‘গ্রামেগঞ্জে মানুষের কাছ থেকে ভালোবাসা পাওয়া যায়। কিন্তু আগের মতো আর টাকা পাওয়া যায় না। মানুষ আর ওসবে বিশ্বাসও করতে চায় না। অন্য কাজেও মন বসে না। ফেরি করে বেড়ানোর অভ্যাস। রোজ সকালে ঢাকায় আসি। ফুটপাতের ভদ্র মানুষদের ঠেঁকিয়ে টাকা তুলি। নানা কৌশলে হাত বাড়াই। কি আর করা। বেঁচে থাকার আর কোনো উপায়ও নেই। এটিই এখন পেশা।’ বলছিলেন, বেদে কন্যা মুক্তা।রাজধানীর মহাখালি কাঁচাবাজারের সামনে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে কথা হয় মুক্তার সঙ্গে। ওর সঙ্গে আরও তিন জন। সবার বয়সই ২২ কি ২৪ এর কোটায় সীমাবদ্ধ। দুই জনের হাতে ছোট ছোট দুটি সাপের বাক্স। তবে একটিতে সাপ আছে বলে জানা গেল। চারজনের আয় রোজগারের সম্বল এটিই। অন্য বাক্সটি ভয় দেখানোর জন্য।রাজধানীতে এমন চিত্র এখন সহসাই চোখে পড়ে। অল্পবয়সী বেদেনীরা দল বেধে ঢাকার বিভিন্ন রাস্তায় এভাবেই টাকা তুলে থাকেন। কেউ বিব্রত হয়ে, কেউ ভয়ে পাঁচ-দশ টাকা দিয়ে দ্রুত কেটে পড়েন। আবার কেউ কেউ অপমানও করেন। এভাবেই বেদে-বেদেনীদের পেশার রূপান্তর ঘটছে। সম্প্রতি সাভারের পোড়াবাড়ি বেদেপল্লীতে গিয়েও একই চিত্র দেখা যায়। অনেকেই আর এই পেশায় থাকতে চাইছেন না। সাভারের অমরপুর, পোড়াবাড়ি, কাঞ্চনপুর ও বক্তারপুর এলাকা নিয়ে বেদেপল্লী। এখানে প্রায় ১৫ হাজারের মতো বেদের বসবাস। পূর্ব পুরুষেরা নৌকায় বসবাস করলেও গত শতকের মাঝামাঝিতে পোড়াবাড়ি গ্রামে ঠিকানা গড়ে বেদেরা। ক্রমেই তা বিস্তৃত ঘটছে। পরিবর্তন ঘটছে আবাসস্থলেরও। এক সময় নৌকায় বসবাস করা মানুষগুলো এখন গৃহস্থের ন্যায় পাকা, আধা পাকা ও টিনের বাড়িতে বসবাস করছে। কেউ কেউ দোতলা, তিনতলার ভিত্তি দিয়েও বাড়ি নির্মাণ করছেন। পরিবর্তন এসেছে বেদে পেশাতেও। অনেকেই সাভার বা রাজধানীতে কাজ করছেন। কেউ পল্লীর মধ্যে দোকান দিয়েছেন। এমনকি বেদেদের কেউ কেউ এখন দেশের বাইরে শ্রম দিয়ে টাকা পাঠাচ্ছেন।এক সময় বেদেপল্লীতে সাপ বেঁচাকেনা হতো। তাও আর এখন চোখে পড়ে না। বন বিভাগের নিষেধাজ্ঞার কারণে সাপুরিয়াদের সাপ বেঁচা-কেনাও বন্ধ হয়ে গেছে। পোড়াবাড়ি মোড়ে দোকান করেন বেদেকন্যা বৈশাখী। বলছিলেন, মা-দাদির সঙ্গে আগে গাওয়াল করতে যাইতাম। সিঙ্গা লাগিয়ে, দাঁতের পোকা তুলে, তাবিজ-কবজ বিক্রি করে সংসার চলত। এখন আর যাই না। দোকানেই ভালো চলছে। মা-দাদিও গাওয়াল করা বাদ দিয়েছেন। তবে বাবা এখনও সাপ খেলা দেখিয়েই আয় করেন।’পেশা এবং বেদেপল্লীর সার্বিক বিষয় নিয়ে আলাপ হয় সাপুরিয়া সরদার তাহের উদ্দিনের সঙ্গে। গত কোরাবানি ঈদের পরপরই তার দল নিয়ে উত্তরবঙ্গের জেলাগুলোতে যায় গাওয়াল (ফেরি) করতে। কোরবানি ঈদকে সামনে রেখে পল্লীতে ফিরেছেন। ফিরছেন অন্যরাও। তাহের উদ্দিন জাগোনিউজকে বলছিলেন, চোখের সামনে অনেক পরিবর্তন ঘটল। গোটা সমাজেরই যখন পরিবর্তন ঘটছে, তখন এর প্রভাব আমাদের ওপরেও পড়ছে। মানুষ আর তাবিজ-কবজ বিশ্বাস করতে চায় না। আমাদের পেশা দেখে মানুষ আনন্দ পায়। কিন্তু সে আনন্দে আমাদের তো আর পেট চলে না। অনেকেই এ পেশা ছেড়ে দিচ্ছে। বিশেষ করে বেদেনীদের অনেকেই গাওয়ালে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। নিজ পেশার পরিবর্তনে খারাপ লাগে, কিন্তু সমাজে টিকতে হলে আর কোনো উপায় নেই। তাহের সরদারের বড় ছেলের স্ত্রী দিপা শ্বশুরের কথায় সায় দেন। দিপা বলেন, প্রায় বছর হয় গাওয়ালে যাই না। আর ভালো লাগে না। মানুষ আর আগের মতো দেখতে অভ্যস্ত নয়। দুই ছেলেমেয়ে। ওদের পড়াশোনা নিয়েই এখন ব্যস্ত থাকছি। ওদের বাবা সাপ খেলা দেখায়। আমরা চাই, সন্তানেরা এ পেশায় না আসুক। মানুষের মতো মানুষ হয়ে যেন সম্মান নিয়ে বাঁচতে পারে। এএসএস/এআরএস/এমএস
Advertisement