যার জন্ম না হলে বাংলাদেশের জন্ম হতো না, তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি দেশকে ভালোবাসতেন। ভালোবাসতেন দেশের মানুষকে। এমনকি শিশুদেরও ভালোবাসতেন তিনি। তার একাধিক নিদর্শন তিনি রেখেছেন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, বিভিন্ন কার্যক্রমে। পাশাপাশি শিশুরাও বঙ্গবন্ধুকে আপন করে নিত। তাই এই মহান নেতার জন্মদিনকে ‘জাতীয় শিশু দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়।
Advertisement
১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন বঙ্গবন্ধু। পিতা শেখ লুৎফর রহমান ও মাতা সায়রা খাতুনের চার মেয়ে ও দুই ছেলের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন তৃতীয় সন্তান। ছোটবেলায় বঙ্গবন্ধুর ডাকনাম ছিল ‘খোকা’। আচরণে তিনি খোকাদের মতোই সরল, নিষ্পাপ ও জেদী ছিলেন। শিশুদের মতোই মানুষকে ভালোবাসতেন, শত্রু-মিত্র সবাইকে বিশ্বাস করতেন। শিশুদের প্রতি তাঁর ভালোবাসা স্মরণীয় করে রাখতে ১৯৯৭ সালে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ১৭ মার্চকে ‘জাতীয় শিশু দিবস’ ঘোষণা করা হয়।
ছোটবেলা থেকেই বঙ্গবন্ধু ছিলেন ভীষণ দয়ালু। কোনো ছেলে ভীষণ গরিব হলে, টাকার অভাবে ছাতা কিনতে না পারলে, রোদ-বৃষ্টিতে কষ্ট পেলে তিনি তাঁর ছাতাটা দিয়ে দিতেন। এছাড়া টাকার অভাবে কোনো ছেলে বইপত্র কিনতে না পারলে নিজের বইপত্র দিয়ে দিতেন। এমনকি একদিন এক ছেলেকে ছেঁড়া কাপড় পরে থাকতে দেখে নিজের পরনের কাপড় খুলে দিয়েছিলেন তিনি। এমন অসংখ্য ঘটনা রয়েছে তাঁর জীবনে।
এছাড়া দেশ ও জনগণের বিভিন্ন কাজে বঙ্গবন্ধু যখন গ্রামেগঞ্জে যেতেন, তখন চলার পথে শিশুদের দেখলে গাড়ি থামিয়ে তাদের সঙ্গে গল্প করতেন। খোঁজ-খবর নিতেন। দুস্থ ও গরিব শিশুদের দেখলে কাছে টানতেন। কখনো কখনো নিজের গাড়িতে উঠিয়ে অফিসে বা নিজের বাড়িতে নিয়ে যেতেন। এরপর কাপড়-চোপড়সহ নানা উপহার দিয়ে তাদের মুখে হাসি ফোটাতেন।
Advertisement
১৯৭২ সালের এক সকালে বঙ্গবন্ধু হাঁটতে বের হয়েছেন, যেমনটি প্রতিদিন বের হন। সঙ্গে বড় ছেলে শেখ কামাল। তিনি হঠাৎ দেখলেন, একটি ছোট ছেলে বইয়ের ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে। কাছে ডাকার পর ছেলেটি জানায়, তার পা ব্যথা করছে বলে খুঁড়িয়ে হাঁটছে। বঙ্গবন্ধু নিজে ছেলেটির জুতা খুলে দেখেন, জুতার মধ্যে একটি পেরেকের সুঁচালো মাথা বের হয়ে আছে, যার খোঁচায় ছেলেটির পা দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু তখনই চিকিৎসার জন্য তাঁর দেহরক্ষী পুলিশকে নির্দেশ দিলেন, তার হাতে কিছু টাকাও দিলেন। আর পরম মমতায় ছেলেটিকে কোলে নিয়ে আদর করলেন।
শুধু তা-ই নয়, বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ১৯৫৬ সালের ৫ অক্টোবর দেশের ঐতিহ্যবাহী শিশু সংগঠন ‘কচি-কাঁচার মেলা’ প্রতিষ্ঠিত হয়। শিক্ষা, সংস্কৃতিচর্চা, খেলাধুলার মাধ্যমে অসাম্প্রদায়িক চেতনা, দেশ ও মানুষকে ভালোবাসার মানসিকতা বিকাশে শিশুরা সেখানে নিজেদের সুনাগরিক হিসেবে বেড়ে ওঠার প্রেরণা পাচ্ছে। শিশুরা দেশের যোগ্য নাগরিক হিসেবে নিজেদের গড়ে তোলার সুযোগ পাচ্ছে।
তিনি বুঝেছিলেন, দেশের আগামী দিনের নাগরিক আজকের শিশুদের স্বার্থ সংরক্ষণে দরকার। আগামী দিনে তারাই জাতিকে নেতৃত্ব দেবে। সুতরাং তাদের আদর্শ নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। শিশু মনে দেশপ্রেমের আগুন জ্বালাতে না পারলে কোনো শিশু সুষ্ঠু নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠবে না।
শিশুরাই আগামী প্রজন্ম। তারা গড়ে উঠুক কল্যাণকামী ও সৌন্দর্যমূলক জীবনবাদী দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যদিয়ে। এ স্বপ্ন আমাদের চেতনায় জাগিয়ে দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর কাছে তাঁর শিশুপুত্র রাসেল ছিল বাংলাদেশের সব শিশুর প্রতীক। তিনি অনুধাবন করেছেন, শিশুর কাছে জাত-পাত, ধনী-গরিবের ভেদাভেদ নেই। স্বাধীন বাংলাদেশকে গড়তে হলে শিশুদেরও গড়তে হবে। ওদের ভেতরে দেশপ্রেম জাগাতে হবে।
Advertisement
তাই তো সংবিধানের তৃতীয় অধ্যায়ে সব নাগরিকের মৌলিক মানবাধিকারের নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে। সংবিধানের ২৮(৪) অনুচ্ছেদে শিশুদের অগ্রগতির বিশেষ বিধান প্রণয়নের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে শিশুদের জন্য অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষাসহ মৌলিক প্রয়োজনের ব্যবস্থা, সুযোগের সমতা, অধিকার ও কর্তব্য এবং জনস্বাস্থ্য ও নৈতিকতা বিষয়ের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এ লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু শিশু উন্নয়নে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেন।
বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার অন্যতম শক্তি আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম; যারা আজকের শিশু-কিশোর। মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক সমাজ বিনির্মাণ এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার মধ্যদিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তুলছেন, সেই বাংলাদেশের আগামী নেতৃত্ব আজকের শিশু-কিশোরদের কাছে। বঙ্গবন্ধু বলতেন, ‘শিশু হও, শিশুর মতো হও। শিশুর মতো হাসতে শেখো। দুনিয়ার ভালোবাসা পাবে।’
এ বছর বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে ‘মুজিববর্ষ’ ঘোষণা করেছে সরকার। এ উপলক্ষে নানা কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে। বর্তমান শিশুবান্ধব সরকার শিশুদের জীবন-মান উন্নয়নে আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। বাবার আদর্শে বলীয়ান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও শিশুদের অনেক ভালোবাসেন। তাই বলা যায়, ‘শিশুবান্ধব হবে আমাদের দেশ’—এবার জাতির পিতার জন্মদিন ও জাতীয় শিশু দিবসে এটাই হোক আমাদের দৃঢ় প্রত্যয়।
তথ্যসূত্র:বঙ্গবন্ধু শিশুদের বড় ভালোবাসতেন- মো. শাদাত উল্লাশিশুদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ভালোবাসা- আনজীর লিটনশিশুবন্ধু শেখ মুজিব- ইমরুল ইউসুফ শিশুদের বন্ধু বঙ্গবন্ধু- শাহ্জাহান কিবরিয়া ডিটেকটিভ, মার্চ ২০১৯
এসইউ/জেআইএম