যুগে যুগে পক্ষ-বিপক্ষ বিবাদ ছিল। তা এখনও আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। তাই তো যে কোনো তর্ক-বিবাদ যদি এমনিতে মীমাংসিত না হয় তবে মুবাহালার মাধ্যমে সমাধান খোঁজার ঘোষণা এসেছে কুরআনে। যে সমাধানে কোনো ব্যক্তির হাত নেই। সবই হবে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে। এ সম্পর্কে কুরআনুল কারিমে এসেছে-إِنَّ مَثَلَ عِيسَى عِندَ اللّهِ كَمَثَلِ آدَمَ خَلَقَهُ مِن تُرَابٍ ثِمَّ قَالَ لَهُ كُن فَيَكُونُ - الْحَقُّ مِن رَّبِّكَ فَلاَ تَكُن مِّن الْمُمْتَرِينَ - فَمَنْ حَآجَّكَ فِيهِ مِن بَعْدِ مَا جَاءكَ مِنَ الْعِلْمِ فَقُلْ تَعَالَوْاْ نَدْعُ أَبْنَاءنَا وَأَبْنَاءكُمْ وَنِسَاءنَا وَنِسَاءكُمْ وَأَنفُسَنَا وأَنفُسَكُمْ ثُمَّ نَبْتَهِلْ فَنَجْعَل لَّعْنَةُ اللّهِ عَلَى الْكَاذِبِينَ - إِنَّ هَـذَا لَهُوَ الْقَصَصُ الْحَقُّ وَمَا مِنْ إِلَـهٍ إِلاَّ اللّهُ وَإِنَّ اللّهَ لَهُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ - فَإِن تَوَلَّوْاْ فَإِنَّ اللّهَ عَلِيمٌ بِالْمُفْسِدِينَ নিঃসন্দেহে আল্লাহর কাছে ঈসার দৃষ্টান্ত হচ্ছে আদমের মতোই। তাকে মাটি দিয়ে তৈরি করেছিলেন এবং তারপর তাকে বলেছিলেন- ‘হয়ে যাও’, সঙ্গে সঙ্গেই হয়ে গেলেন। যা তোমার পালনকর্তা বলেন তাই হচ্ছে যথার্থ সত্য। কাজেই তোমরা সংশয় প্রকাশ করো না। অতপর তোমার কাছে সত্য সংবাদ এসে যাওয়ার পর যদি এই কাহিনী সম্পর্কে তোমার সঙ্গে কেউ বিবাদ করে, তবে বল-এসো! আমরা ডেকে নেই আমাদের পুত্রদের এবং তোমাদের পুত্রদের এবং আমাদের স্ত্রীদের ও তোমাদের স্ত্রীদের এবং আমাদের নিজেদের ও তোমাদের নিজেদের আর তারপর চল আমরা সবাই মিলে প্রার্থনা করি এবং তাদের প্রতি আল্লাহর অভিসম্পাত করি; যারা মিথ্যাবাদী। নিঃসন্দেহে এটাই হলো সত্য ভাষণ। আর এক আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো ইলাহ নেই। আর আল্লাহ; তিনিই হলেন মহাপরাক্রমশালী মহাপ্রজ্ঞাময়। তারপর যদি তারা গ্রহণ না করে, তাহলে ফাসাদ সৃষ্টিকারীদের আল্লাহ জানেন। (সুরা আল-ইমরান : আয়াত ৫৯-৬৩)
Advertisement
আয়াতের ব্যাখ্যামূলক অনুবাদআলোচ্য আয়াতে কিয়াসের বিষয়টি উঠে এসেছে- নিশ্চয়ই হজরত ঈসা আলাইহিস সালামের বিস্ময়কর অবস্থা আল্লাহ তাআলার কাছে হজরত আদম আলাইহিস সালামের মতো। তিনি (ঈসা আলাইহিস সালামকে পিতা ছাড়া সৃষ্টি করেছেন। যেভাবে) আদম আলাইহিস সালামকে পিতা-মাতা ছাড়া মাটি দিয়ে তৈরি করেছেন। আর তাকে (আদম আলাইহিস সালামের কাঠামোকে) আদেশ করেছেন- ‘(প্রাণী হয়ে যাও’ আর এতে তিনি (জীবন লাভ করে) হয়ে গেলেন। এ বাস্তব ঘটনা আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে। সুতরাং (হে নবি!) আপনি সন্দেহবাদীদের অন্তর্ভূক্ত হবেন না।অনন্তর (হে নবি!) আপনার কাছে যে জ্ঞান এসেছে, তারপরও ঈসা আলাইহিস সালাম সম্পর্কে যদি আপনার সঙ্গে কেউ বাদানুবাদ করে, আপনি তাদের বলে দিন-‘যদি যুক্তি প্রমাণে কাজ না হয় তবে এসো, আমরা ও তোমরা ডেকে নেই, আমাদের সন্তান-তোমাদের সন্তানদের; আমাদের নারী-তোমাদের নারীদের; আর স্বয়ং আমাদের নিজেদের ও তোমাদের নিজেদের।অতপর সবাই মিলে আল্লাহর কাছে এমর্মে প্রার্থনা করি-(এ আলোচনায়) যারা সত্যবাদী নয়, তাদের প্রতি আল্লাহর অভিশাপ নেমে আসুক। নিশ্চয়ই এটাই সত্য বিবরণ। আর আল্লাহ ছাড়া কেউ উপাস্য হওয়ার উপযুক্ত নয়। মহান আল্লাহ তাআলাই মহাপরাক্রমশালী ও মহাপ্রজ্ঞাময়।তারপরও যদি তারা (বাদানুবাদকারীরা) সত্য গ্রহণে বিমুখ হয়; তবে (হে নবি!) আপনি বিষয়টি আল্লাহর দরবারে সমার্পণ করুন। কেননা নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা দুষ্কৃতকারীদের সম্পর্কে অবগত। (তাফসিরে মাআরেফুল কুরআন)
আয়াতের প্রাসঙ্গিক আলোচ্য বিষয়প্রথমত : আল্লাহ তাআলা এ আয়াতে কারিমাগুলোর শুরুর দিকে কিয়াসের বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন। আর তা হজরত ঈসা আলাইহিস সালামের সৃষ্টি হজরত আদম আলাইহিস সালামের মতোই ছিল বলে উল্লেখ করেছেন।
দ্বিতীয়ত : আল্লাহ তাআলা বাদানুবাদকারী তথা বাড়াবাড়ি করা ব্যক্তিদের ব্যাপারে মুবাহালার বিষয়টি সুস্পষ্ট করেছেন। যারা যুক্তি বা ইনসাফ মানতে রাজি নয়, তারা উভয় পক্ষ আল্লাহর কাছে সত্যবাদী ও মিথ্যাবাদী হওয়া সাপেক্ষে অভিশাপ কামনা করবে। যারা মিথ্যাবাদী হবে তাদের উপরই নেমে আসবে মহান আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে অভিশাপ। আর সত্যবাদীরা মুক্তি পেয়ে যাবে।
Advertisement
মুবাহালার ঐতিহাসিক পটভূমিআল্লাহ তাআলা প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে মুবাহালা করার নির্দেশ দিয়েছেন। মুবাহালার সংজ্ঞা-‘যদি সত্য-মিথ্যার ব্যাপারে দুই পক্ষের মধ্যে বাদানুবাদ হয় এবং যুক্তির মাধ্যমে মীমাংসা না হয়, তবে তারা সবাই মিলে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করবে, যে পক্ষ এ ব্যাপারে মিথ্যাবাদী, সে যেন ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। এখানে লানতের অর্থ হলো- আল্লাহর রহমত থেকে দূরে সরে পড়া। আর আল্লাহর রহমত থেকে দূরে সরে পড়ার মানেই আল্লাহর ক্রোধের কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়া। অর্থাৎ মিথ্যাবাদীদের ওপর আল্লাহর কো্রাধ বর্ষিত হোক।এ মীমাংসার পর যারা মিথ্যাবাদী, সে তার প্রতিফল ভোগ করবে। সে সময় সত্যবাদী ও মিথ্যাবাদীর পরিচয়ও অবিশ্বাসীদের দৃষ্টিতে স্পষ্ট হয়ে উঠবে। আর এভাবে প্রার্থনা করাকে ‘মুবাহালা’ বলা হয়।
মুবাহালার ঘটনারাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একবার নাজরানের খ্রিস্টানদের কাছে একটি ফরমান পাঠান। তাতে ধারাবাহিকভাবে তিনটি দিকনির্দেশনা ও বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। তাহলো-- ইসলাম কবুল করা। অথবা- জিজিয়া কর দেয়া। অথবা- যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হওয়া।
অতপর খ্রিস্টানরা পরামর্শের আলোকে এ বিষয়ে কথা বলার জন্য শোরাহবিল, আব্দুল্লাহ ইবনে শোরাহবিল এবং জিরাব ইবনে ফয়েজকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে পাঠান।
তারা এসে ধর্মীয় বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা শুরু করে। এক পর্যায়ে তারা হজরত ঈসা আলাইহিস সালামকে উপাস্য প্রতিপন্ন করার জন্য প্রবল বাদানুবাদের আশ্রয় নেয়। তখনই আল্লাহর পক্ষ থেকে ‘মুবাহালা’র এ আয়াত নাজিল হয়।
Advertisement
তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বাদানুবাদের সমাধানকল্পে তাদেরকে ‘মুবাহালা’র জন্য আহ্বান জানান। আর তিনি নিজেও হজরত ফাতেমা, আলি, ইমাম হাসান, হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুম আজমাঈনকে নিয়ে ‘মুবাহালা’য় অংশগ্রহণের জন্য প্রস্তুত হয়ে যান।
‘মুবাহালা’র মাধ্যমে সমাধানকল্পে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ আত্মবিশ্বাস দেখে দলনেতা শোরাহবিল ভয় পেয়ে যান। আর তার সঙ্গীদের বলতে থাকেন-‘তোমরা জান যে, ইনি আল্লাহর নবি। আল্লাহর নবির সঙ্গে মুবাহালা করলে আমাদের ধ্বংস অনিবার্য। তাই মুক্তির জন্য অন্য কোনো পথ খুঁজে বের কর।’
সঙ্গীদ্বয় বলতে থাকে- তোমার মতে মুক্তির উপায় কী?সে বলল- নবির (রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের) শর্তানুযায়ী সন্ধি করাই উত্তম উপায়। অতপর তারা (খ্রিস্টান প্রতিনিধিদল) এতেই সম্মত হয়। আর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের উপর জিজিয়া কর ধার্য করে মীমাংসায় উপনীত হন।’ (ইবনে কাসির)
ইসলাম দিয়েছে মুমিন মুসলমানকে সুন্দর ও উত্তম সমাধান। যে সমাধান নিজেদের মধ্যে বাস্তবায়ন করলেই সাফল্য আসবে সুনিশ্চিত।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে কুরআনের সুন্দর ঘটনা ও সমাধানের মাধ্যমগুলো জানার তাওফিক দান করুন। কুরআনের বিধানের উপর যথাযথ আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
এমএমএস/এমকেএইচ