যেমন সুস্থ মন সম্ভব নয়; তেমনই সুস্থ মন ছাড়া সুস্থ শরীর এবং সুস্থ জীবন কোনোটাই সম্ভব নয়। একবার ভেবে দেখুন তো- শারীরিক অসুখ নিয়ে আমরা যেমন অস্থির ও অধীর হয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নেই; মনের অসুখ নিয়ে বা মনের সমস্যা নিয়ে আমরা আদৌ মানসিক ডাক্তারের কাছে যাই না। এজন্য আসলে দায়ী মন, মনের সমস্যা ও মানসিক ব্যাধি সম্পর্কে আমাদের অজ্ঞতা ও উদাসীনতা। শরীরের অসুখের মতোই মনেরও যে অসুখ হতে পারে, সে সম্পর্কে অধিকাংশই স্পষ্ট ধারণা রাখেন না।
Advertisement
আবার অনেকে মনে করেন, মানসিক রোগ মানেই পাগল; সাইকিয়াট্রিস্ট মানেই পাগলের ডাক্তার। ব্যাপারটা কিন্তু আদৌ সে রকম নয়। মানসিক রোগ মানেই পাগল নয় এবং মানসিক রোগের ডাক্তার মানেই পাগলের ডাক্তার নন। মানসিক ব্যাধিগুলোকে মূলত দুই ভাগে ভাগ করা যায়- গুরু মানসিক ব্যাধি এবং লঘু মানসিক ব্যাধি। সাধারণভাবে যাদের আমরা পাগল বলে আখ্যায়িত করি, তারা সবাই গুরু মানসিক ব্যাধির অন্তর্ভুক্ত এবং এ সংখ্যা খুবই কম। বাংলাদেশে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে মানসিক রোগে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ১৬.০৫ শতাংশ, এর মাঝে গুরু মানসিক ব্যাধিতে মাত্র ১ শতাংশ এবং বাকিরা সবাই লঘু মনসিক ব্যাধি, যেমন- বিষণ্নতা, উদ্বেগ, মানসিক চাপজনিত মানসিক ব্যাধি ইত্যাদিতে আক্রান্ত এবং এরা কেউ-ই পাগল নন। এদের সবারই চিকিৎসা করেন সাইকিয়াট্রিস্ট বা মানসিক চিকিৎসক।
এ ছাড়া রয়েছে মানসিক ব্যাধি সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা বা বিশ্বাস এবং সোশ্যাল স্টিগমা। বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশেই অনেক মানুষের ধারণা বা বিশ্বাস, মানসিক ব্যাধির মূলে আছে জ্বিন-ভূতের কারসাজি, ব্ল্যাক ম্যাজিক, জাদুটোনা বা কুফরি-কালাম ইত্যাদি। ফলে তারা এখনো এর চিকিৎসা খোঁজেন ঝাড়-ফুঁক, তাবিজ-কবজ প্রভৃতির মাধ্যমে। অথবা চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলেও বেশিরভাগ রোগীই লুকিয়ে কিংবা অনেক সাবধানতা অবলম্বন করে সাইকিয়াট্রিস্টের সাহায্য নিতে আসেন।
শরীর ফিট রাখার জন্য আমরা নিয়মিত হাঁটা, ব্যায়াম, জিমে যাওয়া, ডায়েট কন্ট্রোল ইত্যাদি কত কিছুই না করি। কিন্তু মনকে ফিট রাখার জন্য এবং মনের সুস্বাস্থ্যের জন্য কি আদৌ আমরা কিছু করি? অনেকে হয়তো মেডিটেশন, ইয়োগা ইত্যাদি করে থাকেন। কিন্তু কেবল এগুলোই পর্যাপ্ত নয়। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, প্রতিদিনই আমরা কিন্তু শারীরিক সমস্যা অনুভব করি না, যেমন- প্রতিদিনই একজন মানুষের জ্বর হয় না বা শরীরে ব্যথা হয় না। তবে এমন কোনো দিন নেই, যে দিন আমরা কোনো না কোনো মানসিক সমস্যার লক্ষণ অনুভব করি না। যেমন প্রতিদিনই কোনো না কোনো সময় আমরা নানা কারণে উদ্বিগ্ন হই, বিষণ্নতা অনুভব করি, মানসিক চাপ অনুভব করি কিংবা উত্তেজিত হই। এগুলো সবই মানসিক সমস্যার লক্ষণ।
আবার এটাও মনে রাখতে হবে, এগুলো অনুভব করা মানেই যে কেউ মানসিক রোগী, তা কিন্তু নয়। এগুলো কিছুটা সময়ের জন্য হলেও আপনার মানসিক স্থিতিশীলতা নষ্ট করে। বাস্তবতা হলো, পৃথিবীতে বসবাস করতে গেলে এ ধরনের সমস্যা মোকাবিলা করতেই হবে। প্রতিদিনই নানা রকম জাগতিক সমস্যা ও জটিলতার মধ্য দিয়ে জীবনযাপন করতে হয়। যেহেতু প্রতিদিনই নানা রকম সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়; সেগুলোর সুন্দর সমাধানের জন্য অবশ্যই মনের স্থিতিশীলতা প্রয়োজন। মনের স্থিতিশীলতা-অস্থিতিশীলতা আবার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নির্ভর করে চিন্তার প্রক্রিয়ার ওপর। দৈনন্দিন জীবনযাপনকে সুন্দর করতে হলে মানসিক স্বাস্থ্যের স্থিতিশীলতা অতীব জরুরি। শরীরকে ফিট রাখার জন্য যেমন আমরা বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করি; তেমনই মনের ফিটনেসের জন্যও আমাদের কিছু বিষয় মেনে চলা জরুরি।
Advertisement
ভালো থাকা, সুন্দর থাকা এবং শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন করা একটি চর্চার বিষয়। তাই জীবন সংসারে আনন্দে থাকার অভ্যাস তৈরি করুন। সাধ্যের মধ্যে থাকা শখগুলোকে সব সময় উজ্জীবিত রাখুন। একটি সুন্দর শখের মৃত্যু মানে একটা মননশীল মানুষের মৃত্যু। দিনের মধ্যে কিছু সময় প্রতিদিন নিয়মিতভাবে ব্যায়ামের জন্য বরাদ্দ রাখুন। এ ছাড়া প্রতিদিন নিজের জন্য কমপক্ষে ৩০ মিনিট সময় রাখুন, যে সময়টায় আপনি আপনাকে মূল্যায়ন করতে পারবেন। একটি বিষয় ঠিক, সমস্যামুক্ত জীবনের কথা কল্পনা করা অসম্ভব। যতদিন কেউ পৃথিবীতে জীবিত থাকবেন, সমস্যা তার জীবনে থাকবেই। কিন্তু নিজের মতো করে এগুলো মোকাবেলা করতে হবে। সবগুলোতেই যে নিজেকে সফল হতে হবে এমন কোনো কথা নেই, কারণ জীবন শুধু সফলতাই নয়। সফলতা-বিফলতার সমন্বয়েই জীবন। এ সত্য স্বীকার করতেই হবে। এ প্রত্যয় নিয়েই প্রতিদিন নিজের কাজ শুরু করতে হবে।
তবে মনের সমস্যার কারণে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হলে অর্থাৎ চিন্তাধারা, মনের সমস্যা প্রভৃতি পারিবারিক, সামাজিক, কর্মজীবন, শিক্ষাজীবন ইত্যাদি জীবনের নানা ক্ষেত্র ব্যাহত করলে অবশ্যই সব সামাজিক বাঁধার ঊর্ধ্বে উঠে এর চিকিৎসা করাতে হবে- প্রয়োজনে মানসিক চিকিৎসকের সাহায্য নিতে হবে। কারণ এ অবস্থা চলতে থাকলে উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় জীবন একদিন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে। যদি আপনার কাছের মানুষ, আত্মীয়-স্বজন বা বন্ধু-বান্ধবদের কারো মাঝে হঠাৎ করে আচরণের কোনো লক্ষণীয় পরিবর্তন দেখতে পান অথবা মানসিক রোগের কোনো লক্ষণ তাদের মধ্যে লক্ষ্য করেন, তবে আন্তরিকতার সঙ্গে তাকে সাইকিয়াট্রিস্টের শরণাপন্ন হতে পরামর্শ দিন। সম্ভব হলে নিজে তাকে নিয়ে যেতে পারেন মানসিক চিকিৎসকের কাছে। এ ব্যাপারে তার মধ্যে কোনো ভয়-ভীতি কাজ করলে, তা ঝেরে ফেলতে তাকে পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করুন। পরিপূর্ণ এবং সঠিক চিকিৎসার জন্য মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত রোগীকে সাইকিয়াট্রিস্টের পরামর্শ মতো নিয়মিত ফলোআপে থাকাও জরুরি।
সচেতনতা এবং সম্মিলিত প্রচেষ্টায় মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি সম্ভব। কমিউিনিটি বেইজড মেন্টাল হেলথ সার্ভিস প্রকল্প এ ক্ষেত্রে রোল মডেল হতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুসারে, প্রতি ৪০ সেকেন্ডে কেউ না কেউ আত্মহত্যার কারণে প্রাণ হারান। আর অধিকাংশ ব্যক্তিরই আত্মহত্যার কারণ মানসিক বিপর্যস্ততা বা মানসিক রোগে আক্রান্ত হওয়া। তাই এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি এড়িয়ে সার্বিক সুস্থতা অর্জনের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।
এসইউ/এমএস