১৬ ডিসেম্বর। বাংলাদেশের বিজয় দিবস। অত্যাচারী পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শোষণ থেকে মুক্তি পায় বাংলার মানুষ। এ বিজয় শুধু আনন্দের নয়। এ বিজয় পরাধীনতার কবল থেকে মুক্তি লাভের বিজয়। স্বাধীনতার বিজয় নিয়েও রয়েছে ইসলামে ভাবনা।
Advertisement
বিজয় দিবস উদযাপনে ইসলামেও বিরোধিতা নেই। বরং দেশের স্বাধীনতা অর্জন ও বিজয় উদযাপন উপলক্ষে আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণা করা এবং তারই কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করাই ইসলামের নির্দেশ।
প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তো ঘোষণাই দিয়েছেন-‘হুব্বুল ওয়াত্বানে মিনাল ঈমান অর্থাৎ দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ।’ আর দেশকে ভালোবাসার সঙ্গে দেশের স্বাধীনতা ও পরাধীনতা থেকে মুক্তি লাভ করে বিজয় অর্জন করা একই সুতোয় গাঁথা।
ফিরে দেখাদীর্ঘ প্রায় আড়াইশ বছর ইংরেজ শাসনের অবসানের পর স্বাধীনতা লাভ করে ভারতীয় উপমহাদেশ। তারপর নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে জন্ম নেয় দুটি ভূখণ্ড। ভারত এবং পাকিস্তান।
Advertisement
ভারত ভাগের সময় বাংলাদেশ চলে যায় পাকিস্তানের অধীনে। পাকিস্তান স্বাধীন হয়েছে ঠিকই কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের বাংলাভাষীরা মূলত স্বাধীনতার স্বাদ পায়নি। বরং পশ্চিম পাকিস্তানের হায়েনাদের আক্রমণ ও জুলুম-নির্যাতনে নিষ্পেষিত হয়েছে পূর্ব পাকিস্তানখ্যাত বাংলা ভাষাভাষী মানুষ। যে জুলুম অত্যাচারের অবসান হয়েছে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর।
১৬ ডিসেম্বর। ঐতিহাসিক বিজয় দিবস। বাংলাদেশের এ বিজয়ের রয়েছে ঐতিহাসিক পটভূমি। যার শুরু হয়েছিল ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে। ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ জব্বার রফিক বরকতের রক্তেই আজকের বিজয় দিবসের বীজ বোনা হয়েছিল।
ভাষা আন্দোলনের পর কেটে গেছে পরাধীনতা, অত্যাচার, জুলুম-নির্যাতনের অনেক বছর। বীর বাঙালির হৃদয়ে দাগ কেটে আছে ভাষা আন্দোলনসহ ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৬-এর ঐতিহাসিক ৬ দফা, ‘৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান এবং সর্বশেষ ১৯৭১ সালের ঐতিহাসিক রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর শুরু হয় কামানের গোলাবর্ষণ। নিরস্ত্র বাংলাভাষী মানুষ পাকিস্তানি হায়েনাদের অতর্কিত আক্রমণে দিশেহারা প্রায়। মুক্তির লক্ষ্যে শুরু হয় মুক্তি সংগ্রাম। দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে অসংখ্য প্রাণের আত্মদান, অত্যাচার-নির্যাতন ও কারাভোগের মাধ্যমে অবশেষে অর্জিত হয় কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা। আজকের ১৬ ডিসেম্বর দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের ফসল।১৯৭১ সালের বহু ত্যাগ ও রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশিরা পেয়েছে কাঙিক্ষত স্বাধীনতা। ১৬ ডিসেম্বর পাক-হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে অর্জন করেছে কাঙ্ক্ষিত বিজয়। আজ ১৬ ডিসেম্বর; ঐতিহাসিক বিজয় দিবস।
Advertisement
বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে যার নেতৃত্ব ও ত্যাগে ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছে, তিনি হলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আজকের এই দিনে বঙ্গবন্ধুসহ সব বীর শহীদ ও মুক্তিযোদ্ধার প্রতি রইলো গভীর শ্রদ্ধা, ভালোবাসা এবং দোয়া।
এ দিবসে আনন্দ উদযাপন ও সেমিনার-সিম্পোজিয়াম ইসলামে নিষিদ্ধ নয়। বরং ইতিহাস বিকৃত না করে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে এ দিবসটিকে যথাযথ মর্যাদার সঙ্গে উদযাপন করা জরুরি। পাশাপাশি দেশের বিজয়ের জন্য রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে আত্মদানকারী সব শহীদকে স্মরণ ও দোয়া মোনাজাত করা দেশের প্রতিটি নাগরিকের ঈমানের একান্ত দাবি।
যদিও বর্তমান সময়ে অনেকেই মনে করেন যে, বিজয় দিবস উদযাপন মানেই ইসলামের অবমাননা। বিষয়টি তা নয়; কারণ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেও বিজয় দিবস উদযাপন করেছিলেন।
তিনি ইসলাম প্রচারের কারণে নিজের মাতৃভূমি ত্যাগ করে হিজরত করেছিলেন মদিনায়। দীর্ঘ ১০ বছর নির্বাসিত জীবন কাটানোর পর সফলতার সঙ্গে নিজ মাতৃভূমি পবিত্র মক্কা নগরী স্বাধীন করেন। অর্জন করেন মহান স্বাধীনতা ও বিজয়।
প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দেশ ত্যাগের সময় বার বার অশ্রুসিক্ত নয়নে জন্মভূমির দিকে ফিরে ফিরে তাকিয়েছিলেন আর বলেছিলেন-‘হে প্রিয় মাতৃভূমি মক্কা! আমি তোমাকে ভালোবাসি। তোমার অধিবাসীরা যদি আমাকে অত্যাচার-নির্যাতন করে বিতাড়িত না করত; আমি তোমাকে কখনো ছেড়ে যেতাম না।’
দশম হিজরিতে মক্কা বিজয়ের পর তিনি আনন্দ উদযাপন করেছেন। বিজয়ে প্রথম আনন্দে তিনি আদায় করেছেন ৮ রাকাআত নামাজ। প্রিয় জন্মভূমির স্বাধীনতায় তিনি এত বেশি খুশি হয়েছিলেন যা ভাষায় ব্যক্ত করা সম্ভব নয়।
বিজয়ের আনন্দে তিনি সেদিন ঘোষণা করেছিলেন, ‘যারা কাবাঘরে আশ্রয় নেবে তারা নিরাপদ। এভাবে মক্কার সম্ভ্রান্ত কয়েকটি পরিবারের ঘরে যারা আশ্রয় নেবে; তারা যত অত্যাচার নির্যাতনকারীই হোক তারাও নিরাপদ। এ ছিল প্রিয়নবির মক্কা বিজয়ের আনন্দ উৎসবের ঘোষণা।
দেশপ্রেম যেমন ঈমানের অঙ্গ, তেমনি দেশের জাতীয় পতাকার প্রতি সম্মান ও মর্যাদা দেয়া আবশ্যক। বিজয় দিবসে দেশের প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সম্মানের সঙ্গে এ পতাকা উত্তোলন করাও ঈমানের দাবি। হোক তা সরকারি প্রতিষ্ঠান কিংবা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান; হোক তা মাদরাসা আর হোক তা মসজিদ।
বিজয় দিবস উদযাপনে প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একটি যুযোপযোগী হাদিস তুলে ধরা হলো-রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আল্লাহর পথে একদিন ও এক রাত (দেশের) সীমানা পাহারা দেয়া এক মাসব্যাপী রোজা পালন ও মাসব্যাপী রাত জাগরণ করে নামাজ আদায়ের চেয়ে বেশি কল্যাণকর। এ অবস্থায় যদি ওই ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করে; তবে যে কাজ সে করে যাচ্ছিল, মৃত্যুর পরও তা তার জন্য অব্যাহত থাকবে; তার রিজিক অব্যাহত থাকবে; কবর ও হাশরে ওই ব্যক্তি ফেতনা থেকে মুক্ত থাকবে।’ (মুসলিম)
দেশপ্রেম, দেশের স্বাধীনতা রক্ষায় প্রহরা ও বিজয় দিবসে তাসবিহ, ক্ষমা প্রার্থনা এবং আনন্দ উৎসবও দেশের প্রতিটি নাগরিকের আবশ্যকীয় কাজ। এ বিজয় দিবসে দেশের জন্য আত্মদানকারী সব শহীদের জন্য দোয়া ও প্রার্থনা করা ঈমানের একান্ত দাবি। যেমনটি আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন-
‘(হে নবি!) যখন আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় আসবে; আপনি মানুষকে দলে দলে আল্লাহর দ্বীনে প্রবেশ করতে দেখবেন। তখন আপনি আপনার পালনকর্তার তাসবিহ তথা পবিত্রতা বর্ণনা করুন এবং তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন। নিশ্চয় তিনি ক্ষমা ও তাওবা কবুলকারী।’ (সুরা নসর)
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের নিরপরাধ বাংলা ভাষাভাষী মানুষ অত্যাচারী পশ্চিম পাকিস্তানিদের অত্যাচার নির্যাতন থেকে মুক্তির জন্য মহান আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করব। দেশের উন্নয়নে তার কাছে সাহায্য চাইব। নিজেদের পরিশুদ্ধ নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতেও তার সাহায্য চাইব। নিজেদের দেশপ্রেমিক হিসেবে গড়ে তুলে প্রকৃত ঈমানদার হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করব। নিজেদের দেশের সেবায় উৎসর্গ করব। এমনটিই ইসলামের দিকনির্দেশনা।
সুতরাং বিজয় দিবসে মহান আল্লাহ তাআলা প্রশংসা ও দেশের জন্য আত্মদানকারী সব শহীদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা দেশের সব নাগরিকের ঈমানের অকাট্য দাবি।
বিজয় দিবসে এদেশের প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব হলো- বিজয় দিবস উদযাপনের পাশাপাশি স্বাধীনতার জন্য আত্ম ও অঙ্গদানকারী বীর সন্তানদের যথাযথ স্মরণ করা। স্বাধীনতার জন্য জীবন দেয়া বীর শহীদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করা। তাদের পরিবার-পরিজনের খোঁজ-খবর নেয়া। তাদের প্রতি সমবেদনা জানানো।
বিজয় দিবসে সব শহীদের আত্মার মাগফেরাত কামনার পাশাপাশি দেশের স্বাধীনতা রক্ষায় একাত্মতা প্রকাশ করে দেশকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত থাকাই হোক প্রতিটি নাগরিকের দৃপ্ত শপথ।
এমএমএস/এমএস