ড. রফিকুল ইসলাম
Advertisement
ভাষা সভ্যতার পূর্বশর্ত। মানুষের মধ্যে যতোদিন ভাষার উদ্ভব না হয়েছে, ততোদিন সভ্যতার যাত্রা শুরু হয়নি। মানুষ যখন ভাষার সাহায্যে অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎকে নির্দেশ ও সম্পর্কিত করতে পেরেছে, তখন থেকেই সভ্যতার শুরু। মানুষ লিখতে শিখেছে পাঁচ-ছয় হাজার বছর আগে; কিন্তু বলতে শিখেছে অন্তত ষাট হাজার বছর আগে। এ সময়ের মধ্যে পৃথিবীতে বহু ভাষার উদ্ভব হয়েছে, আবার তা বিলীন হয়ে গেছে, যেমন অনেক সভ্যতার উত্থান ও পতন ঘটেছে।
উদাহরণস্বরূপ উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের অনেক বড় বড় সভ্যতা ও অসংখ্য ভাষা বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার ইতিহাস স্মরণীয়। একসময় উত্তর-দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকায় অসংখ্য ‘রেড ইন্ডিয়ান’ ভাষা প্রচলিত ছিল। কয়েকশ’ বছর আগে ইউরোপীয় দেশের উপনিবেশে পরিণত হওয়ার ফলে সেসব ভাষা ধ্বংস হয়ে গেছে। উত্তর আমেরিকায় চালু হয়েছে ইংরেজি আর দক্ষিণ আমেরিকায় স্প্যানিশ ও পর্তুগিজ ভাষা।
ভারতীয় উপমহাদেশে আর্যদের আগমনের আগে বিভিন্ন অনার্য ভাষা প্রচলিত ছিল; কিন্তু আর্যদের আগমনের পর দক্ষিণ ভারত ছাড়া ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চলে আর্য ভাষার প্রচলন এবং অনার্য ভাষাগুলো বিলুপ্ত হয়ে যায়। দক্ষিণ এশিয়ার পূর্বাঞ্চলে বর্তমানে বাংলা ভাষা এলাকায় প্রধানত তিনটি অনার্য শাখার ভাষা প্রচলিত ছিল ‘অস্ট্রিক’ বা ‘মুন্ডা’, ‘তিব্বতি-বার্মিজ’ এবং দ্রাবিড় গোষ্ঠীর ভাষা ‘ওঁরাও’।
Advertisement
সপ্তম থেকে দশম শতকের মধ্যে বর্তমান বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলগুলোয় আর্য ভাষা, সংস্কৃতি ও ধর্মের প্রবেশ ঘটে। তেরো শতকে তুর্কি বিজয়ের সময় থেকে এ অঞ্চলে আসতে থাকে মধ্য এশিয়া থেকে তুর্কি, মোগল, পাঠান, পার্সি ও আরবরা এবং তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি। সতেরো শতক থেকে শুরু হয় ইউরোপীয় বণিক, ধর্মযাজক, জলদস্যু, দখলদার এবং তাদের ভাষা, সংস্কৃতি ও ধর্ম।
বাংলা একটি আর্য ভাষা, যার বয়স অন্তত হাজার বছর। বাংলা ভাষা বর্তমানে বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা রাজ্য, আসামের শিলচর, করিমগঞ্জ, গোয়ালপাড়া এবং বিহার, উড়িষ্যা ও ঝাড়খণ্ডের পশ্চিমবঙ্গ সীমান্তবর্তী অঞ্চলে প্রচলিত। এর মধ্যে বাংলাদেশের বাইরে ভারতের যেসব অঞ্চলে বাংলাভাষা প্রচলিত সেসব অঞ্চলে তা হিন্দি বা স্থানীয় অন্যান্য ভাষার চাপে কোণঠাসা।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা বাংলা ভাষা আন্দোলন থেকে, ফলে ১৯৭২ সাল থেকে বাংলা ভাষা বাংলাদেশ প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা। এর আগে প্রায় হাজার বছর বাংলা ভাষা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পায়নি, কারণ অবিভক্ত বাংলা শাসিত হয়ে এসেছে হিন্দু-বৌদ্ধ আমলে সংস্কৃত বা প্রাকৃত ভাষায়। মধ্যযুগে মুসলিম আমলে তুর্কি বা পাঠান বা মোগল আমলে পাঁচশ’ বছর ‘সুরা বাংলা’ শাসিত হয়েছে ফার্সি ভাষার মাধ্যমে। আধুনিক যুগে ইংরেজ আমলে অখণ্ড বাংলা তথা ভারতবর্ষের রাজভাষা ছিল ইংরেজি। পাকিস্তান আমলে উর্দু ভাষা চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা ব্যর্থ হলে কার্যত ইংরেজিই রাষ্ট্রভাষা থেকে যায়।
বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর বছর পাঁচেক রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক জীবনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বাংলা ভাষা প্রচলিত হয়েছিল। এ সময় বাংলা ভাষা, প্রশাসন, শিক্ষার মাধ্যম, নিম্ন আদালত প্রভৃতি ক্ষেত্রে দ্রুত চালু হতে থাকে। মোটকথা সত্তর দশকের প্রথমার্ধে বাংলাদেশে সমাজ জীবনের বিভিন্ন স্তরে প্রাপ্য মর্যাদা পেয়েছিল বাংলা ভাষা। কিন্তু এই প্রবণতা রোধ হতে সময় লাগেনি। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ভাষার ভাগ্য পরিবর্তিত হতে থাকে।
Advertisement
বাংলা এমনই এক বিচিত্র দেশের ভাষা যে, পঁচাত্তরের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ‘বাংলাদেশ বেতার’ হয়ে যায় ‘রেডিও বাংলাদেশ’ আর ‘জয় বাংলা’ হয় ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’। এ সময় বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত, জাতীয় পতাকা, এমনকি রাষ্ট্রভাষা পরিবর্তনের অবিশ্বাস্য দাবিও তুলেছিল মৌলবাদীরা। ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ রাষ্ট্রকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র বাংলাদেশ নামে অভিহিত করে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলি ভুট্টো ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট বাংলাদেশকে নতুনভাবে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। সৌভাগ্যবশত ’৭১-এর পরাজিত শত্রুদের ওইসব প্রয়াস সফল হয়নি।
তবে জাতীয় জীবনে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনের ক্ষেত্রে ব্যর্থতার জন্য মূলত বাংলাদেশের শিক্ষিত সম্প্রদায়ই দায়ী। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় তিনটি শিক্ষার মাধ্যমে প্রচলিত হওয়ার জন্য দায়ী সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে শিক্ষাবিদরা। উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষা চালু না হওয়ার জন্য দায়ী ওই আদালতের আইনজীবীরা এবং সরকারের আইন মন্ত্রণালয়। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের সব রাস্তাঘাট, দোকানপাট এবং স্থাপনার নাম বাংলা ভাষায় রূপান্তরিত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আমাদের হীনম্মন্যতার কারণে বর্তমানে তা আবার ইংরেজি ভাষায় পরিবর্তিত।
অনেক ক্ষেত্রে বাংলা নামফলক রোমান হরফে লিখিত। ইংরেজ আমল থেকে আমাদের সামাজিক অনুষ্ঠানাদি যেমন- বিয়ে, জন্মদিন, পুনর্মিলনী ও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণপত্র বাংলা ভাষাতেই রচিত হতো। কিন্তু বর্তমানে তথাকথিত শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত দ্বারা তা ভুলভাল ইংরেজিতে রচিত হচ্ছে। এর দ্বারা প্রমাণিত হচ্ছে, আমাদের তথাকথিত শিক্ষিত সমাজে আত্মমর্যাদাবোধ বলতে কিছু নেই। অন্যথায় এ সমাজে বিয়ে, গায়ে হলুদ বা এমনকি ‘আকিকা’ উৎসবের আমন্ত্রণপত্র বিদেশি ভাষায় প্রচারিত হতো না।
বাংলা ভাষার অপপ্রয়োগ সবচেয়ে প্রকট শিক্ষা ক্ষেত্রে। পৃথিবীর সব ভাষারই আঞ্চলিক বা উপভাষা এবং প্রমিত উভয় রূপই থাকে। আঞ্চলিক ভাষা, ঘরের ভাষা, বাজারের ভাষা; সে ভাষার প্রমিত রূপ সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং শিক্ষার ভাষা। ইংরেজি ভাষা ইংল্যান্ড, আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের ভাষা। ওইসব দেশে ইংরেজি ভাষার বহু উপভাষা এবং প্রতিটি দেশে নিজস্ব প্রমিত রূপ রয়েছে। ওইসব দেশে শিক্ষায়তনগুলোতে ইংরেজি ভাষার কোনো না কোনো প্রমিত রূপ ব্যবহার করা হয়।
লন্ডনের স্কুলে ‘ককনি’ বা নিউইয়র্ক স্কুলে ‘ইয়াংকি’ উপভাষায় কখনো পাঠদান করা হয় না। কিন্তু বাংলাদেশে বিভিন্ন অঞ্চলে অবস্থিত শিক্ষায়তনগুলোতে স্থানীয় আঞ্চলিক ভাষায় শিক্ষাদান করা হয়। অথচ ইংরেজ আমলে অবিভক্ত বাংলায় কোনো স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে শ্রেণীকক্ষে আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহৃত হতো না। স্কুলে নিয়মিত পঠন-পাঠনের মাধ্যমে প্রমিত ভাষা, উচ্চারণ ও বাচনভঙ্গি শিক্ষাদান করা হতো। শিক্ষার্থীরা শ্রেণীকক্ষে আনুষ্ঠানিক পরিবেশে প্রমিত ভাষা ব্যবহারের অভ্যাস করতো। বর্তমানে শ্রেণীকক্ষে শুধু বিভিন্ন বিষয় নয়, বাংলা ও ইংরেজি ভাষাও আঞ্চলিক ভাষায় পড়ানো হয়। ফলে ১২ বছর চেষ্টা করেও তাদের কোনো ভাষা সঠিকভাবে শেখানো যায় না। বাংলাদেশের অধিকাংশ শিক্ষকের উচ্চারণ আঞ্চলিকতা দোষে দুষ্ট।
বাংলাদেশের মূলধারা শিক্ষাব্যবস্থায়, অর্থাৎ বাংলার মাধ্যমে পরিচালিত প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত বাংলা ও ইংরেজি ভাষা পড়ানো হয়। কিন্তু খুব কম ছাত্রছাত্রী এ দুটি ভাষা ঠিকমতো শিখতে পারে, ফলে কলেজজীবনের শেষে তারা ইংরেজি ও বাংলা কোনো না কোনো আঞ্চলিক রূপের মিশ্রণে এক খিচুড়ি ভাষায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় যখন তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করে তখন তারা জ্ঞান-বিজ্ঞানে কোনো বিষয় যথার্থভাবে আয়ত্ত করতে পারে না।
বর্তমানে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার মূল সমস্যা শিক্ষার্থীদের ভাষাজ্ঞানের অভাব। ইংরেজি মাধ্যমে পরিচালিত স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পাঠ্য তালিকায় বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি উপেক্ষিত। বাংলাদেশের ইতিহাস ভ‚গোল-ঐতিহ্য সেখানে অনুপস্থিত, ফলে এক উৎকেন্দ্রিক প্রজন্মের সৃষ্টি হচ্ছে। বাংলাদেশের শিক্ষার তৃতীয় ধারা মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা। এ ক্ষেত্রে বাংলা, ইংরেজি বা আরবি ভাষা অথবা আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান কিছুই যথার্থভাবে শেখানো হয় না।
বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থায় বর্তমানে উচ্চবিত্তদের জন্য ইংরেজি মাধ্যম, মধ্যবিত্তদের জন্য বাংলা মাধ্যম আর নিম্নবিত্তদের জন্য মাদ্রাসা মাধ্যম প্রচলিত। কিন্তু ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীরা ইংরেজি, বাংলা মাধ্যমের শিক্ষার্থীরা বাংলা ও মাদ্রাসা মাধ্যমের শিক্ষার্থীরা আরবি ভাষা পর্যন্ত ঠিকমতো শিখতে পারছে না। ফলে বাংলাদেশের ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে এক অচল অবস্থায় সৃষ্টি হয়েছে।
বাংলাদেশে ভাষার বিকৃতি সবচেয়ে বেশি হচ্ছে টেলিভিশনে। এই মাধ্যমে প্রচারিত ‘সিরিয়াল’গুলোয় ব্যবহৃত ভাষা প্রায়ই না প্রমিত, না কোনো অঞ্চলের নির্দিষ্ট উপভাষা। এসব সিরিয়ালের রচয়িতা ও তাদের ‘ভাই-বেরাদররা’ যে খিচুড়ি ভাষা ব্যবহার করেন, তা দর্শকের বোধগম্য নয়। এসব সিরিয়ালগুলোর মাধ্যমে বাংলা ভাষার বিকৃতি সবচেয়ে বেশি হচ্ছে। বাংলা সাহিত্যের নাটক ও প্রহসনের সংলাপে বিশেষ অঞ্চলের উপভাষার ব্যবহার প্রচলিত রীতি, কিন্তু সমগ্র নাটক মিশ্র আঞ্চলিক বা খিচুড়ি ভাষায় রচিত হয়নি।
উল্লেখ্য, যে বাংলা সাহিত্যে মধ্যযুগে বিভিন্ন অঞ্চলে যেসব সাহিত্য রচিত এবং হস্তলিপিতে উৎকীর্ণ, সেসব পুঁথি সাধুভাষায় রচিত। আঞ্চলিক ভাষায় রচিত পুঁথির সংখ্যা নেই বললেই চলে। অথচ একুশ শতকে আধুনিক মাধ্যমে সবচেয়ে বহুল প্রচলিত সিরিয়ালগুলোতে এক অদ্ভুত ভাষা ব্যবহৃত হচ্ছে, যা সমগ্র বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলে বোধগম্য নয়। ভাষা ব্যবহারের এ নৈরাজ্য আমাদের মেধা ও মননকে প্রভাবিত করছে এবং শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি ক্ষেত্রে সৃজনশীল প্রতিভার বিকাশ ঘটছে না।
সম্প্রতি ইউনেস্কোর এক জরিপে বলা হয়েছে, একুশ শতকের শেষ অবধি বর্তমান বিশ্বে প্রচলিত ভাষাগুলোর শতকরা চল্লিশ ভাগ বিলুপ্ত হয়ে যাবে। পৃথিবীতে কেবল ইংরেজি, চীনা ও স্প্যানিশ ভাষার মতো সংখ্যাধিক্য মানুষের ভাষা টিকে থাকবে। একুশ শতকে বিশ্বায়ন, মুক্তবাজার অর্থনীতি, আকাশ-সংস্কৃতি এবং অবাধ তথ্যপ্রবাহের ফলে তৃতীয় বিশ্বের অধিকাংশ ভাষা হুমকির সম্মুখীন। তৃতীয় বিশ্বের সেসব ভাষাই টিকে থাকবে যেসব ভাষার ব্যবহারকারীরা তাদের মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধাশীল, রক্ষণশীল এবং যত্নশীল। নিজেদের ভাষার প্রতি যেসব জাতির শ্রদ্ধা নেই উপরন্তু হীনম্মন্যতা এবং অকারণে বিদেশি ভাষা ব্যবহার ও মিশ্রণের প্রবণতা রয়েছে, তাদের ভাষা টিকে থাকা দুষ্কর। এসব ভাষা একুশ শতকের মধ্যেই উপভাষায় পরিণত হয়ে পরে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। বাংলা ভাষায় রয়েছে হাজার বছরের সাহিত্য ও ঐতিহ্য।
সুদীর্ঘ পরাধীনতা যা ধ্বংস করতে পারেনি। কিন্তু স্বাধীনতার চার দশকের মধ্যেই বাংলাদেশের মাতৃভাষার প্রতি অশ্রদ্ধা, অবজ্ঞা, উপেক্ষা এবং নৈরাজ্য এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে, বাংলা ভাষার লালিত্য, মাধুর্য ও সৌন্দর্য প্রায় বিলুপ্ত হতে বসেছে। বাংলা ভাষার আধুনিক, নাগরিক ও প্রমিত রূপ আজ অজ্ঞাত, ফলে মৌলিক সৃষ্টির সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। যা পাওয়া যাচ্ছে তা স্থূল বা নন্দনতাত্ত্বিক সুষমাবর্জিত।
বাংলাদেশে বাংলা ভাষার ব্যবহারে যে প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে তাতে মনে হয় না যে, পৃথিবীর চতুর্থ বৃহত্তম ভাষা বা ত্রিশ কোটি বাঙালির মাতৃভাষা এ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারবে। যখন বাংলাদেশের কোনো রাজনীতিক অর্ধেক বাংলা ও অর্ধেক ইংরেজিতে প্রচার মাধ্যমে কথা বলেন বা একজন বাংলা গানের শিল্পী তার উচ্চাঙ্গসংগীত পারদর্শিতা বোঝাতে ইঙ্গবঙ্গ মিশ্র ভাষায় টিভিতে সাক্ষাৎকার দেন বা একটি সংগীতশিল্পী প্রতিষ্ঠান ইংরেজি ভাষায় আমন্ত্রণলিপি প্রেরণ করে, তখন বোঝা যায় বাংলা ভাষার প্রতি আমরা কতোটা শ্রদ্ধাশীল!
বস্তুত যিনি মাতৃভাষা ও বিদেশি ভাষা দুটিই ভালো জানেন তার কখনো দুটি ভাষার মিশ্রণ ঘটানো উচিত নয়। অথচ আমরা অহরহ ইংরেজি, প্রমিত ও আঞ্চলিক ভাষার মিশ্রণ, এমনকি কোনো বাংলা নাটকে হিন্দি গানও ব্যবহার করতে দেখি। বর্তমান বাংলাদেশে ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে যে নৈরাজ্য ও বিকৃতি চলছে, এর গতিরোধ করতে না পারলে বাংলা ভাষা অবক্ষয়ের মধ্য দিয়ে অবলুপ্তির পথে চলে যাবে।
বিশ শতকে বাঙালি ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছে, বাংলা বর্ণমালা রক্ষার জন্য সংগ্রাম করেছে, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছে, একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসরূপে স্বীকৃতি পেয়েছে; কিন্তু একুশ শতকে এসে বাঙালি তার ওইসব মহৎ অর্জনগুলো বর্জন করে তার মাতৃভাষা বাংলা ভাষাকে বিস্মৃতির অতলে ঠেলে দিচ্ছে। বাঙালির মাতৃভাষা বর্জন তার সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি। কারণ পরিণতিতে তার জাতিসত্তা ও জাতিরাষ্ট্র বিপন্ন হবে। বাঙালি জাতির অস্তিত্ব থাকবে না।
এইচআর/পিআর