উৎকোচ বা ঘুষ বা উপঢৌকন যে নামেই বলি না কেন, এই ধরনের বেআইনী লেনদেনের বিষয়টি প্রাচীনকাল থেকেই প্রচলিত। সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের প্রধান পরামর্শদাতা চাণক্য তার ‘অর্থশাস্ত্র’ বইয়ে রাজকর্মচারীদের উৎকোচের বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। আর এখন এই 'ঘুষ' হয়ে গেছে ওপেন সিক্রেট।
Advertisement
রাজনীতি, সমাজনীতি বা অর্থনীতি- যা-ই বলুন না কেন প্রতিটি খাতেই এর ব্যবহার (নেতিবাচক অর্থে) দেখা যায় বা কম-বেশি শোনা যায়। চাকরি বলুন আর পদোন্নতিই বলুন, কিংবা ব্যবসা – প্রতিটি জায়গাতেই উৎকোচ বা ঘুষের ব্যবহার হয় বৈকি! কখনো গোচরে, কখনো অগোচরে-এই হলো তফাৎ। তাই বলে এরকম অনৈতিক প্রথা যুগ যুগ ধরে চলবে, এটা কতটা গ্রহণযোগ্য!
রাজনীতির ক্ষেত্রে নেতা-কর্মীরা সামনের সারিতে আসতে, উপর সারির নেতাদের উপঢৌকন বা ঘুষ দিয়ে থাকেন বলেই শুনেছি। আবার নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পেতে এই ঘুষ বাণিজ্য কারো কারো নামের আগে বসে যায়। অর্থনীতিতেও ঘুষ লেনদেনের তথ্য মেলে। যেকোন ধরনের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান তৈরি থেকে শুরু করে বড় বড় ব্যাংক লোন কিংবা লাইসেন্স প্রাপ্তিসহ বিভিন্ন ধরনের কাজের জন্য উৎকোচ বা ঘুষ দিতে হয়।
এমনকি কোন কাজের জন্য তদবিরেও ঘুষ সংস্কৃতি এখন এ সমাজের নিত্যদিনকার চিত্র। সমাজনীতিও আর পিছিয়ে থাকে কি করে! শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি, শিক্ষক নিয়োগ অথবা সমাজ সেবার কোন অনুমোদন বা অনুদান পেতেও ঘুষের কদর মন্দ নয়। তবে যারা ঘুষ নেন তাদের মুখে শোনা যায় যে, এটা ঘুষ নয়, এ হচ্ছে উপহার। আর এটা বৈধ-অবৈধ'র প্রশ্ন নয়। বিষয়টা হচ্ছে, একটু ভাল থাকতে গেলে এ হাত থেকে ও হাতে টাকার ঘোরাঘুরি। আমি শুধু বলতে পারি সেই পুরোনো সংলাপ- সত্যি সেলুকাস! বিচিত্র এ দেশ!!
Advertisement
অনৈতিক বা অনিয়মের ঘুষ বা উৎকোচ ব্যবস্থাটা অনেক অফিসেই নিয়ম মেনে চলে। যেমন ভূমি অফিসের চিত্রটা একসময় শুনেছি যে, একেবারে পিয়ন থেকে ঊর্ধ্বতন পদ পর্যন্ত একে অন্যকে ঘুষ দিতেন। কারণ বড় কর্তা খুশি হলে অধীনস্তদের এমনিতেই অনেক স্বার্থ হাসিল হয়ে যায়। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক, পুলিশের কনস্টেবল বা কাস্টমসের চাকরি, প্রতিটি খাতে নিয়োগে কী পরিমাণ উৎকোচ দিতে হবে তার সবকিছু পূর্বনির্ধারিত।
আইন অঙ্গনে আরো জটিল অবস্থা। মামলায় হাজিরার জন্য পেশকারকে দিতে হয় টাকা, যদিও তা নামমাত্র, তারপরও ঘুষ তো। বেঞ্চ অফিসারকেও টাকা দিতে হয়। যদিও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বরাবরই ঘুষ বাণিজ্য, দুর্নীতি নির্মূলে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধির ওপর জোর দিয়েছেন এবং কথা অনুযায়ী বেতন-ভাতা কয়েকগুণ বেড়েছেও। তারপরও এই ঘুষ বা উৎকোচ ক্রমেই বাণিজ্যিক হয়ে উঠতে শুরু করলো। সাথে অবশ্য আরো নানা ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতি মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। বিশ্বও জানলো আমাদের এই কুকীর্তি। দুর্নীতিতে কয়েকবার চ্যাম্পিয়নও হলাম আমরা।
এরকম বে-আইনী লেনদেন থেকে বেরিয়ে আসতে ২০০৪ সালের ৯ মে তখনকার সরকার গঠন করলো দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক। গত ১৫ বছরে দেশ থেকে দুর্নীতি প্রতিরোধে অনেক কাজই করেছে এই প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু এখন দেখি দুর্নীতি তাড়ানোর আঁতুড় ঘরেই দুর্নীতির বাস। দুদকের সদস্যদের মধ্যে অনেকেই দুর্নীতি নির্মূল করতে গিয়ে নিজেরাই জড়িয়ে যান দুর্নীতির জালে, তারা বিশ টাকা, একশ’ টাকা নয়, প্রথম দাবিতেই বিশ লাখ, ত্রিশ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন।
দুদক পরিচালক খন্দকার এনামুল বাসির, পুলিশ কর্মকর্তা মিজানের কাছ থেকে ৪০ লাখ টাকা ঘুষ গ্রহণের সাম্প্রতিক খবরে – সর্ষের মধ্যে ভূত- এই প্রবাদটিই মাথায় ঘুরছে। দুদক অবশ্য বাসিরকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে, যদিও তা করা হয়েছে অবৈধভাবে কমিশনের তথ্য পাচার ও শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে। খন্দকার বাসিরের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের কারণে দুদক বিব্রত নন বলে গত সোমবার গণমাধ্যমে জানান দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ।
Advertisement
চেয়ারম্যানের ভাষ্য হলো, একজন কর্মকর্তার দুর্নীতির দায় পুরো কমিশন নেবে না। এটা ঠিক, একজনের দায় পুরো প্রতিষ্ঠান কেন নেবে? তবে এ থেকে উত্তরণের জন্য তো প্রতিষ্ঠান সোচ্চার হবে, এমনটা তো দেশের সাধারণ মানুষ চাইতেই পারি। তবে দুদক কেন, পুলিশ কর্মকর্তা ডিআইজি মিজানও তো একই দোষে দুষ্ট বলা চলে। কারণ ঘুষ দেয়া-নেয়া দু'টোই অপরাধ। আর সে যদি দোষী না-ই হবেন তাহলে একজন সরকারি কর্মকর্তা হয়েও ঘুষ দিতে গেলেন কেন? এসব নানা প্রশ্ন এখন চারপাশে। আর জনমনের এতসব প্রশ্নের জন্য গণমাধ্যমকেই দুষলেন অভিযুক্ত দুদক পরিচালক বাসির। মানেটা কি এমন দাঁড়ায়, আমি যেভাবেই নাচি, তোর কি!
তদন্ত কর্মকর্তার দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। কারণ এরকম ঘটনা অনেক ক্ষেত্রেই আমরা দেখতে পাই। একদম ইউনিয়ন পর্যায়ে যাই, দেখতে পাব সরকারি কোন ত্রাণ সহায়তা নিতে গেলেও ইউপি চেয়ারম্যান তো আছেনই ইউপি সদস্যরাই সাধারণের সাথে দুর্নীতি করেন। এর পরবর্তী প্রতিটি ধাপেই প্রশাসনিক দুর্নীতি আছে। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে কম-বেশি দুর্নীতির নজির আমাদের সমাজে প্রায়শ:ই দৃশ্যমান।
তবে দুদক পরিচালকের বিরুদ্ধে উঠা এই অভিযোগের প্রেক্ষিতে, আবারও জনমনে প্রশ্ন উঠেছে, দুর্নীতি দমনের জন্য যার জন্ম সেই দুদক কি নিজেই দুর্নীতি লালন করছে? কেননা পুরোনো ইতিহাস খতিয়ে দেখলে দেখা যাবে, জন্ম থেকেই এই দুদক বিতর্ক এড়াতে পারেনি। কাউকে কাউকে দুর্নীতিতে জড়ানোর ভয় দেখিয়ে বিশাল অংকের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তাদের অনেক সদস্য, আবার কাউকে কাউকে ক্লিন ইমেজের সার্টিফিকেটও দিয়েছে।
প্রশ্ন হলো, দেশে কি সৎ, চরিত্রবান লোকের এতোই অভাব? দেশপ্রেমিক লোক কি একজনই পাচ্ছেন না আমাদের দুদক চেয়ারম্যান। তবে অভিযুক্তদের প্রসঙ্গে আমি বলছি না যে, তাদের দেশপ্রেম নেই। হয়তো লোভ সম্বরণ করলেই তারা সত্যিকারের দেশপ্রেমিক হতে পারেন। পারেন আদর্শিক মানুষ হয়ে দায়িত্বকালীন নেয়া শপথ বাক্যগুলো সত্য করতে। আর কি, থাকতে হবে এই প্রত্যাশাতেই- দুর্নীতি দমন কমিশন দুর্নীতি দমন নয়, প্রতিরোধ করবেই এবং রাষ্ট্রের প্রশাসনযন্ত্রগুলো সততা আর দেশপ্রেমের নিখাদ ভালবাসায় মোড়া নিষ্ঠাবান প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হবে।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, বাংলাভিশন।
এইচআর/এমএস