বিশেষ প্রতিবেদন

নিজেদের শাসন করা শিখল না বাঙালি

হাসান আজিজুল হক। উপমহাদেশের প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক। লিখছেন সমাজের নানা প্রসঙ্গ নিয়ে। তার সাহিত্যকর্মের কেন্দ্রে মানুষ থাকলেও নারী অধিকারের বিষয়টিও স্পষ্ট। সমাজ, সমাজের পরিবর্তন, উন্নয়ন, শিক্ষাসহ বিভিন্ন প্রসঙ্গ নিয়ে সম্প্রতি মুখোমুখি হন জাগো নিউজ-এর।

Advertisement

উন্নয়নের কেন্দ্রে ‘মানুষ’। মানুষকে মানুষ হিসেবে গুরুত্ব না দেয়াই সমাজে বৈষম্য, অসঙ্গতি বাড়ছে বলে মত দেন। ‘একই মানসিকতায় নারীর প্রতিও সহিংসতা বৃদ্ধি পাচ্ছে’- এমনটি উল্লেখ করে এ সমাজচিন্তক বলেন, মূলত শিক্ষা আর রাষ্ট্রের দুর্বল কাঠামোর জন্যই এমন হচ্ছে। দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে প্রথমটি।

আরও পড়ুন >> ‘ভাষা-সংস্কৃতির ইতিহাস নিয়ে দাঁড়াতে পারলাম না’

জাগো নিউজ : আপনার সাহিত্যকর্মে সমাজ-ই মূল উপজীব্য। লিখছেন মানুষকে কেন্দ্রে রেখেই। জীবনের এ বেলায় সমাজের পরিবর্তন কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

Advertisement

হাসান আজিজুল হক : সমাজের পরিবর্তন হচ্ছে ঘূর্ণীয়মান একটি বিষয়। শুধুই ঘুরছে আর ঘুরছে। চারদিকে পরিবর্তন হচ্ছে। নতুন নতুন পরিবর্তন। বলা যায়, একই বই শুধু মলাট আলাদা। সবই এক, প্রেক্ষাপট আলাদা।

প্রশ্ন হচ্ছে, সমাজ পরিবর্তনের মাপকাঠি কে ঠিক করবে? গ্রামের গরিব মানুষের কাছে পরিবর্তন একরকম। আমার মতো মধ্যবিত্ত মানুষের কাছে আরেকরকম। আবার শহুরে মানুষের কাছে অন্যরকম।

জাগো নিউজ : আপনার অবস্থান থেকে এ পরিবর্তন নিয়ে কী বলবেন?

হাসান আজিজুল হক : রাষ্ট্রের মৌলিক কাঠামোয় বিত্ত-বৈভবের প্রসঙ্গ আসে। সেখানে যদি বিরাট বৈষম্য সৃষ্টির মধ্য দিয়ে পরিবর্তন ঘটে তাহলে সমাজের মধ্যকার যে ভারসাম্য তা হারিয়ে যায়। এটা আমি মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে খুব অনুভব করি। প্রতিটা সমাজের পরিবর্তন নিয়ে মধ্যবিত্তের মধ্যে চাপা অসন্তোষ ও ধূমায়িত অসন্তোষ সবসময় বিরাজ করে। এরপর কোনো এক সময় সে অসন্তোষ জ্বল জ্বল করে জ্বলতেও দেখা যায়।

Advertisement

জাগো নিউজ : বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কী বলবেন?

হাসান আজিজুল হক : বাংলাদেশে আসলে কার পরিবর্তন ঘটল, তা বলা মুশকিল। গার্মেন্টস শ্রমও সমাজ পরিবর্তনের একটা নিয়ামক হিসেবে কাজ করল এবং স্বাধীনতার পর এ সূচক আমাদের সমাজের জন্য নতুন সংযোজন। এ রকম হাজারও সূচক রয়েছে। আবার ব্যাংক ব্যবস্থা জনপুঁজির হিসাব সংরক্ষণ করে।

আরও পড়ুন >> নারীর নিরাপত্তায় সমগ্র রাষ্ট্রব্যবস্থা ব্যর্থ : হাসান আজিজুল হক

একেক হিসাব একেক রকম। বিশ্বসংস্থাগুলো বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার স্বীকৃতি দিচ্ছে। আমরা বলি, এ সময়ে শিল্প-সাহিত্য-ভাষারও খানিক উন্নতি ঘটেছে।

জাগো নিউজ : শ্রেণি বৈষম্যের কথা বলছিলেন?

হাসান আজিজুল হক : হ্যাঁ, পরিবর্তনের নানা সূচক বিরাজমান। এরপরও রাষ্ট্রে শ্রেণি বৈষম্যে খুব একটা পরিবর্তন আসেনি।

জাগো নিউজ : এজন্য কোন বিষয়টা সামনে আনা যায়…

হাসান আজিজুল হক : রাষ্ট্র ও সমাজের মূল কাঠামো দাঁড়িয়ে আছে কৃষির ওপর। কৃষির ওপরই বাংলাদেশের ৬০-৭০ ভাগ উন্নয়ন নির্ভর করার কথা। কোন জমিগুলো কর্ষণযোগ্য আর কোনগুলো কর্ষণযোগ্য নয়, এগুলোও আমাদের সমাজ বাস্তবতার সঙ্গে জড়িত। কিন্তু এ বাস্তবতায় ব্যাঘাত ঘটেছে নানাভাবে।

তবে আমাদের এখানে অল্প-বিস্তর উন্নতি তো হলোও বটে। যেমন- যোগাযোগ ব্যবস্থাতে বেশ উন্নয়ন হয়েছে। মানুষ চলাফেরায় কতটা অসুবিধায় ছিল, তা তো নিজ থেকেই জানি। বিত্তবান হলে রাজশাহী থেকে ঢাকায় আধাঘণ্টায় যাওয়া যায়। এসব দিক থেকে বললে, গত অর্ধশত বছরে পরিবর্তন ভালোই হয়েছে। তবে রাষ্ট্র ও সমাজের এ পরিবর্তন আমি ‘বাধ্যতামূলক’ ভালো হওয়া বলি।

জাগো নিউজ : ‘বাধ্যতামূলক ভালো’ বিষয়টি যদি ব্যাখ্যা করতেন…

হাসান আজিজুল হক : দুনিয়া তো অনেক এগিয়ে গেছে। এ এগিয়ে যাওয়া দুনিয়ায় বসে থাকার কোনো সুযোগ নেই। প্রযুক্তির কারণেই বাধ্যতামূলক পরিবর্তন চলে এসেছে।

কিন্তু বাধ্যতামূলক পরিবর্তন সবসময় মানুষের কল্যাণেও আসে না। জলবায়ুর পরিবর্তন তো মানুষের ক্ষতিই বয়ে আনছে। রাজশাহী বিশ্বের মধ্যে অন্যতম দূষণমুক্ত নগরী ছিল। এখন সেখানেও দূষণ। মানুষ বাড়ছে। ঠেকানোর উপায় নেই। সুতরাং বাধ্যতামূলক পরিবর্তনও মেনে নিতে হচ্ছে।

জাগো নিউজ : মানুষের স্বভাবগত পরিবর্তন নিয়ে কী বলবেন?

হাসান আজিজুল হক : সমাজ থেকে অনিয়ম, দুর্নীতি দূর করতে রাষ্ট্রব্যবস্থায় দুর্নীতি দমন কমিশন গঠন করা হলো। তাতে কি দুর্নীতি কমছে? শোনা যায়, দুদকের কর্মকর্তারাও দুর্নীতি করেন। তার মানে, সরষের মধ্যেও ভূত আছে।

আরও পড়ুন >> এ জীবন নিয়ে তারা আর কি করবে?

আসলে মানুষের স্বভাব সহজে বদলায় না, যদি শিক্ষার গুণগত পরিবর্তন না হয়। শিক্ষাব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়নের কথা বলা হয়। হয়েছেও বটে। তাতে কী? মানুষের স্বভাব কি বদলাল?

আবার প্রকৃত শিক্ষার হার নিয়েও নানা কথা। মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, উচ্চ শিক্ষায় কতজন ঝরে গেল, তার কী আসল কোনো চিত্র আমাদের কাছে আছে? আবার শিক্ষার সঙ্গে কর্মসংস্থানেরও একটা সম্পর্ক আছে। কিন্তু মানুষ তার শিক্ষার আলো নিয়ে সঠিক কর্মসংস্থানে যেতে পারছে না। স্বভাবগত পরিবর্তন তো এসবের সঙ্গেও জড়িত।

পদার্থ বিজ্ঞানের ছাত্ররা ব্যাংকে বা কোম্পানিতে চাকরি করছে। আবার ব্যাংক বিষয়ে পাস করে স্কুলে শিক্ষকতা করছে। তার মানে এখানে অবশ্যই গড়মিল আছে।

আবার যেখানে কর্মসংস্থান হচ্ছে সেখানে সত্যিকার মূল্য পাচ্ছে না। গ্রামের গরিব নারী শ্রমিকদের আয় ভোগ করছেন মধ্যস্বত্বভোগী পোশাক কারখানা মালিকরা। উৎপাদিত মূল্যের সঙ্গে শ্রমিকদের দেয়া মূল্যের কোনো সম্পর্ক নেই। তার মানে, শ্রমের জায়গাটা এখনও বৈষম্যে ভরা।

আবার পরনির্ভরতাও আমাদের সমাজকে ঠিক এগোতে দেয়নি। জন্মলগ্ন থেকে অন্যের কাছে হাত পেতে চলতে হয়েছে। রাস্তা, কালভার্ট, ব্রিজ বানানোর জন্য কারও কারও কাছে হাত পাততে হয়েছে। শাসন ও শোষণের এটাও একটা হাতিয়ার। কারণ যে ভিক্ষে দেয়, সে খবরদারিও করে। আমাদের ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে। দাতাসংস্থাগুলো তো মাত্রাতিরিক্ত মাতব্বরি করল। এ কারণে বাঙালি এখনও নিজেদের শাসন করা শিখল না।

জাগো নিউজ : এ শাসন না করার জন্য কোন বিষয়কে মূলত দায়ী করা যায়?

হাসান আজিজুল হক : মানসিকতা। বাঙালি মানসিকতায় এগোতে পারেনি। স্বনির্ভর হওয়ার জন্য শিক্ষার অর্জন ও প্রয়োগ জরুরি। আমরা সেটা করতে পারছি না।

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামোর মধ্যে গলদ আছে। গরিব হওয়ার কারণে অধিকাংশ শিক্ষার্থী প্রাইমারি স্তর থেকে ঝরে পড়ছে। এখন হয়তো পরিবর্তন হয়েছে কিছুটা। কিন্তু কত সংখ্যক শিক্ষার্থী ঝরে গেল, তার কোনো খবর আছে? বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেধাবীরা বের হচ্ছে। কাজ দিতে পারছে না সরকার। বাইরে চলে যাচ্ছে। বাইরে গিয়ে শ্রম দিয়ে ওইসব দেশের উন্নয়নে কাজ করছে। দেশের কিছুই করতে পারছে না। শিক্ষার এ বিষয়গুলো ভাবলে ইতিবাচক ও নেতিবাচক- উভয় বিষয়ই সামনে আসে।

আরও পড়ুন >> জনগণের শক্তিকেই সামনে আসতে হবে

জাগো নিউজ : এর মধ্যেও তো দেশ এগিয়ে যাচ্ছে…

হাসান আজিজুল হক : গোটা পৃথিবীই তো এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ চাইলেও একেবারে পিছিয়ে থাকতে পারবে না।

কোনো দেশই পিছিয়ে পড়ছে না। বরং আমাদের আরও এগিয়ে যাওয়ার কথা ছিল এবং সেটা নিয়েই আলোচনা করা উচিত।

এএসএস/এনডিএস/এমএআর/পিআর