বর্তমানে সবচেয়ে আলোচিত শব্দ ‘করোনাভাইরাস’। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের উহান শহরের একটি বন্যপ্রাণির বাজার থেকে এ ভাইরাস ছড়িয়েছে বলে ধারণা করা হয়। করোনাভাইরাস মূলত পূর্বের সার্স রোগ সৃষ্টিকারী গোত্রেরই একটি ভাইরাস। যার সাথে প্রায় ৮০% মিল রয়েছে। তাই একে সার্স কোভ-২ও বলা হয়। প্রথম সার্স দেখা দিয়েছিল ২০০২ সালে। ভাইরাসের উৎপত্তিস্থল ছিল বাদুড়ের শরীর। যা পরবর্তীতে মানুষের দেহে ছড়িয়ে যায়। তারপর দেখা দেয় মার্স রোগ ২০১২ সালে। এরও উৎপত্তি বাদুড় থেকে। সবশেষে এলো ২০১৯ সালে কোভিড-১৯, যা চিন্তায় ফেলে দিয়েছে গোটা দুনিয়াকে। এ সবগুলোই কিন্তু করোনাভাইরাস সংক্রমণজনিত রোগ।
Advertisement
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ও বিস্তার নিয়ে জানতে হলে ‘আরও ফ্যাক্টর’ সম্পর্কে জানতে হবে। ‘আরও’ হলো একজন আক্রান্ত মানুষ থেকে একটি নির্দিষ্ট রোগ কতজন মানুষের মাঝে ছড়াতে পারে। আরও সমান ১ মানে হলো- একজন আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে ওই রোগ সুস্থ একজনের মাঝে ছড়ায়। আরও সমান ৩ মানে হলো- একজন আক্রান্ত ব্যক্তির দেহ থেকে তিন জন সুস্থ ব্যক্তির দেহে ছড়িয়ে যায় ভাইরাস। বিষয়টি এরকম আসলে। হিসাব করে দেখা যায়, করোনাভাইরাসের আরও ফ্যাক্টর ২ থেকে ৩ এর মাঝে রয়েছে। এই আরও এর মান যতদিন ১ থেকে বড় থাকবে, ততদিন করোনাভাইরাসের সংক্রমণের গ্রাফ ঊর্ধ্বমুখী থাকবে। এ গ্রাফকে নিম্নমুখী করার মাধ্যমে অর্থাৎ আরওকে শূন্য করার মাধ্যমেই ভাইরাসের বিস্তার ঠেকানো সম্ভব। কোয়ারেন্টাইনে থাকা, নিয়মিত মাস্ক ব্যবহার করা, সাবান দিয়ে হাত পরিষ্কার করা, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা ইত্যাদিই পারে আরও এর মান কমিয়ে এনে গ্রাফকে নিম্নমুখী করতে।
করোনাভাইরাস হলো একধরনের আবরণবিশিষ্ট পজিটিভ সেন্স একক সূত্রক আরএনএ ভাইরাস। এর আবরণের বাইরে কিছু প্রোটিন দিয়ে তৈরি কাঁটা বা স্পাইক থাকে। আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি, কাশি ও থুথুর মাধ্যমে একজন সুস্থ ব্যক্তির শরীরে নাক ও মুখ দিয়ে করোনাভাইরাস প্রবেশ করে এবং চলে যায় নাসাগলবিলে। তারপর ভাইরাসটি চলে যায় ট্রাকিয়া বা শ্বাসনালীতে। করোনাভাইরাসের লোড বা পরিমাণ যদি বেশি হয়, তবে সেটা ঊর্ধ্ব শ্বাসযন্ত্র বা ট্রাকিয়া থেকে প্রবেশ করে নিম্ন শ্বাসযন্ত্র তথা ফুসফুসে। আর ভাইরাসের লোড যদি কম হয়, তবে তা ঊর্ধ্ব শ্বাসযন্ত্রেই থেকে যায়- এরকম ক্ষেত্রে মৃদু সংক্রমণের লক্ষণগুলো দেখা যায়। ধরে নেওয়া গেল যে, ভাইরাসের লোড অনেক বেশি আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে। ফলে ভাইরাস সোজা চলে গেল ট্রাকিয়া হয়ে ফুসফুসে। ফুসফুসের ভেতরে মিলিয়ন মিলিয়ন এলভিওলাই বা বায়ুথলি আছে। এই বায়ুথলিতে দুই ধরনের কোষ থাকে- টাইপ-১ এবং টাইপ-২ নিউমোসাইট।
টাইপ-১ কোষটি কাজ করে গ্যাসীয় আদান-প্রদানে। অর্থাৎ অক্সিজেনের গ্রহণ এবং কার্বন-ডাই-অক্সাইডের নির্গমনে ভূমিকা পালন করে কোষটি। আর টাইপ-২ কোষের কাজ হলো সারফেকট্যান্ট তৈরি করা। এটি এমন এক জৈব রাসায়নিক পদার্থ, যা বায়ুথলির পৃষ্ঠটান কমিয়ে গ্যাসীয় আদান-প্রদানের সময় বায়ুথলিকে চুপসে যেতে বাধা দেয়। ফলে সহজেই বায়ুথলিতে গ্যাসীয় বিনিময় হতে পারে।
Advertisement
ফুসফুসে প্রবেশ করে করোনাভাইরাস আক্রমণ করে বসে টাইপ-২ নিউমোসাইট কোষকে। এই কোষের ভেতরে একটি রিসেপ্টর বা গ্রাহক প্রোটিন আছে, যার নাম এনজিওটেনসিন কনভার্টিং এনজাইম-২ বা এসিই-২ রিসেপ্টর। এ রিসেপ্টর করোনাভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনগুলোর সাথে খাপে খাপে বসে যায়। ফলে করোনাভাইরাসের বহিরাবরণ গলে গিয়ে ভেতরে থাকা একসূত্রক আরএনএ প্রবেশ করে সোজা টাইপ-২ কোষের সাইটোপ্লাজমে। এরপর এ আরএনএ চলে যায় আক্রান্ত কোষের রাইবোজোমের কাছে। টাইপ-২ কোষের রাইবোজোমের কাছে থাকা তাদের নিজস্ব আরএনএকে সরিয়ে দিয়ে সেখানে বসে যায় করোনাভাইরাসের আরএনএ। রাইবোজোমকে কাজ করিয়ে ট্রান্সলেশনের মাধ্যমে সে তৈরি করে অনেকগুলো পলিপ্রোটিন।
পলিপ্রোটিনের খণ্ডগুলো প্রোটিওলেজ এনজাইমের মাধ্যমে ভেঙে গিয়ে তৈরি করে করোনভাইরাসের জন্য এনজাইম, প্রচুর স্পাইক এবং আবরণ। এদিকে একক সূত্রক আরএনএটি আরএনএ পলিমারেজের মাধ্যমে তার মতোই অনুরূপ অনেকগুলো আরএনএ কপি তৈরি করে ফেলে। এভাবে আবরণ, স্পাইক, এনজাইম, আরএনএ মিলে পূর্বের একটি করোনাভাইরাসের আরএনএ থেকে টাইপ-২ নিউমোসাইট কোষের ভেতরে তৈরি করে ফেলে অসংখ্য করোনাভাইরাসের কপি। আর ফলাফলস্বরূপ টাইপ-২ কোষগুলো নষ্ট হওয়া শুরু হয়। কোষগুলোর কাজ ছিল সারফেকট্যান্ট তৈরি করা, কিন্তু আক্রান্ত হওয়ার পর সেগুলো আর পর্যাপ্ত পরিমাণে সারফেকট্যান্ট তৈরি করতে পারে না। এতে পৃষ্ঠটান বৃদ্ধি পেয়ে বায়ুথলিগুলো অকর্মণ্য হয়ে পড়ার সম্ভাবনা বাড়তে থাকে।
এখন টাইপ-২ নিউমোসাইটগুলো নষ্ট হওয়ার কারণে কোষগুলো থেকে কিছু প্রদাহজনিত রাসায়নিক পদার্থ নিঃসৃত হয়। এ রসায়নিকগুলো ডেকে নিয়ে আসে ম্যাক্রোফেজ নামক কোষকে। এ ম্যাক্রোফেজ ফুসফুসের ভেতরে কিছু ফ্যাক্টর নিঃসৃত করে। যেমন- ইন্টারলিউকিন-১ (IL-1) এবং ইন্টারলিউকিন-৬ (IL-6)। এ দুটো ফ্যাক্টর বায়ুথলি থেকে চলে আসে ইন্টারস্টিশিয়াল স্পেস বা ফাঁকা জায়গা ভেদ করে রক্তনালীতে। ফ্যাক্টরগুলো রক্তনালীগুলোকে প্রসারিত করে, একে বলা হয় ভ্যাজোডাইলেশন। এ রক্তনালী প্রসারণের কারণে রক্তের গতিবেগ বাড়ে ও বেশি বেশি রক্ত রক্তনালী দিয়ে যাওয়ার সময় চাপে ফ্লুইড লিকেজ হয়, যেগুলো রক্তনালী থেকে জমা হয় ইন্টারস্টিশিয়াল স্পেসে। এতে বায়ুথলির জন্য ফাঁকা জায়গা কমে যায়। ফলে বাতাস আদান-প্রদানে বাঁধা আসে এবং বায়ুথলির কর্মক্ষমতা আরও হ্রাস পায়। আবার এই আন্তঃকোষীয় ফাঁকা স্থান থেকে ফ্লুইড চলে যেতে পারে বায়ুথলির ভেতরে। এতে বায়ুথলিগুলো বাতাসের বদলে সব পানি দিয়ে ভর্তি হয়ে যাবে এবং বায়ুথলির ইডিমা দেখা দেবে। সারফেকট্যান্ট কমে যাওয়ায় এবং বায়ুথলির ইডিমা দেখা দেওয়ায় বায়ুথলিগুলো তাদের কর্মক্ষমতা হারাবে এবং পর্যাপ্ত গ্যাসীয় আদান-প্রদান হবে না। ফলে রক্তে অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দেবে। শরীরের অক্সিজেনের ঘাটতিকে ঠিক করার জন্য রোগী তখন বেশি বেশি শ্বাস নেয় ও ত্যাগ করে। কিন্তু বায়ুথলির অক্ষমতার জন্য শ্বাসকার্য চালনা করা কষ্টকর হয়ে পড়ে এবং রোগী শ্বাসকষ্টে ভোগেন।
দেহের এ সামগ্রিক অবস্থায় এগিয়ে আসে আরেক সৈনিক রক্তকণিকা নিউট্রোফিল। সে রক্তনালী হয়ে চলে যায় সরাসরি ফুসফুসে। নিউট্রোফিল বায়ুথলির কাছে এসে প্রোটিয়েজ ক্ষরণ করে যেটা করোনাভাইরাসকে আক্রমণ করে মেরে ফেলে। কিন্তু করোনাভাইরাসকে মারতে গিয়ে সে টাইপ-১ এবং ২- দু’ধরনের প্রয়োজনীয় কোষগুলোকেও মেরে ফেলে। ফলে মৃত কোষ, টাইপ-১ ও ২ নিউমোসাইট, করোনাভাইরাস এবং নিউট্রোফিল একসাথে স্তুপ আকারে জমা হয় বায়ুথলির ভেতরেই, এ অবস্থাকে বলে একত্রীকরণ।
Advertisement
আবার ম্যাক্রোফেজ থেকে নিঃসৃত IL-1 এবং IL-6 রক্তের মাধ্যমে চলে যাবে মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাসের কাছে। হাইপোথ্যালামাস উত্তেজনা পেয়ে প্রোস্টাগ্লান্ডিন-২ নামক রাসায়নিক ক্ষরণ করবে। ফলে শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যাবে এবং জ্বর আসবে। তাই করোনাভাইরাসের একটি প্রধান লক্ষণ হিসেবে আমরা জ্বরকেই দেখতে পাই।
অন্যদিকে করোনাভাইরাস বায়ুথলিকে আক্রমণ করে। ফলে আমাদের শরীরে অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দেয়। রক্তে অক্সিজেনের আংশিক চাপ কমে যাওয়ার ফলে আমাদের প্রান্তীয় কেমোরিসেপ্টর উদ্দীপ্ত হয়। যা আবার স্বাতন্ত্র স্নায়ুতন্ত্রকে উত্তেজিত করে। ফলে নাড়ির গতি এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের কাজের চাপ বেড়ে যায়। নাড়ির গতি অতিরিক্ত বেড়ে যাওয়ার ফলে হৃৎপিণ্ড বিকল হওয়ারও সমূহ সম্ভাবনা দেখা দেয়।
করোনার প্রভাব শরীর আরও খারাপ হতে থাকলে; তখন প্রদাহ চলে আসবে রক্তসংবহনে। IL-1 এবং IL-6 চলে আসবে কেন্দ্রীয় ও প্রান্তীয় সংবহনের রক্তনালীগুলোয়। রক্তনালীগুলোকে ফ্যাক্টরগুলো আগের মতোই প্রসারিত করে ফেলবে। ফলে ফ্লুইড লিকেজ বেড়ে যাবে ও আন্তঃকোষীয় স্থানে ফ্লুইড জমা হতে শুরু করবে। প্রচুর ফ্লুইড যদি রক্তনালী থেকে বের হয়ে ফাঁকা জায়গায় জমা হতে শুরু করে, তাহলে রক্তের আয়তন কমে যাবে। ফলে রক্তচাপ কমে গিয়ে দেহের অন্যান্য অঙ্গগুলো পর্যাপ্ত পরিমাণে আর রক্ত সরবরাহ পাবে না। ফলে একাধিক অঙ্গ বিকল হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেবে। যেমন, বৃক্কে রক্তপ্রবাহ কমে যাওয়ার কারণে বৃক্কের নেফ্রনগুলো আগের মতো কাজ করতে পারবে না ও পর্যাপ্ত মূত্র তৈরি হতে পারবে না। এতে বিষাক্ত ক্রিয়েটিনিন এবং নাইট্রোজেন ঘটিত বর্জ্যপদার্থ আর দেহের বাইরেও বের হতে পারবে না। ফলে বৃক্ক বিকল হয়ে পড়বে।
আবার যকৃত যখন পর্যাপ্ত রক্তপ্রবাহ পাবে না, তখন যকৃতও বিকল হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ফলে রক্তে বিলিরুবিনের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে জন্ডিস হতে পারে। করোনার জন্য মাল্টি সিস্টেম ইনফ্লামেটরি সিন্ড্রোমও বেশ দেখা যাচ্ছে, বিশেষ করে শিশুদের মাঝে। এক্ষেত্রে উচ্চ তাপমাত্রা, ডায়রিয়া, চোখ এবং ঠোঁট লাল হয়ে যাওয়া, পা ফুলে যাওয়া, হৃৎপিণ্ডে রক্ত সরবরাহকারী করোনারী রক্তনালীও আক্রান্ত হয়ে ফুলে যাওয়া, হৃৎপিণ্ড বড় হয়ে বিকল হয়ে পড়া, খিঁচুনি ইত্যাদি দেখা যায়। এর পেছনেও দায়ী সেই IL-1 এবং IL-6। এমনকি এসব জৈব রাসায়নিক পদার্থের জন্য মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত স্ট্রোকও দেখা দিতে পারে।
এভাবে করোনাভাইরাস মৃদু থেকে তীব্র সংক্রমণের মাধ্যমে মানবদেহে বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করে। যেখানে ফুসফুসের পাশাপাশি বৃক্ক, যকৃত, হৃৎপিণ্ড, মস্তিষ্ক প্রভৃতি একাধিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আক্রান্ত হতে পারে।
এসইউ/এমএস