হঠাৎ করেই গর্জে উঠলো বেশ কিছু অটোমেটিক রাইফেল। কাবুলজুড়ে সেই রাইফেলের আওয়াজ ভেসে বেড়ালো বেশ কিছুক্ষণ। কাবুলবাসী দরজা-জানালা বন্ধ করে দিয়ে ঘরে বসে প্রমাদ গুণতে থাকলো। এই বুঝি আরও একটি আত্মঘাতী বোমা আমলার খবর আসবে তাদের কাছে। এই বুঝি রাস্তায় শোনা যাবে অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেনের শোঁ-শোঁ আওয়াজ। রক্তাক্ত-আহত মানুষের রোনাজারিতে আবারও ভারি হয়ে উঠবে কাবুলের আকাশ বাতাস।
Advertisement
কিন্তু না, এসবের কিছুই হলো না। অটোমেটিক রাইফেলের বুলেট আকাশে উঠে ধোঁয়ার কুন্ডলিই তৈরি করলো শুধু। এরপর হারিয়ে গেলো অজানার উদ্দেশ্যে। পরক্ষণেই কাবুলের মানুষ বুঝতে পারলো, এ তো বিজয়ের আনন্দ! ইংল্যান্ডে পাকিস্তানের বিপক্ষে আফগানদের ঐতিহাসিক এক ক্রিকেট বিজয়ের আনন্দই কেউ কেউ প্রকাশ করেছে অটোমেটি রাইফেলের গান ফায়ারের মাধ্যমে। গত সপ্তাহের ঘটনা এটি।
যদিও ম্যাচটির কোনো আন্তর্জাতিক মর্যাদা ছিল না। বিশ্বকাপের আগে প্রস্তুতি ম্যাচে আফগানদের মুখোমুখি হয়ে ৩ উইকেটে হেরেছে পাকিস্তান। ক্রিকেটের অন্যতম পরাশক্তি পাকিস্তানকে হারানোর আনন্দই কাবুলে এমন উল্লাস আর উম্মাদনা তৈরি করেছে।
যে দেশে এখনও প্রতিদিন কেথাও না কোথাও আত্মঘাতী বোমা হামলায় প্রাণ যাচ্ছে অসংখ্য মানুষের। যে দেশের মানুষের এখনও ভোরবেলায় আজানের শব্দের সঙ্গে ঘুম ভাঙে বুলেটের আওয়াজ শুনে, সেখানে পিস্তল, শটগান কিংবা একে-৪৭ দিয়ে রাতের আকাশের নিস্তব্ধতা খানখান করে ক্রিকেটের বিজয় উদযাপন হবে, সেটাই তো স্বাভাবিক।
Advertisement
ক্রিকেটের এমনই এক সম্মোহনী ক্ষমতা! নানা জাতি আর গোত্রে বিভক্ত, যুদ্ধ বিদ্ধস্ত দেশ আফগানিস্তানকে এক সুতোয় এনে বেঁধে দিচ্ছে। যুদ্ধ বিদ্ধস্ত দেশটিতে শান্তির সুবাতাস বইয়ে দিচ্ছে ক্রিকেট। বিশ্বকাপের মঞ্চে যদি একটু ভালো করে বসতে পারে গুলবাদিন নাইবের দল, তাহলে নিশ্চিত আগামী দিনে অন্য এক আফগানিস্তানকে দেখতে পাবে সারা বিশ্ব। সে শুধুমাত্র ক্রিকেটের কারণেই।
হাঁটি হাঁটি পা পা করে আজ বিশ্ব ক্রিকেটে এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে গেছে আফগানিস্তান। কেউ হয়ত ভাবেনি যে, যুদ্ধবিদ্ধস্ত একটি দেশ আজ পরপর দুইবার ওয়ানডে বিশ্বকাপে খেলতে নামবে। আজ ক্রিকেটের এতো বড় আসরে খেললেও দেশটির কোন এক জায়গায় এখনো শোনা যাবে গুলি কিংবা বন্দুকের আওয়াজ; কিন্তু প্রিয় দেশকে সমর্থন করতে কোন বাধাই আটাকাতে পারবে না আর আফগানিস্তানের মানুষদের।
দেশের যুদ্ধকে থামাতে ক্রিকেটকেই শান্তির প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছে আফগানরা। রশিদ খান-মোহাম্মদ নবিরা এখন সবার কাছে আইডলের নাম। তাদের দেখে দেখে এখন ক্রিকেটের প্রতি ঝুঁকছে দেশটির শিশু-কিশোররা। এবারের ইংল্যান্ড বিশ্বকাপে তাই আশায় বুক বাধছেন আফগানিস্তানের প্রতিটি মানুষ।
আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা এএফপিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এক আফগানি যুবক বলেন, ‘যদি আফগানিস্তান বিশ্বকাপে ভালো খেলে, তাহলে এটা পুরো জাতির জন্যই গর্বের বিষয় হবে।’ আরেক যুবক বলেন, ‘ক্রিকেটে আফগানিস্তান এখন অনেক ভালো দল। পুরো জাতীয় দল আমার জন্য একটা প্রেরণা। ক্রিকেট সমাজের কাছে শান্তি, ভালোবাসা, আনন্দ এবং একতার বার্তা নিয়ে আসে।’
Advertisement
জঙ্গি হামলা ও অর্থনৈতিক কারণে পাকিস্তানকে নিজেদের প্রধান শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে আফগানরা। তাই বিশ্বকাপ প্রস্তুতি ম্যাচে তাদেরকে ৩ উইকেটে হারানোর পর উল্লাসে ফেটে পড়ে দেশটির ক্রিকেট ভক্ত মানুষ।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে নাজির নাসেরি নামে এক ব্যক্তি লেখেন, ‘এক নম্বর শত্রুকে হারানোটা আফগানদের কাছে আনন্দের থেকেও বেশি কিছু। বিশেষ করে আমাদের হিরোদের জন্য। অবশেষে অপেক্ষার পালা শেষ হলো, পাকিস্তানকে হারিয়ে দিয়েছি আমরা।’
চলছে রমজান মাস। আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় রোজা রাখছেন সকল মুসলিম ধর্মালম্বী। ব্যতিক্রম নয় আফগান ক্রিকেটাররাও। তবে রোজা রেখেও বিশ্বকাপের জন্য কঠোর অনুশীলন করে যাচ্ছেন রশিদ-নবিরা। এ সম্পর্কে আফগান ক্রিকেট বোর্ডের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আফগান খেলোয়াড়রা রোজা রেখেও কঠোর অনুশীলন করে যাচ্ছে। সে সঙ্গে প্রার্থনা ও ধর্মের প্রতি ভক্তিও চালিয়ে যাচ্ছে তারা।’
বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করা প্রতিটি দলেরই স্বপ্ন থাকে শিরোপা জেতার। ব্যতিক্রম নয় আফগানরাও। অনভিজ্ঞ দল হলেও বিশ্বকাপের ট্রফি জিততে ইচ্ছুক দেশটির ক্রিকেট পাগল মানুষরা। সে ভালোবাসা থেকেই পাথর দিয়ে বিশ্বকাপ ট্রফির মতো একটি রেপ্লিকা ট্রফি বানিয়ে ফেলেন আফগানিস্তানের আমানুল্লাহ কালিওয়াল।
তিনি বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই আমি ক্রিকেটকে ভালোবাসি এবং আমি এই খেলার বড় ভক্ত। ভবিষ্যতে জাতীয় দলকে কিছু একটা উপহার দেয়ার জন্য আমি কিছু একটা বানাতে চেয়েছিলাম। তাই আমি এই ট্রফিটা বানিয়েছি। আমরা আশাবাদী, আল্লাহ চাইলে আমরা বিশ্বকাপ জিততেও পারি।’
অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে আজই নিজেদের বিশ্বকাপ মিশন শুরু করবে আফগানিস্তান।
এএইচএস/আইএইচএস/জেআইএম