বিপাশা হায়াত। দেশের মঞ্চ, টেলিভিশন ও চলচ্চিত্র আলোকিত করা জনপ্রিয় ও নন্দিত অভিনেত্রী। প্রায় তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি নিজের শিল্পের চর্চা করে চলেছেন স্বমহিমায়। একজন নাট্যকার ও নাট্য নির্মাতা হিসেবেও তিনি প্রশংসিত হয়েছেন। তবে আজকাল আর তাকে জনারণ্যে খুব একটা দেখা যায় না। অভিনয়েও অনিয়মিত। বিপাশা ব্যস্ত তার সংসার নিয়ে। আর তার ফাঁকে তিনি চমৎকার এক সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন আঁকাআঁকির সাথে। যে চারুকলার ছাত্রী একদিন নামকরা অভিনেত্রী হবেন বলে থিয়েটারে নেমেছিলেন সেই বিপাশাই আবার ফিরে এসেছেন রঙের ভুবনে। নিয়মিতই ক্যানভাসে আঁকছেন জীবন ও হৃদয়ের নানা বোধ-অনুভূতি। সম্প্রতি তিনি প্রাণ ডেইরি লিমিটেডের পণ্য প্রাণ পাউডার মিল্কের বিজ্ঞাপনচিত্রে মডেল হয়েছেন। এ সংক্রান্ত চুক্তির জন্য এসেছিলেন প্রাণের কার্যালয়ে। সেখানেই জাগো নিউজের সাথে একান্ত আলাপে জানালেন নিজের সাম্প্রতিক ব্যস্ততা, ভাবনা ও দিন যাপনের গল্প-জাগো নিউজ : প্রাণের সাথে কীভাবে জড়িত হলেন?বিপাশা : আসলে আমি এখন অনেকটাই নিভৃতচারী মানুষ। সংসার-সন্তান আর আমার ছবি আঁকা নিয়েই থাকতে ভালো লাগে। এ ধরণের কোনো বিজ্ঞাপনে কাজ করার ভাবনা একেবারেই ছিলো না। কারণ, একটি পণ্যের মডেল হওয়া মানে অনেক দায়িত্ব। পণ্যটির দূত হিসেবে এর প্রচারে অনেক কাজ ও দায়িত্ব পালন করতে হয়। তাই প্রাণ থেকে যখন প্রস্তাবটি আসলো আমি ফিরিয়ে দিয়েছিলাম ঠিক করে হয়তো সময় দিতে পারবো না এই ভেবে। কিন্তু প্রাণের দেশপ্রেম, এই গ্রুপের পণ্য বিশ্বের ১২১টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে, এই প্রতিষ্ঠানটির সাথে প্রায় ৫ লাখ মানুষের জীবীকা জড়িয়ে আছে- ব্যাপারগুলো জানার পর নিজের মধ্যে ইতিবাচক সাড়া পাচ্ছিলাম। এমন একটা প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়াতে পারাটাকে আনন্দের মনে হলো। যেখানে সবাই বিদেশ বিদেশ বলতে অজ্ঞান সেখানে দেশীয় পণ্যের বিদেশ জয়- গর্বেরই তো বটে! তাছাড়া প্রাণ থেকে বলা হয়েছে তাদের গুঁড়ো দুধের পণ্যটি বিশ্বমানের হবে। দেশের বাইরেও এর রপ্তানি হবে। এসব ভেবেই সিদ্ধান্ত নিলাম কাজ করার। আশা করি প্রাণের দেয়া দায়িত্ব আমি আস্থার সাথেই পালন করতে পারব।জাগো নিউজ : প্রাণ পাউডার মিল্কের বিজ্ঞাপনচিত্র নিয়ে কিছু বলুন....বিপাশা : এটি নির্মাণ করবেন নাফিস রেজা। এখানে আমার চিত্রাঙ্কন এবং মাতৃত্বের গুণকে ফুটিয়ে তোলা হবে। যার গল্প হবে, একজন মা তার সন্তানের প্রতি যথেষ্ট যত্নশীল। পাশাপাশি তিনি তার কাজেও সমান গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। ছেলেমেয়েদের খাবারের আবদার পূরণেও তিনি সব সময় সেরাটাই দিতে সচেষ্ট। টিভিসির গল্পটি আমার কাছে ভালো লেগেছে। আশা করছি দর্শকদেরও ভালো লাগবে। জাগো নিউজ : আপনাকে অভিনয়ে নিয়মিত দেখা যায় না কেন?বিপাশা : মাঝেমধ্যে অভিনয় করছি তো। যখন ভালো লাগে। বা কোনো নির্মাতা যখন প্রস্তাব নিয়ে আসেন গল্প ও চরিত্র পছন্দ হলে অভিনয় করি। তেমন করে নিয়মিত হবার উৎসাহ পাই না। জাগো নিউজ : কিন্তু আপনার সময়সাময়িকরা তো অনেকেই করছে....বিপাশা : হ্যাঁ, তৌকির-আজিজুল হাকিমসহ আরো অনেকেই কাজ করছেন। তবে সেই সংখ্যাটা খুব বেশি না। তারা হয়তো মানিয়ে নিতে পারছেন। আমি পারিনা। তাছাড়া আমি সময় করে উঠতে পারি না এটাও একটা বড় কারণ। সংসার-সন্তান গুছাতে হয়। আর বর্তমানে আমি ছবি আঁকাতেই বেশি মনযোগী। জাগো নিউজ : নাটক নির্মাণ ও চিত্রনাট্য লেখা- সেগুলোর কী খবর?বিপাশা : চলছে ফাঁক ফোকর দিয়ে। আমার কাছে কোনো কিছুই ধরাবাধার ব্যাপার নয়। যে ইচ্ছে না হলেও করতে হবে এমন কিছু নয়। যখন মনে হবে লিখবার মতো কোনো গল্প পেয়েছি, কিংবা এই গল্পটা নির্মাণ করা উচিত তখন করবো। জোর করে মানুষ হাসানোর মানহীন কাজ করার চেয়ে না করে বসে থাকা ভালো। জাগো নিউজ : আপনি তো দুটি চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছিলেন। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ অনেক প্রশংসা পেয়েছেন। বড় পর্দায় নিয়মিত হতে ইচ্ছে করেনি?বিপাশা : অবশ্যই করেছে। অনেক প্রস্তাবও এসেছে নানা সময়ে। বেশ কিছু ভালো গল্প ও চরিত্রও ছিলো। কিন্তু নিজেকে সেগুলোর সাথে মানিয়ে নিতে পারিনি। আগুনের পরশমনি ও জয়যাত্রা ছবিতে কাজ করেছি আমি। এ ধরনের ছবি আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে কয়টা হয় বছর-পাঁচ বছরে? সেই গল্প কই? সেই নির্মাতা কই? আমি এখনো চলচ্চিত্রে কাজ করতে প্রস্তুত যদি সেটা আরেকটা আগুনের পরশমনি হয়, যদি সেটা তিতাস একটি নদীর নাম হয়, যদি সেটা জীবন থেকে নেয়া হয়। আমি অভিনেত্রী, অভিনয়ে আমার আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু আমি যেভাবে কাজ শিখে ও করে নিজেকে আজ এখানে নিয়ে এসেছি আমার কাজের পরিবেশ ও চরিত্রটাও তো তেমনি হওয়া চাই। জাগো নিউজ : চলচ্চিত্র নির্মাণ নিয়ে কোনো পরিকল্পনা আছে?বিপাশা : সংসার আর ছবি আঁকা ছাড়া আমার কোনো কিছু নিয়েই পরিকল্পনা নেই। আমার পক্ষে করা সম্ভব এবং মানানসই গল্প পেলে চলচ্চিত্র নির্মাণও করতে পারি। কিন্তু এ নিয়ে কোনো আগাম ভাবনা নেই। আমি সময়ের স্রোতে ভাসা মানুষ। শিল্পের অনুরাগী। যখন যেখানে শিল্পের হাতছানি পাই সেখানেই একটু পদচিহ্ন রাখার চেষ্টা করি।জাগো নিউজ : আমরা জানি এই সময়টাতে আপনার সবচেয়ে ভালো লাগার শিল্পটি হলো চিত্রাঙ্কন। অভিনয়ের পুরোদস্তুর মানুষ হঠাৎ করে ছবি আঁকার প্রতি ঝোঁকলেন কীভাবে?বিপাশা : আসলে আমি ছবি আঁকারই মানুষ। চারুকলায় পড়েছি, রঙ আর ক্যানভাসের সাথে সম্পর্কটা বহুদিনের। আমি আমার বাবা আবুল হায়াতের বইয়ের প্রচ্ছদ এঁকেছি ছাত্রী থাকাকালীন সময়ে। অভিনয়ে চলে যাওয়ার পর সেখানে ব্যস্ততা বেড়ে গেল। তাই ছবিতে মনযোগ দিতে পারিনি। এখন নিজেকে শোবিজ থেকে গুটিয়ে এনেছি। ছবি আঁকার ঝোঁকটা বরাবরই ছিলো। কিছুটা অবসর বাড়তেই সেই ঝোঁকটাও বেড়ে গেল। ছবি নিয়ে ভাবতে, ছবি আঁকতে আমার ভিষণ ভালো লাগে। আমার স্বামী তৌকির আহমেদও ছবি আঁকার বিষয়ে আমাকে উৎসাহ দেয়।জাগো নিউজ : গেল আগস্টে আপনার একক চিত্র প্রদর্শনী হয়েছে। নতুন কোনো প্রদর্শনী নিয়ে ভাবছেন?বিপাশা : আসলে একটি একক প্রদর্শনীর জন্য অনেক দিন ধরেই প্রস্তুতি নিতে হয়। সেটি পাঁচ বছরেও হতে পারে, দশ বছরেও হতে পারে। কেউ আবার এক-দুই বছরেই করে ফেলতে পারেন। আমার প্রথম প্রদর্শনী ‘স্মৃতির রাজ্যে’ অনেক সময় নিয়ে করেছিলাম। সবাই খুব প্রশংসা করেছেন। আমিও উৎসাহ পেয়েছি। ছবি আঁকছি। বিভিন্ন যৌথ প্রদর্শনীতে অংশ নিচ্ছি। পৃথিবীর যেখানেই বড় বড় শিল্পীদের প্রদর্শনীর খবর পাই যাবার চেষ্টা করি। অনেক কিছু শিখা যায়। সবকিছু মিলিয়েই নিজেকে তৈরি করছি। আরো একটি একক প্রদর্শনী করতে চাই। হয়তো সেটা দুই বছর কিংবা পাঁচ বছর পর। জাগো নিউজ : ১৭ বছর পর মঞ্চায়ন হয়েছে আসাদুজ্জামান নূরের অনুবাদ ও নির্দেশনায় ‘দেওয়ান গাজির কিসসা’। এ নাটক দিয়ে মঞ্চে ফিরেছেন আপনার বাবা আবুল হায়াত, নন্দিত অভিনেতা আলী যাকের, অভিনেত্রী সারা যাকের, শামীমা নাজনীন। আপনিও তো এই নাটকটির অভিনেত্রী ছিলেন। আপনার ফিরতে ইচ্ছে করেনি?বিপাশা : দেখুন আমি থিয়েটারের মানুষ। আর যারা থিয়েটার করেন তারাই কেবল অনুভব করতে পারবেন এর থেকে দূরে থাকার কী যাতনা। কাউকে মঞ্চ নিয়ে কথা বলতে শুনলেই নিজেরও কথা বলকে ইচ্ছে করে। কাউকে মঞ্চে কাজ করতে দেখলে নিজেরও সংলাপ দিতে ইচ্ছে করে। আমারও ভিষণ ইচ্ছে করে আবারো মঞ্চে যাই। দল বেধে রিহার্সাল করি। বিশেষ করে ১৭ বছর পর যখন দেওয়ান গাজির কিসসা মঞ্চস্থ হচ্ছিলো তখন আমি দর্শক হিসেবে সামনের সারিতে ছিলাম। বারবার ইচ্ছে করছিলো মঞ্চে উঠে যাই। আমি সেখানে বসে বসে অনুধাবন করলাম এতবছর পর চর্চা না থাকা সত্বেও লাইলীর সংলাপগুলো আমার মুখস্ত। আমি এ নাটকের সখী চরিত্রেও কাজ করেছিলাম। এ নাটকটি নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের জনপ্রিয় একটি প্রযোজনা। আজ যখন নতুন করে নাটকটি নিয়ে কথা হয়, প্রশংসা শুনি তখন আমার ভালো লাগে যে এর সাথে আমিও ছিলাম। কিন্তু কিছু করার নেই। মঞ্চে দেয়ার মতো সময় আমি করতে পারছি না। হবে হয়তো কোনো একদিন। কারো জন্য ভালোবাসা থাকলে দেখা হয়েই যায়। জাগো নিউজ : সমকালীন নাটক-টেলিফিল্ম নিয়ে বলুন...বিপাশা : ভালো মন্দের মিশেলেই কাজ হচ্ছে এখন। তবে হতাশার বিষয়টা হলো মন্দটাই বেশি হচ্ছে। সিনিয়র শিল্পীরা মানের দিকের নজর না দিয়ে একের পর এক কাজ করে যাচ্ছেন। কিছু সিক্যুয়্যাল দেখছি বিরক্তিকর। ওগুলোর বিষয়, ভাষা ও চরত্রিরা অদ্ভূত এবং অপ্রাসঙ্গিক। কখনো কখনো কিছু কিছু নাটক সমাজে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। জনপ্রিয়তার খাতিরে চ্যানেলগুলো এসব দেদারছে প্রচার করছে। এটা কাম্য নয়। এ বিষয়ে চ্যানেল মালিকদের আরো সচেতন হওয়া উচিত। সিনিয়রদেরও নিজের ইমেজ ও ক্যারিয়ারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে এসব কাজ থেকে বিরত থাকা উচিত। আসলে প্রত্যেকেরই একটি নির্দিষ্ট লক্ষ থাক; যেখানে সবাই পৌঁছানোর সম্মিলিত প্রচেষ্টা চালাবে। কিন্তু আমাদের ইন্ডাস্ট্রির কোনো লক্ষ্য বা গন্তব্য নেই। যার ফলে যে যার মতো নির্মাণ করছেন এবং প্রচার করছেন। তবে আমাদের এখানে বিজ্ঞাপন নির্মাণে একটা ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। এটা ধরে রাখতে হবে। জাগো নিউজ : নতুনদের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন....বিপাশা : প্রচুর নতুন মুখ আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করছে। এদের বেশিরভাগই ভালো কাজ করছে। অনেক নতুন নির্মাতাও এসেছেন যাদের নির্মাণের বিষয় ও ধরণ আমার ভালো লাগে। তবে অনেকের মধ্যেই জানার কমতি আছে, জানার আগ্রহটাও কম। এটা ঠিক নয়। আমরা যারা একসময় প্রচুর কাজ করেছি তারা প্রত্যেকেই কোনো কোনো থিয়েটার-স্কুল থেকে অভিনয় শিখে এসেছি। যারা নির্মাণ করতেন তারাও ছিলেন অনেক জানা শোনা মানুষ। এখন থিয়েটারের কর্মীরা শোবিজে মূল্যায়ণ পাচ্ছেন না। কারণ ব্যবসায়িক আগ্রাসনে কমে গেছে শিল্প চর্চা। তাই জনপ্রিয়তার জন্য মানহীন নির্মাণ বাড়ছে। সেসব নির্মাণে সুন্দর মুখই প্রাধাণ্য পাচ্ছে। তিনি অভিনয় কতোটা ভালো করলেন এ ব্যাপারে কারো কোনো মাথা ব্যাথা নেই। এই ধারা বদলাতে হবে। যে যাই করুক সে যেন সেটা ভালোভাবে রপ্ত করে আসে। ব্যবসা আগেও ছিলো, কিন্তু শিল্প চর্চাকে সম্মুখে রাখতে হবে। ভালো নির্মাণ ও অভিনয়ের পাশাপাশি শিল্পীর আচরণ, জীবন বোধও শিল্প চর্চার বিষয়। আর বর্তমানে অভিযোগ শুনি অনেক নতুনরা টিভিতে নানাভাবে অবহেলিত। একজন নতুন নির্মাতার ভালো একটি নাটক আটকে থাকছে দিনের পর দিন। কিন্তু একটি বস্তাপঁচা গল্প ও জোর করে হাসানোর নাটক ঠিকই প্রচার হচ্ছে প্রভাব ও জনপ্রিয়তার বায়নায়। এভাবে চলতে থাকলে ইন্ডাস্ট্রিতে নতুন নতুন কাজের এক্সপেরিমেন্ট কমে যাবে। ভালোটা হারিয়ে মন্দের রাজত্ব প্রভাব বিস্তার করবে। জাগো নিউজ : আপনার কাছে জীবনের মানে কী?বিপাশা : জীবন আমার কাছে নান্দনিক এক শিল্প। প্রতিটি কাজে, প্রতিটি মুহূর্তে শিল্পের ছোঁয়া থাকা চাই। শৈল্পিক মন কখনো হতাশ হয় না, ব্যথিত হয় না, অভাবে ভুগে না। সে চির সবুজ ও প্রাণবন্ত। জাগো নিউজ : আপনি এবং আপনার পরিবারের জন্য শুভকামনা। প্রাণের সাথে আপনার নতুন এ যাত্রা শুভ হোক....বিপাশা : আপনাকেও ধন্যবাদ।এলএ/আরআইপি
Advertisement