বিশেষ প্রতিবেদন

ঈদকে কেন্দ্র করে ফিটনেসহীন লঞ্চ জোড়াতালির মহাযজ্ঞ

দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের চরকালিগঞ্জ এলাকা। চারদিকে মহাসমারোহে চলছে ভাঙা আর মরিচা ধরা লঞ্চের মেরামতের কাজ। কেউ ব্যস্ত লঞ্চের বডি নির্মাণের কাজে, কেউবা পুরাতন পাটাতন সরিয়ে নতুন পাঠাতনে ঝালাইয়ের কাজে। আবার কেউ ব্যস্ত লঞ্চের রং করার কাজে। আর এসবের তদারকি করছেন ডকইয়ার্ডের লোকজন। ঠিক এমন চিত্র দেখা গেল কেরানীগঞ্জের অন্তত দশটি ডকইয়ার্ডে।

Advertisement

আসছে ঈদ। আর এই ঈদকে কেন্দ্র করে আপনজনদের সঙ্গে ঈদ করতে ঢাকা ছাড়তে শুরু করবে দক্ষিণ বঙ্গের মানুষ। নদী পারাপারের মাধ্যম লঞ্চ। এ সুযোগে মেরামত ও রং করে নামানো হচ্ছে অনেক পুরনো লঞ্চ। দেয়া হচ্ছে জোড়াতালি। এসব ফিটনেসহীন লক্কড়-ঝক্কড় লঞ্চের জোড়াতালিতে বাড়ছে নিরাপত্তাহীনতা। তবে নদী পারাপারের মাধ্যম যেহেতু এই লঞ্চ, তাই সাধারণ যাত্রীরাও নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনা না করেই প্রতিবারের নেয় এবারও এসব লঞ্চে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যাতায়াতে বাধ্য হবেন। সবমিলিয়ে এ বছরও নৌপথে ভরসা ঝুঁকিপূর্ণ লঞ্চ।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, বুড়িগঙ্গার তীরে গড়ে ওঠা চরকালিগঞ্জ ও চরমিরেরবাগ এলাকার ডকইয়ার্ডগুলোতে টুংটাং শব্দে চলছে যাত্রীবাহী ও বড় কার্গোবাহী লঞ্চগুলোর মেরামতের কাজ। সকাল থেকে রাত অবধি শ্রমিকরা খুব ব্যস্ত সময় পার করছেন। কেউ ওয়েল্ডিং আবার কেউ রং মাখাতে ব্যস্ত।

সদরঘাট এলাকার অন্তত ১০টি ডকইয়ার্ড ঘুরে দেখা যায়, বিভিন্ন ডকইয়ার্ড ও গ্যারেজে পুরনো নৌযান ও বাস মেরামতের ধুম চলছে। কেরানীগঞ্জের তেলঘাট থেকে মিরেরবাগ পর্যন্ত ৩৭টির মতো ডকইয়ার্ডেই দেখা গেল কোনো না কোনো পুরনো লঞ্চে রং লাগানো ও মেরামতের কাজ চলছে। ফিটনেসহীন লঞ্চগুলোতে জোড়া দেয়া হচ্ছে লঞ্চের ভেঙে যাওয়া বিভিন্ন অংশ। মেঝে কিংবা কার্নিশে লাগানো হচ্ছে লোহার পাত। ইন্টেরিয়র ডিজাইনেও পরিবর্তন করা হচ্ছে। এমনকি বুড়িগঙ্গার পাড়ে কেরানীগঞ্জের তেলঘাট ও কেরোসিনপট্টি অংশের ইয়ার্ডে বেশ কয়েকটি লঞ্চের নিচের অংশও মেরামত করতে দেখা গেছে।

Advertisement

ডকইয়ার্ডে লঞ্চ মেরামতের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তি ও লঞ্চ কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঈদের আগে ফিটনেস লাইসেন্স নিতে ত্রুটিপূর্ণ লঞ্চগুলো নামমাত্র সংস্কার করা হয়। এখন সংস্কারের কাজ চলছে।

ভাসমান ডকে সংস্কার করতে দেখা গেল প্রিন্স রাসেল-৩। লঞ্চটির সুপারভাইজার মাহিদ আলম জানান, ঈদ উপলক্ষে লঞ্চটি সংস্কারের কাজ চলছে। লঞ্চের যেসব স্থানে ভাঙা বা ক্ষয় হয়ে গেছে সেগুলো দেখে দেখে মেরামত করা হচ্ছে। তিনি বলেন, মেরামত করা না হলে ঈদ উপলক্ষে লঞ্চটি আনফিট দেখানো হলে আর চালানো যাবে না। বছরের সবচেয়ে বড় আয়ের উৎস হলো দুই ঈদ। তাই প্রতিটি ঈদের আগে লঞ্চের ফিটনেস নিশ্চিত করতে মেরামত জরুরি হয়ে পড়ে।

একইভাবে এমভি জাহিদ-৭, এমভি প্রিন্স অব রাসেল-২, মেসার্স জাহিদ শিপিং লাইন্স, এমভি জামাল-১, এমভি ঝান্ডা-২, মেসার্স রাজু অ্যান্ড ব্রাদার্স, মশিরণ খান-১, এমভি শরিফউদ্দিন-১, হাসান হোসেন-২-সহ প্রায় অর্ধশতাধিক লঞ্চ সদরঘাট এবং তেলঘাট এলাকা জুড়ে মেরামত করতে দেখা গেছে।

কেরানীগঞ্জের চরকালীগঞ্জ তেলঘাট, খেজুরবাগ, হাসনাবাদ এলাকায় ডকইয়ার্ডে গিয়ে অন্তত ৫০টির বেশি লঞ্চ মেরামত ও রং করার কাজ চলতে দেখা যায়।

Advertisement

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তেলঘাট এলাকার ওয়েল্ডিং মিস্ত্রি বলেন, সপ্তাহ খানেক ধরে এসব লঞ্চের মেরামতের কাজ চলছে। এর মধ্যে বড় ধরনের ত্রুটিও ছিল অনেক লঞ্চের। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ডকইয়ার্ড মালিক বললেন, এ রকম লক্কড়-জক্কড় ও ফিটনেসবিহীন লঞ্চের সংখ্যা হবে শতাধিক।

তেলঘাটের পারজোয়ার ডকইয়ার্ডের মালিক সদরখান জানান, আশপাশের যেসব ডকইয়ার্ডে লঞ্চ তৈরি ও মেরামত হচ্ছে, সেগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটি বৈধভাবে গড়ে ওঠেনি। কিন্তু এগুলোর বিরুদ্ধে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) যথাযথ ব্যবস্থা নেয় না। ফলে যাদের বৈধ্যতা আছে তাদেরকেও মাঝে মাঝে তাদের অপকর্মের ভাগ নিতে হয়।

বিআইডব্লিউটিএর কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারির পর এসব ডকইয়ার্ডের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো উচ্ছেদ অভিযানও হয়নি। এদিকে ডকইয়ার্ডগুলো নদীদূষণ করছে বলে অভিযোগ করেছেন পরিবেশবাদীরা।

বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষের মতে, নদীতে চলাচলকারী শতকরা ৫০ ভাগ লঞ্চেরই কোনো রেজিস্ট্রেশন নেই।

অভ্যন্তরীণ নৌ-চলাচল সংস্থার (জাব) সিনিয়র সহ-সভাপতি বদিউজ্জামান বাদল বলেন, ‘সদরঘাট থেকে যেসব লঞ্চ বিভিন্ন রুটে চলাচল করে তার কাগজপত্রে কোনোক্রটি নেই। ঈদের আগে প্রতিটি টার্মিনালের জাহাজগুলো চেক-আপ হয়। যেসব লঞ্চে ত্রুটি-বিচ্যুতি রয়েছে তখন সেগুলো ঠিক করতে ডকইয়ার্ডে নেয়া হয়। তারা ত্রুটি-বিচ্যুতি ঠিক করে পুরো জাহাজকে রং করে নেন। আর স্টিল বডিতে যত রং করা হয়, তত ভালো থাকে।’

তবে লঞ্চ মালিক সমিতির সভাপতি মাহবুব উদ্দিন আহমেদের দাবি, এসব কাজে যথেষ্ট তদারকির ব্যবস্থা আছে, ফলে ঈদে লঞ্চ দুর্ঘটনার সম্ভাবনা নেই। তার মতে, অতিরিক্ত যাত্রী ঠেকানোর জন্য যে অবকাঠামোগত ব্যবস্থা দরকার, তা দেশে নেই।

এ ব্যাপারে বিআইডব্লিউটিএর যুগ্ম-পরিচালক জয়নাল আবেদীন বলেন, ‘লক্কড়-ঝক্কড় লঞ্চ নদীতে নামতে দেয়া হবে না। ঈদের ১০ দিন আগে থেকেই বেশ কয়েকটি মোবাইল কোর্ট থাকবে। র‌্যাব, পুলিশ, আনসারসহ পর্যাপ্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য থাকবে। অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে কোনো লঞ্চ যাতে চলতে না পারে এ জন্য কঠোর নজরদারি থাকবে ‘

তিনি আরও বলেন, ‘পুরনো লঞ্চগুলোতে রং করে বা মেরামত করে নতুনভাবে নামানোর কোনো সুযোগ নেই। অন্য বছরের তুলনায় এ বছর লঞ্চের বিশেষ সার্ভিস বাড়ানো হয়েছে। আশা করি, ঘাটতি থাকবে না। যেসব লঞ্চ যাত্রীদের আকৃষ্ট করতে রং করা হচ্ছে, সেগুলোর দিকে আরও বেশি নজর রয়েছে।’

ইমরান খান/এসআর/জেআইএম