ইয়াহু নিউজ থেকে খবরটা শেয়ার করার লোভ সামলাতে পারলাম না। ছিলেন একজন পুলিশ অফিসার, সেখান থেকে কেন তিনি শিক্ষক হতে গেলেন, এর পেছনে চমৎকার গল্প আছে ঐ খবরে। গল্পটি জানার আগে একজন শিক্ষক কিভাবে তার ছাত্রদের দিনটা শুরু করিয়ে দেন, সে বিষয়টি বলি। কেননা, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো দরজায় আমি কখনো আমার কোনো শিক্ষককে পাইনি, যিনি হাসি মুখে দাঁড়িয়ে থেকেছেন আর আমি বই-খাতা নিয়ে ঢোকার সময় সস্নেহে কথা বলছেন, মনে করিয়ে দিচ্ছেন তিনি আমার বন্ধু, আমার শুভাকাঙ্খী। কাজটি খুব জরুরি কি না, তা নিয়ে হয়তো ভিন্ন মত পোষণ করবেন অনেকেই। তবে, ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক আন্তরিকতার বন্ধনে যত বেশি পোক্ত হয়, ততই শিক্ষার মান উন্নয়নের কাজটি ভালো হয়, এ মত কিন্তু শিক্ষা বিশেষজ্ঞদের। আর এই শিক্ষক ঠিক এই কাজটিই করছেন।ন্যুয়র্কের হার্লেম ফাইভ এলিমেন্টারি স্কুলের বাচ্চাদের দিন হাসি মুখে শুরু করিয়ে দেন প্রিন্সিপ্যাল খারি শাবাজ। স্কুল ভবনের ফটকে দাঁড়িয়ে প্রতিটি বাচ্চার সাথে হাত মেলানোর চেষ্টা করেন, পিঠে আলতো ছোঁয়া কি মাথার চুলে হাত বোলানোর সাথে সাথে অনবরত কথা বলে যান। ‘শার্ট ঠিক করো বাচ্চা...তোমার ভাইটা এখন কেমন আছে?’ ‘বইটা পড়ে ফেলেছ? কেমন লাগল বলো আমাকে।’ এভাবে প্রতিটি বাচ্চার সাথে কথোপকথন চলে। কখনো কখনো হাত মেলানোর পর হাতের ভেতর গুঁজে দেওয়া ছোট্ট টেডি বিয়ারটা পেয়ে বাচ্চারা খুশিতে লাফিয়ে ওঠে আর তখন ওদের প্রিন্সিপ্যাল এমন ভাবে তাকান, যেন কিছুই বুঝতে পারছেন না। কী কাণ্ড!প্রতিটি দিন এভাবেই শুরু করেন প্রিন্সিপ্যাল খারি শাবাজ। যদিও তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়েছিল সেই নব্বইয়ের দশকে জনগণের জান-মালের নিরাপত্তা দিতে সদা তৎপর পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে। কালো চামড়ার কারণে পুলিশ প্রশাসনের সাদা চামড়ার কর্মকর্তাদের কাছ থেকে বর্ণবাদী অসহযোগিতা তো পেয়েছেন, সেবা গ্রহণকারীদের কাছ থেকেও অনেক সময় জুটেছে একই রকমের ব্যবহার। মাদকের বিরুদ্ধে যে কোনো অভিযানে খুব কঠোর ছিলেন, আর তখনি লক্ষ করেছেন সত্যিকারের শিক্ষার অভাবেই শিশু-কিশোররা কিভাবে মাদকের নেশায় আক্রান্ত হয়ে পড়ে। পুলিশের পোশাক তাকে সত্যিকারের শিক্ষা ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করবে না, বুঝতে পেরে চাকরিটা ছেড়ে দিলেন। শিশু-কিশোরদের রক্ষার জন্য শিক্ষক হয়ে গেলেন। তাঁর স্কুলের বাচ্চাদের সাফল্য তাঁকে আদর্শ শিক্ষক খেতাব অর্জন করতে সাহায্য করেছে। ন্যুয়র্কের ষাটটি স্কুলের প্রিন্সিপালরা তাঁর সাফল্যের ‘রহস্য’ জানতে ভিড় করেছিলেন বলে আরেক খবরে দেখলাম। খারি শাবাজ তাঁদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, ‘কাজ না করে শো-আপ করেন না শিক্ষক।’ তবে তিনি করেনটা কি? কিছু কিছু নমুনা দেওয়া যাক।প্রতিটি ক্লাসে প্রতি দিন একবার তিনি যাবেনই। কখনো কখনো কোনো আওয়াজ না দিয়ে, হুট করেই। ক্লাসের পেছনে দাঁড়িয়ে শুনতে থাকেন শিক্ষক কিভাবে পড়াচ্ছেন। তাঁর হাতে ধরা ওয়াকি টকি দিয়ে প্রয়োজন বুঝে শিক্ষককে পরামর্শ দেন, কানে লাগানো শ্রবণযন্ত্র দিয়ে শিক্ষক সেসব শুনতে পান। কোনো শিক্ষক যদি নিজে কথা বেশি বলে ছাত্রদের কথা বলার সময় কমিয়ে দেন, তাকে সতর্ক সিগন্যাল দিয়ে দেন ওয়াকি টকিতেই। প্রতিটি ছাত্র স্কুলের কাছে একজন ‘স্কলার’, প্রতি সপ্তাহে এই স্কলারদের হাতে ‘গোল কার্ড’ ধরিয়ে দেওয়া হয়, যাতে সে বুঝতে পারে এই সপ্তাহে তাকে কোন্ গোল অর্জন করতে হবে। বাড়ি থেকে বালিশ-কাঁথা নিয়ে আসে বাচ্চারা, কেননা স্কুল লাইব্রেরি থেকে দেওয়া বইটা হলরুমে শুয়ে-বসে পড়ার আনন্দটা উপভোগ করা যায়। এরপর পড়া বই নিয়ে যত খুশি বক্ বক্ করতে মন চায়, করে ওরা। কেননা শিক্ষকরা ওদের বকবকানি শুনতে খুব ‘ভালোবাসেন’। প্রায়ই স্কুল পরিদর্শনে যান আগ্রহীরা। ক্যাপিটাল ন্যূয়র্ক ডট কম-এর সাংবাদিক এরকম পরিদর্শনের অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছেন, প্রথম গ্রেডের বাচ্চারা শিক্ষকের মুখ থেকে ‘চার্লি এন্ড দ্য চকলেট ফ্যাক্টরি’ উপন্যাসটি শুনছিল কোলের উপর হাত রেখে আর ওদের মুখের ভাব দেখেই বোঝা যাচ্ছিল উপন্যাসের চরিত্রগুলো মাথার ভেতর কিভাবে ঝড় তুলছে। দুষ্টু বাচ্চা সামলানোর তরিকা কি তাঁর? লিখিত আদেশ আছে, ‘সিট লাইক আ প্রফেশনাল’। ক্লাসে ঠিক ভাবে না বসলে এটাকেও খারাপ ব্যবহারের আওতায় নিয়ে শাস্তি দেওয়া হয়। ‘চেক মার্ক’ হচ্ছে শাস্তি, তিনটি পেলে ক্লাসের বাইরে থাকতে হবে, পাঁচটি পেলে লিখিত ভাবে ক্ষমা চাইতে হবে, এরকম। দেয়ালে সাঁটানো পোস্টারে স্পষ্ট বলা আছে, ‘$cholar dollar fines’. শার্ট ঠিক মতো না গুঁজলে এক ডলার, জোরে কথা বললে বা অহঙ্কারী হলে পাঁচ ডলার, ‘জিরো নয়েজ পিরিয়ড’-এ কথা বললে দশ ডলার পর্যন্ত জরিমানা দিতে হয়।শিক্ষকদের ওপর নির্দেশ আছে, লেখাপড়ায় দুর্বল বাচ্চাকে ভিন্ন ভাবে বোধগম্য উপায়ে পড়াতে হবে। বাচ্চাটাকে বিষয়টি সম্বন্ধে বেশি বেশি কথা বলার সুযোগ করে দিতে হবে। তৃতীয় গ্রেডের বাচ্চারা অংকের ওয়ার্ড প্রব্লেমগুলো জোরে পড়বে, ঠিক মত পড়তে পারলে বাকি বাচ্চারা উৎসাহ দেওয়ার জন্য এক সাথে বলে উঠবে, ‘হিজ ব্রেইন ইজ অন ফায়ার!’ খারি শাবাজ নিজেই কোনো একটা অংকের ভুল সমাধান দিয়ে বাচ্চাদেরকে চ্যালেঞ্জ দেন, ‘এসো, আমাকে ভুল প্রমাণ কর।’ আবার কখনো কখনো টাইমার সেট করে সময়ের ভেতর কে অংক সমাধান করতে পারবে, তার তাৎক্ষণিক প্রতিযোগিতা করে বসেন। তাৎক্ষণিক কাণ্ডকারবারই সব, কবে পরীক্ষা হবে তা জানা থাকে না বলে সব সময়ই পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত থাকে বাচ্চারা।প্রায়ই স্থানীয় মানুষদের মুখোমুখি হয়ে প্রশ্নের জবাব দেন স্কুলের প্রিন্সিপ্যাল এবং সিইও। যে বাচ্চাটি প্রথমে আসবে, তাকে আগে ভর্তি করা হবে; যে সবার শেষে আসবে, তাকেও বাদ দেওয়া হবে না- এটা হচ্ছে ভর্তি নীতিমালা। সাকসেস একাডেমির এই ‘স্কুলিং’ পদ্ধতি মাত্র আট বছরে ছড়িয়ে পড়েছে আমেরিকার ষাটটি জেলায়। সম্প্রতি অনুমতি মিলেছে দ্বিগুণ বাজেটে ২০২০ সাল নাগাদ ন্যুয়র্ক সিটির সবচেয়ে বড় স্কুল নেটওয়ার্ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার।শিক্ষা বিস্তারে বাংলাদেশ এখন একটি নাম। সময় কি আসেনি শিক্ষার মান উন্নয়নে সচেষ্ট হওয়ার? আর শিক্ষার মান বাড়াতে শিক্ষকের চেয়ে বড় ভূমিকা আর কে রাখতে পারেন, বলুন?লেখক : শিশুসাহিত্যিক।এইচআর/এমএস
Advertisement