দেশব্যাপী আলোচিত মৌলভীবাজারের বড়লেখায় পরিবহন শ্রমিকদের ডাকা ৪৮ ঘণ্টার ধর্মঘট চলাকালে অ্যাম্বুলেন্স আটকে রাখায় সাতদিন বয়সী শিশুর মৃত্যুর ঘটনায় অভিযোগপত্র অনেকটা গোপনে আদালতে দাখিল করেছে পুলিশ। গত ৩০ এপ্রিল বড়লেখার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম হরিদাস কুমারের আদালতে ১৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করলেও তা জানেন না মামলার বাদী।
Advertisement
অভিযোগপত্রভুক্ত আসামিরা হলেন- শ্রমিক দেলোয়ার হোসেন (৩৪), মো. আলী হোসেন (৩৮), নিজাম উদ্দিন (৩৫), কয়েছ আহমদ (২৮), আলীম উদ্দিন (৪৮), মো. জাকির হোসেন রাজন (২৪), রয়নুল ইসলাম (২৭), জসিম (৩০), হেলাল উদ্দিন (২৮), ফজল আলী (২৫), শামীম (৩৫), শরফ উদ্দিন (৩৫) ও জুয়েল দাস (২০)। তাদের সবার বাড়ি বড়লেখা উপজেলায় বলে পুলিশ জানিয়েছে।
এদিকে আলোচিত এই ঘটনায় মামলার চার্জশিট গোপনে দাখিল করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন নিহত শিশুর চাচা মামলার বাদী আকবর আলী।
মঙ্গলবার বিকেলে তিনি বলেন, আদালতে চার্জশিট দাখিলের বিষয়টি আমার জানা নাই। পুলিশ আমাকে বলেনি। এমনকি আমার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করেনি। চার্জশিট কিভাবে দিয়েছে তাও জানি না। লোকমুখে শুনেছি চার্জশিট দেয়া হয়েছে। চার্জশিটে যাদের আসামি করা হয়েছে তাদের পরিবারের লোকজন আমার বাড়িতে এসে কান্নাকাটি করছেন। তখন আমি চার্জশিটের বিষয়টি জেনেছি। মামলায় একটা স্বাক্ষর আছে আমার। আমাকে জানানো দরকার ছিল।
Advertisement
এ ব্যাপারে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বড়লেখা থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) মো. জসীম বলেন, এজাহারে কারো নাম ছিল না। অজ্ঞাতনামা আসামি ছিল। মামলার তদন্তকালে ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়ায় ৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তদন্তে ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়ে সাক্ষ্য ও প্রমাণ পাওয়ায় ১৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয়া হয়েছে।
অভিযোগপত্র দাখিলের বিষয়টি মামলার বাদী জানেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তদন্তের ফলাফল ও অভিযোগপত্র দাখিলের বিষয়টি বাদীকে জানানো হয়েছে।
থানা-পুলিশ ও নিহত শিশুর পরিবার সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ২৮ অক্টোবর উপজেলার সদর ইউনিয়নের অজমির গ্রামের কুটন মিয়ার মেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়লে সকালের দিকে বড়লেখা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হয়। হাসপাতালের চিকিৎসক উন্নত চিকিৎসার জন্য শিশুটিকে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলেন। শিশুর অভিভাবকরা অ্যাম্বুলেন্সে করে সকাল ১০টার দিকে শিশুটিকে নিয়ে সিলেটের উদ্দেশ্যে রওনা হন। যাওয়ার পথে বড়লেখা উপজেলার পুরাতন বড়লেখা বাজার, দাসের বাজারসহ বিভিন্ন স্থানে অ্যাম্বুলেন্সটি পরিবহন শ্রমিকদের বাধার মুখে পড়ে। অ্যাম্বুলেন্সটি চান্দগ্রাম নামক স্থানে গেলে পরিবহন শ্রমিকরা গাড়ি আটকে চালককে মারধর করেন। প্রায় দেড়ঘণ্টা সেখানে অ্যাম্বুলেন্সটি আটকা থাকে। অ্যাম্বুলেন্স আটকা অবস্থায় শিশুটি মারা যায়। দুপুর দেড়টার দিকে গাড়ি ছাড়া পেলে শিশুটিকে পাশের সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
নির্মম এ ঘটনার সংবাদ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে সারাদেশে শুরু হয় তোলপাড়। ঝড় ওঠে নিন্দার। ঘটনার সঙ্গে জড়িত পরিবহন শ্রমিকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালিত হয়।
Advertisement
এই ঘটনার তিনদিন পর ৩১ অক্টোবর শিশুর চাচা আকবর আলী বাদী হয়ে অজ্ঞাত পরিচয়ে ১৬০ থেকে ১৭০ জন শ্রমিককে আসামি করে থানায় মামলা (নং-১৮) করেন। শিশুটির মৃত্যুর ঘটনায় তার পরিবারকে ৫০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ কেন দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট। জনস্বার্থে দায়ের করা এক রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে গত বছরের ০৩ ডিসেম্বর বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের হাইকোর্ট বেঞ্চ রুলসহ এ আদেশ দেন। এরপর চলতি বছরের ১০ জানুয়ারির মধ্যে পুলিশের মহাপরিদর্শককে (আইজিপি) ওই শিশুর মৃত্যুর ঘটনায় মেডিকেল সার্টিফিকেটসহ প্রয়োজনীয় তথ্য আদালতে প্রতিবেদন আকারে দাখিল করারও জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন।
পরবর্তীতে তদন্ত কর্মকর্তার আবেদনের প্রেক্ষিতে গত বছরের ৬ ডিসেম্বর সাতদিন বয়সী কন্যাশিশুর মৃত্যুর অন্তত ৩৮ দিন পর ময়নাতদন্তের জন্য কবর থেকে লাশ উত্তোলন করা হয়। এ সময় বড়লেখা উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী হাকিম শরীফ উদ্দিন উপস্থিত ছিলেন। সুরতহাল প্রতিবেদন প্রস্তুত শেষে ময়নাতদন্তের জন্য লাশ মৌলভীবাজার ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট সদর হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়েছিল। ময়নাতদন্ত শেষে লাশ পুনরায় দাফন করা হয়।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা বড়লেখা থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) মো. জসীম সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে শিশুটির লাশের সুরতহাল প্রতিবেদন প্রস্তুত ও ময়নাতদন্তের জন্য গত ৫ নভেম্বর বড়লেখার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম হরিদাস কুমারের আদালতে আবেদন করেন।
রিপন দে/এফএ/জেআইএম