‘বিশ্বের দর্শনার্থীদের জন্য অন্যতম জায়গা হচ্ছে ওমানের সবথেকে বড় মসজিদ ‘সুলতান কাবুস গ্র্যান্ড।’ মসজিদটিতে রয়েছে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম কার্পেট ও বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ঝাড়বাতি।
Advertisement
একটা সময় বিশ্বের সবচেয়ে বড় কার্পেট আর ঝাড়বাতির ছিল ওমানের এই প্রধান মসজিদটির অধিকারে। নামও ওঠে আসে গিনেস বুকে। ২০০৭ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউইএ) আবুধাবির শেখ জায়েদ মসজিদের চেয়ে বড় কার্পেট এবং ২০১০ সালে কাতারের দোহায় আল হাতমি ভবনের লবীতে বড় ঝাড়বাতির বসানোর পর সেই কৃতিত্ব তাদের হাতছাড়া হয়ে যায়।
মসজিদটির আধুনিক ইসলামী স্থাপত্যের গৌরবময় নিদর্শন দেখে যে কেউই মুগ্ধ হবেন। সুলতান কাবুস বিন সাইদ আল সাইদ। ওমানের বর্তমান শাসক। শাসন করছেন প্রায় ৪৯ বছর ধরে। মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে দীর্ঘ সময়ের রাষ্ট্রপ্রধান। স্বদেশি এবং প্রবাসীদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয়। রাজত্বের ৩০তম বছরে জাতিকে তিনি উপহার দেন এই মসজিদ। রাজধানী মাস্কাটের বউশার এলাকার ৪ লাখ ১৬ হাজার বর্গমিটার জমির ওপর বানানো মসজিদটি ২০০১ সালে উদ্বোধন করা হয়।
পবিত্র রমজান মাস উপলক্ষে এই মসজিদে প্রতিদিন হাজারও রোজাদারের ইফতারের ব্যবস্থা করা হয়, মাস্কাটের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নাগরিকরা আসেন এখানে ইফতার করতে।
Advertisement
সুন্দর স্থাপত্যশৈলীর জন্য মসজিদটি এখন ওমানের প্রধান পযর্টন আকর্ষণও বটে। বছরজুড়ে ভিড় থাকে বিশ্ব পর্যটকদের। এটি ওমানের একমাত্র মসজিদ যেখানে অমুসলিমরাও যেতে পারেন। স্থাপত্যশৈলী নিয়ে স্থানীয় ওমানিরা জানান, চতুর্ভুজ আকৃতির এই মসজিদ ওমানের এবাদি মুসলিম সমাজ ব্যবস্থার প্রতীক স্বরূপ।
দুইটি করিডোর দিয়ে সংযুক্ত তিনটি পৃথক হল। একই সঙ্গে বেলে পাথর, মার্বেল পাথর ও স্টেইনড গ্লাসের সমন্বয়ে গড়া নকশার পরতে পরতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে- সাগর আর মরুভূমির মিশেলে গড়ে ওঠা আবহমান মরু-জীবন, যা সত্যিই অনন্য।
ইতিহাস বলছে, ১৯৯২ সালে সুলতান কাবুস মসজিদটি বানানোর সিদ্ধান্ত নেন। পরের বছর প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নির্বাচন করা নকশা। অংশ নিয়েছিলেন দেশি-বিদেশি নামকরা নকশাবিদরা। ১৯৯৫ সালে শুরু হয় নির্মাণ কাজ। দায়িত্ব পায় বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান কার্লিয়ন আলাওই। মাস্কাট আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, জাতীয় যাদুঘর, মজলিশ, রয়েল ওপেরা হাউজের মতো ওমানের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলো এই কোম্পানিরই বানানো।
স্থপতি ইরাকের মোহাম্মদ সালেহ মাকিয়া এবং লন্ডনের কুড ডিজাইন কোম্পানির তত্ত্বাবধানে ছয় বছর চার মাসে মসজিদটি তৈরি হয়। ২০ হাজার শ্রমিক কাজ করেন। ব্যবহার করা হয় বিশ্বের নানা জায়গার নামি-দামি সব উপকরণ। ৩০ হাজার মেট্রিক টন সেরা মানের বেলেপাথর আনা হয় ভারতের খনি থেকে।
Advertisement
ইতালি, মিশর, ভারত থেকে আনা হয় মার্বেল ও মোজাইক পাথর। ভাস্কর্য তৈরিতে কাজ করে ওমানের ৬০ জন এবং ভারতের ২০০ জন কারুশিল্পী। মসজিদের মূল নামাজের ঘরের আয়তন সাড়ে ৫ হাজার বর্গমিটারেরও বেশি। একসঙ্গে জামাতে দাঁড়াতে পারেন প্রায় ৭ হাজার মুসল্লি। কারুকাজ করা উঁচু দরজা, ওপর, নিচ, চারদিকে নান্দনিক স্থাপত্য শৈলীর ছড়াছড়ি।
সাদা ও গাঢ় ধূসর মার্বেল পাথর দিয়ে আচ্ছাদিত চারদিকের দেয়াল। গায়ে লতাপাতার মোটিফ ও জ্যামিতিক নকশার ম্যুরাল। মেঝেজুড়ে বিছানো সেই বিখ্যাত কার্পেট। এক সময় বিশ্বের হাতে বোনা টুকরাবিহীন কার্পেট, এখন দ্বিতীয় বৃহত্তম। আয়তন ৪ হাজার ৩৪৩ বর্গমিটার। ওজন ২১ মেট্রিক টন। ক্লাসিক্যাল, তাব্রিজ, কাশান এবং ইসাফাহান ঐতিহ্যের নকশায় ১৭০ কোটি সুতার বন্ধনে বোনা। নানা রঙের বিন্যাস ২৮টি স্তরে। ৬০০ ইরানি নারী চার বছর ধরে এটি বুনেন। সরবরাহ করে বিশ্বখ্যাত ইরান কার্পেট কোম্পানি।
ছাদের মাঝ বরাবরে সুদৃশ্য কেন্দ্রীয় গম্বুজ, তার মাঝখানে ঝুলানো এক সময় গিনিস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডের ঝাড়বাতিটি। বিশ্বের সবচেয়ে বড় বর্তমানে দ্বিতীয় বৃহত্তম। ওজন সাড়ে ৮ মেট্রিক টনের বেশি। উচ্চতা ১৪ মিটার। ৬ লাখ টুকরা অস্ট্রিয়ান স্বরভস্কি ক্রিস্টাল, ১১২২টি হেলোজেন ব্লাব, মেটাল বিটের ওপর ২৪ ক্যারেটের সোনার প্রলেপের এই ঝাড়বাতিও বানাতে ৪ বছর লেগেছিল।
তৈরি করে জার্মানের ফৌস্টিগ কোম্পানি। এর সঙ্গে হলজুড়ে ১৬টি ছোট ঝাড়বাতি প্রধান নামাজ ঘরকে আরো উজ্জ্বল করেছে। মেঝে থেকে ৫০ মিটার ওপরে কেন্দ্রীয় গম্বজটি চারটি বড় পিলারের সঙ্গে যুক্ত। গম্বুজের ভেতরটা মার্বেল কলাম কাঠামোর মধ্যে খোদাই করা রঙিন গ্লাসের অনেকগুলো ছোট ছোট জানালা এবং চীনা মাটির বাসন প্যানেলে অলঙ্কৃত।
গম্বুজের খালি অংশ বাদ দিয়ে পুরো সিলিংয়ে অলংকিত করা হয়েছে কারুকাজ খচিত কাঠের প্যানেলে। গম্বুজ আর সিলিং যে কত শৈল্পিক ও সুন্দর হতে পারে স্থপতি দেখিয়েছেন বটে। কিছুটা সময় নিতে হলো এই সৌন্দর্য থেকে চোখ ফেরাতে। সিলিংয়ের সঙ্গে লাগানো ওপরের কলামে ইবনে মুক্লা শরাজির উদ্ভাবিত ইসলামী ঠুলুথ লিপিতে কোরানের আয়াত অংকিত। পাশের বারান্দার প্রবেশ পথগুলোও ইসলামিক জ্যামিতিক ও অলংকরিক ফ্রেমওয়ার্ক জ্যামিতিক ফ্রেমওয়ার্ক দিয়ে পূরণ করা।
সুন্দরে কোনো অংশে কম নয় মেহরাবটি। নিচ থেকে ওপর পর্যন্ত অসংখ্য ছোট খুপরির প্যার্টানে মোজাইকে আচ্ছাদিত। লতা-পাতার মোটিফ ও অলংকারিক নকশার মাঝখানে আল্লাহ নাম ও কোরআনের আয়াতের ক্যালিওগ্রাফি, দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল। প্রধান নামাজ ঘরের লাগোয়া নারীদের জন্য সাড়ে ৫০০ বর্গমিটারের আলাদা একটি মুসালা আছে।
৭৫০ জন এক সঙ্গে নামাজ পড়তে পারেন। পুরুষ ও নারীদের জন্য আলাদা অজুখানা দুটিও সুদৃশ মার্বেলে বানানো। প্রধান প্রার্থনা হলের আশপাশের ভবন, দেয়াল এবং চত্বর, বাইরের সীমানা দেয়াল ওমানের ঐতিহ্যবাহী দুর্গ স্থাপত্যের আদলে গড়া। নকশায় প্রাধান্য পেয়েছে পবিত্র কুরআনের আয়াত। বারান্দাগুলো অনেকটা সুরক্ষিত প্রাচীরের মতো মনে হয়। প্রতিটি নির্দিষ্ট ইসলামিক সংস্কৃতির সাজসজ্জা ধারণ করছে।
এমআরএম/জেআইএম