এদেশ খুন করলে বেঁচে থাকা যায়, লেখালেখি করলে মরে যেতে হয়। এমন একটি ধারণা প্রায় প্রতিষ্ঠিত হতে চলেছে, যা সুস্থভাবে চলার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এর কারণ হলো একের পর এক ধর্মনিরপেক্ষ লেখককে, এবং সর্বশেষ একজন প্রকাশককে হত্যার পর এমনভাবে ভাবতে শুরু করেছে মানুষ। সরকারে যারা আছেন আর যারা বিরোধী দলে আছেন, তারা কেউই ঘটনাসমূহের গভীরে না গিয়ে একে অন্যকে দোষ দিয়ে রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়ে চলেছেন। এরা একবারও কি ভাবছেন এই ‘ব্লেম গেম’ বা দোষারোপের রাজনীতির খেলায় আরামে দিন পার করছে বা পার পেয়ে যাচ্ছে প্রকৃত অপরাধীরা? এই অতিরিক্ত ব্লেম গেমের সংস্কৃতিতে প্রকৃত অপরাধীদের দিক থেকে রাষ্ট্রের আইন শৃঙ্খলা বাহিনী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের মনোযোগ অন্য দিকে ঘুরে যাচ্ছে। সরকারে যারা থাকেন যখন এ ধরনের ঘটনায় বিচার করতে ব্যর্থ হন তারা তখন এই ব্লেম গেমের আশ্রয় নেন। আর বর্তমানে বিরোধী অবস্থানে থাকা বিএনপিও সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে নানা কথা বলছে, একারণে যে যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিষয়ে দলটি এখনো তার অবস্থান পরিষ্কার না করে সম্পৃক্ততা রেখেছে মৌলবাদি প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক গোষ্ঠির সাথে যারা এই খুন খারাবির রাজনীতি করে। সরকার বিচার না করলে পুলিশ যতই তদন্তের কথা বলুক মানুষ তাতে আস্থা রাখতে পারে না। রাজীব হায়দারকে হত্যার পর নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ ছাত্রকে ধরার পর থেকে আর একজন ব্লগারের হত্যার কোনো কূল-কিনারা করতে পারেনি পুলিশ। লেখক ওয়াশিকুর রহমান বাবুর হত্যাকারিরা হাতেনাতে ধরা পড়ার পর, ধারণা করা হয়েছিলো পুরো চক্রটিরই হদিস মিলবে। বের হয়ে আসবে হত্যাকারিদের পরিচয়। কিন্তু হিজড়া সম্প্রদায়ের সদস্যরা যে দুজনকে হাতেনাতে আটক করেছিলো, তাদের বাইরে আর কাউকেই গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। পলাতক তিন আসামির নাম ঠিকানাও জানা যায়নি। এমনি অসমাপ্ত তদন্তের মধ্যেই মামলাটির অভিযোগপত্র দাখিল করেছে পুলিশ। ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারি হিসেবে মাওলানা জুনেদ আহমেদ ওরফে জুনায়েদ ও আব্দুল্লাহর কথা বলা হলেও তাদের গ্রেপ্তার করতে পারেনি কোনো বাহিনী। এমনকি অভিযোগপত্রে বিভিন্ন সময় আটজন মিলে এই হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা করা হয়েছে বলা হলেও, তিনজনের বিষয়ে কোনো তথ্যই জোগাড় করতে না পারায় মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে তাদের। স্বাভাবিকভাবেই এই অভিযোগপত্রকে দায়সারা হিসেবে বর্ণনা করছেন আইনজীবীরা। অভিজিৎ রায়সহ আরও তিন ধর্মনিরপেক্ষ ব্লগারের হত্যাকারীদের বিচারের আওতায় আনতে ব্যর্থতার কারণেই দিন দুপুরে রাজধানীর আজিজ সুপার মার্কেটে প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দিপনকে হত্যার সাহস পেয়েছে হত্যাকরীরা। এবং এখন পর্যন্ত আইন শৃঙ্খলা বাহিনী কোনো অগ্রগতির কথা জানাতে পারেনি। এটি সরাসরি পুলিশের ব্যর্থতা, এই বাহিনীর সক্ষমতার অভাব। যদি তা না হয় তবে বলতে হবে, কোনো না কোনোস্থান থেকে এমন বার্তা দেয়া হচ্ছে যে লেখকরা মরলে কিছু হয় না। আর ব্লেম গেমের মহড়ায় পুলিশের কাছে ভুল বার্তা যায়, ভুল ব্যক্তি পুলিশি হয়রানির শিকার হন। আর তখন আসল খুনি নির্ভাবনায় আরো একটা খুনের প্রস্তুতি নিতে থাকে। ব্লেম গেমের কারণে পুলিশি তদন্ত ঠিকমতো হতে পারে না, বারবারই আসল খুনিরা বিচারের আওতা থেকে বেরিয়ে যায়। দায় চাপানোর এই রাজনৈতিক সংস্কৃতি অনেক পুরোনো। বড় কোনো অঘটন ঘটলেই প্রধানত দুই দলের নেতারা বাক যুদ্ধে নেমে পরিস্থিতিকে রাজনৈতিকভাবে ঘোলাটে করে ফেলেন। দুই পক্ষই ঢালাও মন্তব্য করেন যা শুধু তদন্তকে বাধাগ্রস্ত করে না, সমাজে সাধারণভাবে ঘৃণার সংস্কৃতিকে বিকশিত করে। এই সাংস্কৃতিক চর্চা এমনই লাগামছাড়া যে, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ বলে ফেললেন, প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপনের বাবা হত্যাকারীদের আদর্শে বিশ্বাসী বলেই তিনি বিচার চাননি। একজন সন্তান হারা পিতার হৃদয়ে আঘাত করতে এটুকু বিচলিত হননি তিনি। যদিও জনাব হানিফ তার বক্তব্যের জন্য পরে দুঃখ প্রকাশ করেছেন, কিন্তু এতে করে তার মনোভাবের যে পরিচয় পাওয়া গেছে তা ভয়ংকর ভাবে সুস্থ রাজনৈতিক ও সামাজিক সংস্কৃতির পরিপন্থি। ঘটনা ঘটলেই কাউকে ইঙ্গিত করে বক্তব্য দেয়ার অর্থ সেই ব্যক্তির কাছে তথ্য প্রমাণ আছে। সরকারের নীতি নির্ধারণী জায়গায় বসে এমন বক্তব্য দিলে বলতেই হবে তার কাছে থাকা তথ্যের ভিত্তিতে কেন প্রকৃত অপরাধীকে ধরা হচ্ছে না? ব্লগার ও সাম্প্রতিক প্রকাশক হত্যায় আক্রমণের দায় স্বীকার করে বিবৃতি দিয়েছে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম। পুলিশ তাদের গ্রেফতার করতে পারছে না। স্বেচ্ছায় হামলার দায় নিচ্ছে যারা, তাদের বাদ দিয়ে একে অন্যকে দোষ দিতে থাকলে পুলিশই বা কি তদন্ত করবে? ভয়াবহ সংকটে রয়েছে বাংলাদেশ। এ অবস্থায় সুস্থভাবে সবকিছু বিচার বিবেচনা করে এসব হত্যার সঠিক বিচার না করলে আগামী দিনগুলো কারো জন্যই নিরাপদ নয়। জঙ্গিবাদ মোকাবেলার এখনই সময়। তাই ব্লেম গেম বাদ দিয়ে সন্ত্রাসী, খুনিদের কাছে রাষ্ট্রের কঠোর বার্তা পৌছে দিতে হবে যেন এমন আর একটি ঘটনা ঘটানোর আগে তারা বহুবার ভাবতে বাধ্য হয়। প্রকৃত অপরাধীদের খুঁজে বের করাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ, কাউকে দোষ দিয়ে আপাত রাজনৈতিক সুবিধা পাওয়া গেলেও, আখেরে লাভবান হওয়া যায় না। এইচআর/এমএস
Advertisement