বিদেশি নাগরিক হত্যাকাণ্ড, নির্বাচন, বৈশ্বিক নিরাপত্তা, পররাষ্ট্রনীতির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে সম্প্রতি পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম এমপির মুখোমুখি হয়েছিল জাগো নিউজ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সায়েম সাবু। দুই পর্বের প্রতিবেদনের প্রথমটি আজ প্রকাশ করা হলো।জাগো নিউজ : বিদেশি নাগরিক হত্যাকাণ্ডে উদ্বিগ্ন সবাই। বিষয়টি কিভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন?শাহরিয়ার আলম : যে কোনো খুনের ঘটনাই উদ্বেগের। দুই বিদেশি নাগরিকের হত্যাকাণ্ড নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা অমূলক নয়। রাষ্ট্র অকার্যকর করার উদ্দেশ্যেই এই দুটি হত্যাকাণ্ড হয়েছে বলে মনে করছে সরকার। তবে ষড়যন্ত্রকারীদের উদ্দেশ্য কখনই সফল হবে না।খুনের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সৃষ্ট পরিস্থিতি এবং সরকারের পদক্ষেপগুলোর বিষয়ে কূটনীতিকদের অবহিত করা হয়েছে। হত্যাকাণ্ড দুটির তদন্ত স্বচ্ছতা ও পেশাদারিত্বের সঙ্গে এগিয়ে চলেছে বলে কূটনীতিকদের অবহিত করা হয়েছে।খুনিদের খুঁজে বের করে বিচারের মুখোমুখি করতে আরও যা যা প্রয়োজন তার সবই করবে সরকার। এনিয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই।জাগো নিউজ : বিশ্ব দরবারে গুরুত্ব পাচ্ছে বাংলাদেশ, যে কারণে নানা চ্যালেঞ্জও সামনে। চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কতটুকু প্রস্তুত বাংলাদেশ?শাহরিয়ার আলম : ভৌগোলিক কারণে বেশ আগে থেকেই গুরুত্ব পেয়ে আসছে বাংলাদেশ। সেই গুরুত্ব বিবেচনা করে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই ছিল আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্ব নেয়ার পর বাংলাদেশ নতুন মোড়কে পরিচিতি পেতে থাকে। স্বাধীনতার পর এ দেশে জনসংখ্যা ছিল সাড়ে ৭ কোটি। এখন ১৬ কোটি। সব সরকারই এই জনসংখ্যাকে বোঝা বলে বিবেচনা করেছে। একমাত্র প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই জনসংখ্যাকে জনসম্পদ হিসেবে ঘোষণা করেছেন।বোঝাকে সম্পদে রূপ দিতে গিয়ে বন্ধু দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক আরও জোরদার করতে হয়েছে। যেমন- পার্শবর্তী দেশ ভারতের সঙ্গে ব্যবসায়িক-রাজনৈতিক সম্পর্ক আরও উন্নয়ন করার দরকার ছিল এবং আমরা তা করতে পেরেছি।একইভাবে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র না হলেও বৈশ্বিক বিবেচনায় আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ নির্মূলে বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে হয়েছে।আমরা এই কমন গ্রাউন্ডগুলো চিহ্নিত করতে সক্ষম হচ্ছি। সমস্যাগুলো যত দ্রুত আরও স্পষ্ট করতে পারব, তত দ্রুত বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরালো হবে। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের জন্য এটিই বড় চ্যালেঞ্জ।স্নায়ুযুদ্ধের দিন ফুরিয়ে আসছে। একটি রাষ্ট্র শুধু অন্য একটি রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে বাকিদের সঙ্গে বৈরী সম্পর্ক থাকবে, সে দিন শেষ হয়ে গেছে। সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখাই সময়ের চ্যালেঞ্জ।জাগো নিউজ : মুক্তিযুদ্ধের সময় পরাশক্তিগুলোর পররাষ্ট্রনীতি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিকে বিশেষ দিক নির্দেশ করে?শাহরিয়ার আলম : বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতি ২০১৫ সালের পররাষ্ট্রনীতি ছিল না। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর পররাষ্ট্রনীতি বঙ্গবন্ধু প্রণয়ন করেননি। কিন্তু তিনি ১৯৭২ সালে দেশে ফিরে বলেছিলেন, সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব কারো সঙ্গেই বৈরিতা নয়। আমরা বঙ্গবন্ধুর সেই নীতিই অনুসরণ করে চলছি।জাগো নিউজ : মুক্তিযুদ্ধের মতো মৌলিক বিষয়ে...?শাহরিয়ার আলম : মুক্তিযুদ্ধের মতো মৌলিক বিষয়ে ছাড় দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। মুক্তিযুদ্ধ বা যুদ্ধাপরাধের মতো কোনো বিষয়ে বাংলাদেশকে নির্দিষ্ট এক দিকে ঠেলে নিয়ে যাবে, আমরা তা মানতে পারি না। প্রধানমন্ত্রীর শক্ত অবস্থান ইতোমধ্যেই তা প্রমাণ করেছে। কোনো চাপই তাকে টলাতে পারেনি। প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ় অবস্থান বিশ্বনেতাদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছে যে, এটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় এবং এ নিয়ে কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে লাভ হবে না।জাগো নিউজ : এমন অবস্থানের জন্য রাজনৈতিক ভিত্তিটাও শক্ত হওয়া দরকার। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বাংলাদেশের রাজনৈতিক কাঠামো দুর্বল করে দিয়েছে কিনা?শাহরিয়ার আলম : ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে বিশ্ববাসীর চিন্তাধারার পরিবর্তন হয়েছে। ওই নির্বাচন নিয়ে বিশ্বনেতাদের দেয়া বক্তব্য তখনই শেষ হয়ে গেছে। গত ২০ মাসে আর কেউ এসে বলেনি যে, আগাম নির্বাচন দিতে হবে এবং এই পথ অবলম্বন করতে হবে।জাগো নিউজ : কিন্তু তারা নির্বাচন, রাজনীতি নিয়ে সংলাপের কথা তো এখনও বলছেন?শাহরিয়ার আলম : আগাম নয়, আগামী নির্বাচন অর্থাৎ ২০১৯ সালের শুরুর দিকে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, তা নিয়ে আলোচনা হতেই পারে। রাজনৈতিক সংলাপের অনুরোধ যে কেউ করতেই পারেন। তবে নির্বাচন নিয়ে সংলাপের সময় আছে। ২০১৫ সাল শেষ হচ্ছে। কখন বিষয়টি গুরুত্ব দিতে হবে প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয় তা অবগত আছেন।জাগো নিউজ : ২০১৭ সাল লাগাদ আগাম নির্বাচন হতে পারে এমন গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। নির্বাচনের জন্য বিদেশি চাপ রয়েছে। বিএনপি নেত্রীর পক্ষ থেকেও এমন আভাস দেয়া হয়েছে। এ নিয়ে কি বলবেন?শাহরিয়ার আলম : এটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। আগাম নির্বাচনের কোনো তথ্য আমার কাছে নেই। জাতিসংঘ বাংলাদেশ সরকারের কর্মকাণ্ডে সন্তোষ প্রকাশ করছে। প্রতিনিয়ত বিশ্বনেতারা বাংলাদেশকে নিয়ে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করছেন। অনেকেই বাংলাদেশ সফর করে তাদের সমর্থনের কথা জানিয়ে যাচ্ছেন। আমরা যেখানে সফরে যাচ্ছি সেখানেই সমর্থন পাচ্ছি। আগাম নির্বাচন নিয়ে তারা ইশারা-ইঙ্গিতেও কিছু বলতে চাইছে না।জাগো নিউজ : আপনি আঞ্চলিক নিরাপত্তার কথা বলছিলেন। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে ইসলামিক স্টেট (আইএস) নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। সম্প্রতি বিদেশি নাগরিক হত্যাকাণ্ডে আইএস জড়িত বলেও আলোচনা হচ্ছে। এটি কীভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন?শাহরিয়ার আলম : কয়েকটি অঞ্চলের সমন্বয়ে বিশ্ব। অঞ্চলগুলোর মধ্যকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারলে বিশ্বনিরাপত্তা নিশ্চিত হবে।যদিও আফগানিস্তান, ইরাক এবং এর আশেপাশে যুদ্ধের কারণে অশান্ত পরিবেশ বিরাজ করেছিল। তবে তালেবান নিয়ে এখন আর তেমন মাথাব্যথা নেই। এখন আইএস নিয়েই সকলের মাথাব্যথা।বাংলাদেশকেও এ নিয়ে ভাবতে হচ্ছে। বাংলাদেশ বিশ্বশান্তিতে অবদান রাখছে, এটি এখন সর্বমহলে স্বীকৃত। এ জন্য অনেক পরিবর্তনও সাধিত হয়েছে। কয়েক বছর আগে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো যোগাযোগ ছিল না বললেই চলে। গত এক বছরে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রায় ৫/৬টি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে।আমি মনে করি আঞ্চলিক নিরাপত্তায় বাংলাদেশ নেতৃত্ব পর্যায়ে চলে এসেছে। এর মধ্য দিয়ে ভারত-বাংলাদেশ উভয়ই লাভবান হয়েছে। মিয়ানমারও লাভবান হচ্ছে। সম্প্রতি মিয়ানমার সীমান্তে ভারতের সেনাবাহিনীর অপারেশন একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক।সঠিক কূটনৈতিক সম্পর্কের মধ্য দিয়ে অনেক উন্নয়ন করার সুযোগ রয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশি এক নিরাপত্তারক্ষীকে মিয়ানমারের নিরাপত্তা রক্ষীরা হত্যা করেছে। একজনকে আটকও করে। এমন একটি ঘটনার পরেও সম্পর্ক যে আটকে থাকে, তা মিয়ানমারের বন্যাদুর্গত মানুষের জন্য চাল পাঠিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তা প্রমাণ করেছেন।এখন মিয়ানমার সরকারের ইতিবাচক উপলব্ধি লক্ষ্য করতে পারছি। আমরা আঞ্চলিক নিরাপত্তায় একটি সফল মডেল তৈরি করছি, যা নিয়ে বিশ্বনেতারাও আলোচনা করছেন।ছোট্ট একটি ভূখণ্ড নিয়ে পৃথিবীর অনেক দেশই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে। কিন্তু আমরা ৪০ বছর ধরে ছিটমহল, সমুদ্রসীমার সমস্যা নিয়ে অপেক্ষা করেছি। ধৈর্যের বিনিময়ে সিদ্ধান্ত আমাদের পক্ষে এসেছে। পারস্পরিক আস্থা এবং বিশ্বাসের কারণেই এমনটি সম্ভব হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে সম্পর্ক আরও মধুর হচ্ছে।এএসএস/একে
Advertisement