প্রবাস

কর্মফলেই মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশিরা অবৈধ

মালয়েশিয়ায় ভিসা নিবন্ধন করেও বৈধতা পায়নি বেশিরভাগ বাংলাদেশি। প্রতারণার শিকার হওয়া এসব প্রবাসীরা আটক হওয়ার আশঙ্কায় দেশটির বনে জঙ্গলে খেয়ে-না খেয়ে দিন পার করছে। একের পর এক নানা হয়রানির শিকার হচ্ছে। আর এসবের পেছনে নিজেরাই দায়ী বলে মনে করছেন বিশেজ্ঞরা।

Advertisement

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশিরা বৈধ হওয়ার স্বপ্ন দেখে। কেউই চায় না বিদেশের মাটিতে অবৈধ থাকতে। কিছু আদম দালালের কারণে বহু অসহায় বাঙালিরা দেশটিতে আজও অবৈধ। বিশ্বাস করে প্রতারিত হয়েছে। ভিটেমাটি বিক্রি করে দেশ থেকে এসে বিদেশেও তারা নানা হয়রানির শিকার হচ্ছে। সঠিক দিকনির্দেশনার অভাবে এমনটি হচ্ছে।

এদিকে জাল ভিসা তৈরির অভিযোগে অভিযুক্ত এক বাংলাদেশিকে আটক করেছে ইমিগ্রেশন পুলিশ। আরও দুইজনকে গ্রেফতার করতে অভিযান শুরু করেছে। সম্প্রতি কুয়ালালামপুর জালান চৌকিত এলাকার একটি কনডোমনিয়ামে অভিযান চালিয়ে এক বাংলাদেশিকে আটক করে। এ সময় উদ্ধার করা হয় ৪০টি বাংলাদেশি পাসপোর্টের ফটোকপি, ২টি কম্পিউটার, ভিসা তৈরির তিনটি মেশিন ও চারটি জাল ভিসা স্টিকার।

বাংলাদেশি দালালদের খপ্পরে পড়ে প্রতিদিন মর্মান্তিক জীবনযাপনও করছেন অনেকে। এ শ্রমিক বলেন, দিনে ১২ ঘণ্টা কাজের পর রাতে অনেকেই ঘুমায় না। পুলিশি অভিযানের ভয়ে আশপাশের জঙ্গলে চলে যায়। সেখানে গাছপালার নিচে আশ্রয় নেয়।

Advertisement

মালয়েশিয়া সরকার প্রতারণার শিকার বিদেশি কর্মীদের একটি প্রক্রিয়ায় নিয়ে আশার আশ্বাস দিলেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। বরং ধরপাকড় অভিযান চলছেই। আগামী ধরপাকাড় আরও বাড়তে পারে বলে মনে করছে প্রবাসী বাংলাদেশিরা। দেশটির বিভিন্ন স্থানে প্রতিনিয়তই দেশীয়করণে একের পর এক অভিযান চলছে। আর এ চলমান অভিযান আগামী আরও বাড়তে পারে বলে মালয়েশিয়ার প্রশাসন এমন ইঙ্গিত দিয়েছে।

কুয়ালালামপুর ইমিগ্রেশন প্রধান হামিদি এডাম স্থানীয় সাংবাদিকদের জানান, আটক বাংলাদেশি দুই বছর ধরে বিদেশি অভিবাসী অধ্যুষিত লেমবাহ কিলাং লামা ও বুকিত বিংতান এলাকায় অবৈধ কর্মকান্ডের বিস্তার করে আসছিল। আটক বাংলাদেশি বিভিন্ন শ্রমিকদের জন্য জাল ভিসা, সিআইডি কার্ড ও আইকার্ড তৈরির কাজে নিয়োজিত ছিল। আর এসব জাল কাগজপত্র তৈরিতে জনপ্রতি ২৫০০ থেকে ১৬ হাজার টাকা নিত ওই বাংলাদেশি। এভাবে প্রতিমাসে কমপক্ষে ৩ লাখ টাকা ইনকাম করতো।

মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে বাংলাদেশিদের সুনাম থাকায় কিছু অসাধু চক্র নানান অবৈধ পথ ব্যবহার করে প্রতিনিয়ন মানব পাচার করছে ফলে সহজেই বাড়ছে অবৈধ লোকের সংখ্যা। মালয়েশিয়ার সরকার দফায় দফায় বৈধ হওয়ার সুযোগ দেয়া সত্ত্বেও অবৈধ বাংলাদেশিদের সংখ্যা বেড়ে চলেছে।

চলতি বছরে কয়েকটি স্থানে অভিবাসন বিভাগের অভিযানে জাল পাসপোর্ট ভিসা তৈরির অভিযোগে আরোও ১৫জন বাংলাদেশিদের আটক করা হয়।

Advertisement

নির্মাণ শ্রমিক মোহাম্মদ মিলন হোসেন বলেন, দেশের প্রবাসী আয় বৃদ্ধিতে অবদান রাখা অবৈধ বাংলাদেশিরা আটক হয়ে দেশে ফিরলে একদিকে তাদের পরিবার যেমন ক্ষতির মুখে পড়বে তেমনি প্রবাসী আয়েও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তাই, দেশটিতে থাকা প্রবাসীদের আহ্বান এই সঙ্কট সময়কে বিশেষ গুরুত্ব দেয়ার অনুরোধ জানিয়েছে সরকারকে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এদিকে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশ মালয়েশিয়া বাংলাদেশিদের জন্য ইতিবাচক থাকলেও এ সুযোগ নিয়ে বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগে বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়া পর্যন্ত রয়েছে দালাল ও মানবপাচারকারী চক্রের নানান অপতৎপরতা। যদিও বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার দালাল ও মানব পাচার রোধে রয়েছে কঠোর আইন। আর এ আইনকে বাস্তবায়নে এবং কর্মী ব্যবস্থাপনায় স্ট্যান্ডার্ড অর্জনে কাজ করে চলেছে দুই দেশের সরকার।

কুয়ালালামপুরে বাংলাদেশি ব্যবসায়ী কাজী সালাহ উদ্দিন এ প্রতিবেদককে বলেন, প্রবাসী বাংলাদেশি অধ্যুষিত কোতারায়া এলাকায় প্রতিদিন বাংলাদেশি শ্রমিকদের ব্যস্ততা থাকত। তবে গত বছরের ১ সেপ্টেম্বর থেকে তাদের আর দেখা যাচ্ছে না। অনেকেই আত্মগোপনে চলে গেছেন।

তিনি আরও বলেন, ইমিগ্রেশন বিভাগের ধড়পাকড়ের পর থেকে বাংলাদেশি ছাড়াও অন্যান্য বিদেশি শ্রমিকরা আড়ালে চলে গেছেন। শুধু অবৈধরাই নয়, বৈধ অনেক শ্রমিকেই এখন হয়রানির ভয়ে আত্মগোপণ করছেন। এ ছাড়াও কংসীর মতো অভিবাসীপ্রবণ এলাকায় এখন খুব কম সংখ্যক বিদেশি শ্রমিক দেখা যাচ্ছে।

কোটা দামাসারা থাকেন বাংলাদেশি শ্রমিক নূরু। জানান, তার সঙ্গে কাজ করা অনেক বাংলাদেশি শ্রমিক সঠিক কাগজপত্রের অভাবে বাংলাদেশে ফেরত যাচ্ছেন। এমনকি তাদের ফ্যাক্টরিতে গত কয়েকদিন আগে ইমিগ্রেশন বিভাগ অভিযান চালিয়েছিল। তবে সবারই সঠিক কাগজপত্র থাকায় কাউকে আটক করা হয়নি। কিন্তু অনেক শ্রমিক ভয় পেয়ে পরের দিন আত্মগোপনে চলে যান।

দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার অন্যতম সমৃদ্ধশালীদেশ মালয়েশিয়ায় বিদেশি কর্মীর মোট পরিসংখ্যানের দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশিরা। এর আগে ২০১৫ সালের এক হিসাব বলছে, বিদেশি কর্মীর এই পরিসংখ্যানে ১৩ শতাংশ নিয়ে তৃতীয় স্থানে ছিল বাংলাদেশি কর্মীরা। এত গেলো বৈধদের পরিসংখ্যান। অবৈধ বাংলাদেশিদের সংখ্যা কারো জানা না থাকলেও, অবৈধদের সংখ্যা নেহাত কম নয়। এ সব অবৈধ বাংলাদেশিরা বৈধ হতে চেয়েও প্রতারিত হয়েছে।

দেশটির নিয়োগকর্তাদের অবৈধ বিদেশি কর্মীদের উৎপাদন, নির্মাণ, সেবা এবং কৃষিসহ মোট পাঁচটি খাতে বৈধ করে নেয়ার সুযোগ দিয়েছিল মালয়েশিয়ার সরকার। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে গেল বছরের জুন পর্যন্ত বিভিন্ন মেয়াদে প্রায় আড়াই বছর ছিল সে সুযোগ। সে সময় প্রায় ৬ লাখ ৪৫ হাজার অবৈধ বিদেশি নিবন্ধন করে, এতে প্রায় সাড়ে ৩ লাখ অবৈধরা বৈধতা পাওয়ার যোগ্য বলে বিবেচিত হয়।

এদিকে মাসের পর মাস ধরে অবৈধতার অভিশাপ নিয়ে গ্রেফতার আতংকে দিন পার করছে হাজার হাজার বাংলাদেশী শ্রমিক। দুদেশের সরকারের আন্তরিকতায় সহজ শর্তে বৈধতা পাবে এমনটাই প্রত্যাশায় প্রহর গুনলেও মালয়েশিয়া সরকার শক্ত অবস্থানে রয়েছে। অবৈধ বিদেশিদের আর বৈধতা দেবে না। নিজ নিজ দেশে ফিরতেই হবে তাদের।

এদিকে স্থগিত কর্মী নিয়োগ পুনঃরায় উন্মুক্ত করতে এবং অবৈধদের বৈধতা ও প্রতারণার শিকার কর্মীদের সমস্যা সমাধানে কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রাখলেও নামধারী কতিপয় দালাল চক্র আগাম তৎপরতা ও ভুল বার্তা দিয়ে এ প্রক্রিয়াকে ফেলেছে জটিলতায়। কেননা সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে মাহাথির সরকারের স্পষ্ট ঘোষণা এবং বাংলাদেশ সরকারের স্পষ্ট অবস্থান থাকা সত্ত্বেও মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশের কতিপয় এজেন্টদের তৎপরতা কর্মী নিয়োগ প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করছে। ফলে দুটি জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের সভায় নির্দিষ্ট হওয়া বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণে মালয়েশিয়া সরকার সতর্কতা অবলম্বন করছে।

এমআরএম/জেআইএম