এম আবুল হাসনাত মিল্টন
Advertisement
কোভিড-১৯ প্রতিরোধী ভ্যাকসিন আবিষ্কার নিয়ে বিশ্বজুড়ে তোলপাড় চলছে। আবিষ্কারের অংশ হিসেবে মানবদেহে গবেষণার শেষ পর্যায় রয়েছে অক্সফোর্ড, মার্কিন ও চীনা কোম্পানি প্রস্তাবিত ভ্যাক্সিনসমূহ। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকে সামনে রেখে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ১৩ নভেম্বরের নির্বাচনের আগেই ভ্যাকসিনটি পেতে মরিয়া। বর্তমানে করোনায় নাকাল আমেরিকায় ভ্যাকসিন আবিষ্কারের সাফল্য দেখিয়ে যদি নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া যায়, সে চেষ্টাই হয়তো করছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
অক্সফোর্ড এবং চীনা কোম্পানি প্রস্তাবিত ভ্যাকসিনসমূহও গবেষণার শেষ পর্যায়ে। গবেষণার চূড়ান্ত ফলাফল এ বছরের মধ্যেই পাওয়া যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে কোনো একটি বা সব ভ্যাকসিন যদি সফল হয়, তাহলেও তা বাজারে আসতে আসতে আগামী বছরের শুরু হয়ে যাবে।
এর মধ্যে আকস্মিকভাবে বাজারে কোভিড-১৯ প্রতিরোধী ভ্যাকসিন আনছে রাশিয়া। রাশিয়ার বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান ‘গামালোয়া ন্যাশনাল রিসার্চ সেন্টার অব এপিডেমোলজি অ্যান্ড মাইক্রোবায়োলজি’ এই ভ্যাকসিন তৈরি করেছে। বলা হয়েছে, এই ভ্যাকসিন লাগানোর ফলাফল খুবই ভালো এসেছে। এই টিকা লাগানোর পর মানুষ খুব ভালো রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতার অধিকারী হয়। ভলান্টিয়ারদের বুরডেকো হাসপাতালে টেস্ট করানো হয়েছে। এ মাসের মধ্যেই রাশিয়ান এই ভ্যাকসিনটি বাজারে আসার কথা।
Advertisement
বিশ্বের খ্যাতিমান জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা অবশ্য এই ভ্যাকসিনটি সম্পর্কে ইতোমধ্যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। কারণ গবেষণার চূড়ান্ত পর্যায় (আরসিটি ফেজ-থ্রি) ব্যতিরেকেই কতিপয় স্বেচ্ছাসেবীর দেহে প্রয়োগ করেই ভ্যাকসিনটির সাফল্য দাবি করা হয়েছে। বৈজ্ঞানিকভাবে এটি গ্রহণযোগ্য নয়। এর ফলে ভ্যাকসিন গ্রহীতার শরীরের ক্ষতি হওয়ারও আশঙ্কা রয়েছে। এই মুহূর্তে রাশিয়ার ভ্যাকসিনটি নিয়ে আমাদের তাই না ভাবলেও হয়তো চলবে।
যদি সবকিছু ঠিকঠাক থাকে, একটি কার্যকর ভ্যাকসিন যদি পাওয়াই যায়, তাহলে কীভাবে, কোন পর্যায়ে কত ভ্যাকসিন পাবে তা নিয়ে বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই কূটনৈতিকসহ বিভিন্ন চ্যানেলে তৎপরতা শুরু করেছে বলেই আমার বিশ্বাস। এই তৎপরতা অব্যাহত রাখতে হবে। ইতোমধ্যে ভ্যাকসিন তৈরির গবেষণায় একটি বৈশ্বিক তহবিলে বাংলাদেশ ৫০ হাজার ডলার প্রদান করেছে। গবেষণা তহবিলে বাংলাদেশের এই অংশগ্রহণটি প্রশংসাযোগ্য একটি পদক্ষেপ। এ জন্য একটি ধন্যবাদ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রাপ্য।
নতুন আবিষ্কৃত কার্যকর ভ্যাকসিনের মূল্য নির্ধারণ নিয়েও আলোচনা চলছে। আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ইউরোপসহ বিশ্বের অনেক দেশই ইতোমধ্যে ভ্যাকসিন উৎপাদনকারী কোম্পানিসমূহের সাথে নানা চুক্তি করেছে। নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলো কী হিসাবে ভ্যাকসিন পাবে, তা নিয়েও আলোচনা চলছে। বাংলাদেশের কোনো কোম্পানি এই সুযোগে ভ্যাকসিন ব্যবসায় নেমে যেন জনগণের পকেট না কাটতে পারে, সেদিকে সরকারের নজর রাখতে হবে।
ভ্যাকসিন সংগ্রহের পর বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হবে এর বিতরণ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। শুরুতেই যদি প্রয়োজনীয় সংখ্যক ভ্যাকসিন না পাওয়া যায়, সেক্ষেত্রে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এবং পর্যায়ক্রমে কাদের কাদের এই ভ্যাকসিন দেয়া হবে তা আগেভাগেই নির্ধারণ করে রাখতে হবে। দ্বিতীয়ত, দেশের ভেতরে ভ্যাকসিন কীভাবে, কত তাপমাত্রায় সংরক্ষণ ও বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করতে হবে, সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতির চিন্তাভাবনা এখন থেকেই শুরু করতে হবে। কোন স্থানে, কীভাবে এই ভ্যাকসিন দেয়া হবে সেটা নিয়েও ভাবতে হবে।
Advertisement
নিকট অতীতের অভিজ্ঞতায় আমরা জানি, বিভিন্ন ভ্যাকসিন প্রদান কর্মসূচিতে বাংলাদেশের সাফল্য রীতিমতো ঈর্ষণীয়, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের জন্য অনুকরণযোগ্য। আমাদের সেই অভিজ্ঞতা ও নেটওয়ার্ককে সুপরিকল্পিতভাবে ব্যবহার করে প্রাপ্ত কোভিড-১৯ প্রতিরোধী ভ্যাকসিনের সম্ভাব্য সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
করোনা সমস্যার শুরুতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকাণ্ডে পরিকল্পনাহীনতা ও সমন্বয়হীনতা পরিলক্ষিত হয়েছিল। ভ্যাকসিন আসার পরও যেন সে রকম লেজেগোবরে অবস্থার সৃষ্টি না হয়, সে ব্যাপারে এখন থেকেই খেয়াল রাখতে হবে।
নভেল করোনাভাইরাসের ধারাবাহিক সংক্রমণ এবং সুনির্দিষ্ট চিকিৎসার অভাবে আপাতত ভ্যাকসিনই ভরসা। করোনাক্রান্ত বিশ্বের সব দেশই আজ একটি সফল ভ্যাকসিনের অপেক্ষায়। কাঙ্ক্ষিত সেই ভ্যাকসিনটি পেলে যেন যথাযথভাবে তার সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার করতে পারে বাংলাদেশ, সেই লক্ষ্যে এখনি কাজ শুরু করতে হবে।
লেখক : প্রফেসর, পাবলিক হেলথ, নর্দার্ন ইউনিভার্সিটি।
বিএ/জেআইএম