রাজনীতি কারও কাছে ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি আবার কারও কাছে জনগণের সেবা করার মাধ্যম। রাজনীতিতে নেমে কেউ নিজের স্বার্থ হাসিলে ব্যস্ত হন, কেউবা মানুষের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেন। কিন্তু রাজনীতিতে একটি কথা আছে, ‘এখানে শেষ কথা বলতে কিছু নেই।'
Advertisement
কথাটি যেন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে আবারও জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়ায়। নতুন নতুন সমীকরণ, সমীকরণের বিপরীতে ফের কোনো সমীকরণ, জোট-মহাজোটের ভাঙা-গড়ার খেলা; এভাবেই যেন চলতে থাকে, চলতে থাকে নানা আলোচনা-সমালোচনা। সারাবিশ্বের রাজনীতির অঙ্গনের মতো বাংলাদেশেও দল বা জোট পরিবর্তনের অহরহ ঘটনা ঘটছে। ১৪ দলীয় জোট, মহাজোট, ২০ দলীয় জোট, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও যুক্তফ্রন্ট ঘিরে চলছে নতুন নতুন মেরুকরণ।
আরও পড়ুন > প্রধানমন্ত্রীর কাছে বি. চৌধুরীর খোলা চিঠি
জাতীয় পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জি এম কাদের ইতোমধ্যে বলেই ফেলেছেন, জাপা এককভাবে নতুন জোটের নেতৃত্ব দিতে পারে। মহাজোটের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে সত্যিকারের বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করতে পারে।
Advertisement
কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীও (বীরউত্তম) ইতোমধ্যে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের রাজনৈতিক অবস্থান পরিষ্কারের আহ্বান জানিয়েছেন। ব্যারিস্টার আন্দালিভ রহমান পার্থের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি- বিজেপি ২০ দলীয় জোট ত্যাগ করেছে। গত ২৭ জুন ২০ দলের প্রভাবশালী নেতা লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি- এলডিপি সভাপতি কর্নেল (অব.) ড. অলি আহমেদের (বীরবিক্রম) নেতৃত্বে আত্মপ্রকাশ করেছে ‘জাতীয় মুক্তি মঞ্চ’। তার সঙ্গে ছিলেন বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহম্মদ ইবরাহিম (বীরপ্রতীক), মরহুম শফিউল আলম প্রধানের জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি- জাগপার সভাপতি ব্যারিস্টার তাসমিয়া প্রধান ও খেলাফত মজলিশ। সেখান থেকে অলি আহমেদ জাতীয়তাবাদী ও গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
অন্যদিকে নির্বাচনের আগে গঠিত যুক্তফ্রন্টেও চলছে নানা ধরনের আলোচনা, অসন্তোষ। গত ১৪ জুনের সভায় এ অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। যুক্তফ্রন্টের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর কাছে শরিকরা রাজনৈতিক অবস্থান সম্পর্কে জানতে চান। সেখানে তিনি যুক্তফ্রন্টের অবস্থান পরিষ্কার করতে ব্যর্থ হন। এরপর দ্রুত জোট কার্যকর করতে আরও দুটি সভা শেষে গত ২৫ জুন জাতীয় প্রেস ক্লাবে সরকার ঘোষিত বাজেটের ওপর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে ফ্রন্টের উদ্যোগে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সেখানেও লক্ষ্য করা গেছে নানা অসঙ্গতি, ক্ষোভ ও মতবিরোধ।
আরও পড়ুন > যুক্তফ্রন্টের রাজনৈতিক অবস্থান কী, জানতে চায় শরিকরা
যুক্তফ্রন্টের উদ্যোগে বিকল্পধারা আয়োজিত ওই সংবাদ সম্মেলনের ব্যানার নিয়েও আপত্তি ছিল শরিকদের। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জোটের এক নেতা বলেন, এটা ফ্রন্টের নয় বিকল্পধারার দুই এমপির (সংসদ সদস্য) বক্তব্য রাখার আয়োজন। আসলে বি. চৌধুরী তার ছেলেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য যে রাজনীতি করেছেন, তাতে তিনি সফল হয়েছেন। এজন্য সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার হয়েছে যুক্তফ্রন্ট।
Advertisement
সেখানে উপস্থিত ছিলেন না যুক্তফ্রন্টের গুরুত্বপূর্ণ ও শীর্ষ নেতারা। আ স ম রবের নেতৃত্বাধীন জেএসডি ও মাহমুদুর রহমান মান্নার নেতৃত্বাধীন নাগরিক ঐক্য যখন বি চৌধুরীকে ছেড়ে চলে যায়, বি. চৌধুরী তখন প্রায় রাজনীতিশূন্য হয়ে পড়েছিলেন। ঠিক তখনই বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি- বাংলাদেশ ন্যাপ চেয়ারম্যান জেবেল রহমান গানি ও ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি- এনডিপি চেয়ারম্যান খোন্দকার গোলাম মোর্ত্তজা যুক্তফ্রন্টে যোগ দেন, প্রাণ ফিরে পান বিএনপির প্রতিষ্ঠাকালীন মহাসচিব বি. চৌধুরী।
বাজেট নিয়ে আয়োজিত ওই সংবাদ সম্মেলনে শরিক দল দুটির মহাসচিবরা উপস্থিত ছিলেন। তারা সরকারের নানা ব্যর্থতা এবং প্রস্তাবিত বাজেটের কঠোর সমালোচনা করেন। কিন্তু যুক্তফ্রন্টের চেয়ারম্যান বি. চৌধুরী ও তার দলের দুই এমপি মেজর (অব.) আবদুল মান্নান ও মাহী বি. চৌধুরী সরকারের প্রশংসায় ছিলেন পঞ্চমুখ।
আলোচনা সভায় জোটের অপর শরিক নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল অধ্যাপক ডা. এম এ মুকিতের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি ও আবু লায়েস মুন্নার নেতৃত্বাধীন সাংস্কৃতিক মুক্তিজোটের কোনো প্রতিনিধিকে দেখা যায়নি। এ বিষয়ে জোটের শরিক এক শীর্ষ নেতা বলেন, ভাই কিসের যুক্তফ্রন্ট? ফ্রন্টের প্রধান শরিক বিকল্পধারার দুই এমপি সরকারের পক্ষে কথা বলায় ব্যস্ত। তারা তাদের উদ্দেশ্যে শরিকদের ব্যবহার করছে মাত্র।
আরও পড়ুন > চাইল ১৫০, পেল ৩টি
তার মতে, ভিন্ন কিছুর আশা নিয়ে বি. চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন নতুন জোটে শরিক হয়েছিলাম। কিন্তু এখন সেই আশা কারও মধ্যে নেই। এটা পরিষ্কার যে, বি. চৌধুরীরা নিজেদের স্বার্থে আমাদের ব্যবহার করেছেন।
জোট শরিক বাংলাদেশ ন্যাপ মহাসচিব এম. গোলাম মোস্তফা ভুইয়া বলেন, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ ও তার যে রাজনৈতিক গোত্র, সেখানে বি. চৌধুরী, আমরা একই গোত্রের মানুষ। আমাদের আকাঙ্ক্ষা ছিল, যেহেতু আমরা বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী আদর্শকে ধারণ করি; সেই আদর্শকে ধারণ করেই আমরা এ জোটকে নিয়ে অগ্রসর হব। তবে নির্বাচনের পরে, নৌকা মার্কা নিয়ে নির্বাচন করেও আমরা না মহাজোট, না বিরোধী দল- তা এখনও পরিষ্কার হয়নি। মূলত আমরা মনে করি, যুক্তফ্রন্টের যে লক্ষ্য, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ, সে লক্ষ্য অর্জনে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। ‘যুক্তফ্রন্টকে এখন কার্যকর করা খুবই কষ্টসাধ্য’ বলে মত দেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, ‘রাজনীতি পরিষ্কার করতে না পারলে কোনো রাজনৈতিক জোট তার লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে না। যুক্তফ্রন্টের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমি খুব একটা আশাবাদী নই। জাতীয় নির্বাচনের বিষয়ে যুক্তফ্রন্টের মূল্যায়ন যেমন পরিষ্কার নয়, উপজেলা নির্বাচন নিয়েও আমরা অন্ধকারে ছিলাম। গত ছয় মাসে সরকারের নানা ভুল ও দুর্নীতি নিয়ে দলগতভাবে আমরা কথা বললেও জোটগতভাবে কোনো কথা বলিনি, বলতে পারিনি। জনগণের প্রত্যাশার জায়গাটা আমরা ধরতে পারিনি। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের দুর্নীতি, ধানের ন্যায্যমূল্য পেতে কৃষকের ব্যর্থ হওয়া, পাট শ্রমিকদের মজুরি না পাওয়া, নতুন করে গ্যাসের মূ্ল্যবৃদ্ধি- এসব ক্ষেত্রে আমরা কোনো ভূমিকা রাখতে পারিনি। তাহলে আমাদের রাজনীতিটা কিসের জন্য? এসব বিষয়ে পরিষ্কার অবস্থান গ্রহণ করতে না পারলে ফ্রন্টের প্রয়োজনীয়তা থাকে না। রাজনীতি মানুষের জন্য, দেশের জন্য। তাই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রাজনীতির অবস্থানও পরিষ্কার করতে হবে।
আরও পড়ুন > বি.চৌধুরী মান্নান মাহীকে বিকল্প ধারা থেকে বহিষ্কার
এ বিষয়ে বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান হামদুল্লাহ আল মেহেদি বলেন, আসলে যুক্তফ্রন্টের রাজনৈতিক অবস্থান এখনও পরিষ্কার নয়। পরিষ্কার রাজনৈতিক অবস্থান নির্ধারণ করতে না পারলে লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়। আমার মনে হচ্ছে, ফ্রন্টের প্রধান দলও তাদের রাজনৈতিক অবস্থান পরিষ্কার করতে না পারায় ফ্রন্টের অবস্থানও পরিষ্কার হচ্ছে না। ফলে মনে হচ্ছে ফ্রন্টের ভবিষ্যৎ খুব বেশি উজ্জ্বল নয়।
ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি- এনডিপি মহাসচিব মো. মঞ্জুর হোসেন ঈসা বলেন, মোটা দাগে বললে বলতে হয়, যে উদ্দেশ্য নিয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠন হয়েছিল বা আমরা ওই ফ্রন্টে যোগ দিয়েছিলাম, তা অকার্যকর হয়ে পড়েছে।
তিনি বলেন, আমরা জোট ছেড়ে যখন এলাম তখন ২০ দল বলতে কিছুই ছিল না। আমরা দেখেছি, বি. চৌধুরীর দল থেকে দুজন নৌকা মার্কায় নির্বাচন করলেন। তারা নির্বাচিতও হলেন। বি. চৌধুরী নৌকায় উঠেছেন। এখন তারা কি সরকারি দল, না বিরোধী দল- তাও পরিষ্কার করতে পারেননি। যুক্তফ্রন্টের অন্য শরিকদের অবস্থান কী, তাও বি. চৌধুরী পরিষ্কার করতে পারেননি। সুতরাং অবস্থাদৃষ্টে দেখা যাচ্ছে, যুক্তফ্রন্টের ভবিষ্যৎ গন্তব্য অনিশ্চিত।
এইউএ/এমএআর/জেআইএম