২০১৭ সালের ২৭ অক্টোবর রাজধানীর শ্যামপুরে খুন হন হেলাল উদ্দীন। তার সঠিক পেশা কারও জানা ছিল না। এলাকাবাসীর চোখে তিনি ইয়াবা সেবন ও বিক্রি করতেন। আবার পুলিশকে মাদক ব্যবসার খবরও সরবরাহ করতেন। নিজেকে পুলিশের সোর্স দাবি করে এলাকার অনেককে ভয়ভীতি দেখাতেন। জেলে ঢোকানোর ভয়ও দিতেন।
Advertisement
দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এসব ‘অপকর্মের’ জেরে তাকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। পরিকল্পনায় জড়িয়ে পড়েন স্থানীয় নিম্ন আয়ের মানুষ। তাদের মধ্যে ছিলেন রিকশাওয়ালাও।
২০১৭ সালের ২৭ অক্টোবর বিকেলে শ্যামপুর সেতু এলাকায় আলেফ চাঁনের রিকশার গ্যারেজ থেকে হেলাল উদ্দিনের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। ওই ঘটনায় তার ভাই বেলাল উদ্দিন বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। ক্লুলেস মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পায় মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের ডেমরার জোনাল টিম।
ক্লুলেস এ মামলায় দেড় বছরে কোনো অগ্রগতি না থাকলেও সম্প্রতি ওই ঘটনায় দুজনকে গ্রেফতার করে ডিবি পুলিশ। তারা হলেন- মো. সাদ্দাম ও শফিকুল ইসলাম রতন। সাদ্দাম রিকশাচালক এবং রতন স্থানীয় একটি পানের দোকানদার।
Advertisement
ওই দুজনকে পরে রিমান্ডে নিয়ে দীর্ঘ জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে তারা হেলালকে হত্যার বিষয়টি স্বীকার করেন। সম্প্রতি নিম্ন আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট আতিকুল ইসলামের কাছে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন তারা। তাদের কথায় উঠে আসে হেলালকে হত্যার রহস্য। জবানবন্দিতে সাদ্দাম বলেন, ‘অসৎ’ ব্যক্তিকে হত্যার জন্য যদি তাদের ফাঁসি হয়, সমস্যা নাই।
জবানবন্দিতে তারা হেলালউদ্দিনকে হত্যার কারণ উল্লেখ করেন। তারা বলেন, হেলাল ইয়াবা ব্যবসা, চাঁদাবাজির পাশাপাশি নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর অত্যাচার চালাতেন। হত্যা করার আগের দিন তিনি শ্যামপুর এলাকার একজনের কাছে চাঁদা আনতে যান। সেখানে বাড়ির কর্তাকে না পেয়ে তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী ও মাকে মারধর করেন। এতে অন্তঃসত্ত্বার গর্ভের সন্তানটি মারা যায়। ওই ঘটনার পরপরই হেলালকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়।
হত্যার উদ্দেশ্য সম্পর্কে ডিবির তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, হেলাল ডেমরার একটি ‘স্বনামধন্য’লোকের ছত্রছায়ায় থেকে মাদক ব্যবসা, সেবন ও চাঁদাবাজির পাশাপাশি নিম্ন আয়ের মানুষের ওপরে অত্যাচার করতেন। তদন্তে তার বিরুদ্ধে এক অন্তঃসত্ত্বা নারীকে মারধর এবং তার গর্ভের বাচ্চাটি মারা যাওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
যেভাবে হত্যা
Advertisement
আসামিদের জবানবন্দি অনুযায়ী, ওই হত্যার ঘটনায় তারা দুজন ছাড়াও অংশ নেন স্বপন, সোহেল, রানা, পিচ্চি কাউছার ও সজীব। তাদের কেউ হোটেলের বেয়ারা, কেউ মোটরসাইকেল সার্ভিসিংয়ের দোকান কর্মচারী আবার কেউ রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন। সবাই নিম্ন আয়ের মানুষ।
সাদ্দাম ও রতন হেলালের পূর্ব পরিচিত। তারা একসঙ্গে দুপুরের খাবেন বলে হেলালকে কদমতলীর আলেফ মিয়ার রিকশার গ্যারেজে ডেকে আনেন। সেখানে তারা একসঙ্গে একই টেবিলে বসে দুপুরের খাবার খান। খাবার শেষে ওই গ্যারেজেই হেলালকে ৭-৮ জন মিলে ছুরি দিয়ে পেট চিরে হত্যা করেন।
জবানবন্দিতে সাদ্দাম আদালতকে বলেন, তিনি তিন বছর ধরে আলেফ চাঁনের গ্যারেজের রিকশা ভাড়া নিয়ে চালান। হেলাল উদ্দিন স্থানীয় রিকশাচালক ও ফুটপাতের দোকানদারদের কাছ থেকে নিয়মিত চাঁদা তোলেন। চাঁদা না পেলে মারধর আর গালিগালাজ করতেন। জেলে ঢুকানোর ভয় দেখাতেন। আমরা খেটে খাওয়া মানুষ। ওর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে একপর্যায়ে তাকে হত্যার পরিকল্পনা করি। এ কারণে যদি ফাঁসিও হয়, কোনো সমস্যা নাই। স্থানীয় নিরীহ মানুষ তো তার হয়রানি থেকে বাঁচলো।
অপর আসামি শফিকুল ইসলাম রতন জবানবন্দিতে বলেন, তার একটি পানের দোকান রয়েছে। হেলালের চাঁদাবাজি আর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে স্বপন, সোহেল, রানা, পিচ্ছি কাউছার ও সজীব মিলে হেলালকে হত্যার পরিকল্পনা করি। তারা দুপুরের খাবার খাওয়ার পর গ্যারেজে এলে সাদ্দাম হেলালকে মাটিতে ফেলে দেয়। এরপর তাকে হত্যা করা হয়।
ক্লুলেস মামলাটির জট খোলা খুব একটা সহজ ছিল না। তদন্তে নেমে ডিবির কর্মকর্তাকে নাকানি-চুবানি খেতে হয়। অপরাধীরা শিক্ষিত না হওয়ায় প্রযুক্তি দিয়ে তাদের ধরা সম্ভব হচ্ছিল না। এ কারণে ডিবির তদন্ত কর্মকর্তাকে ছয় মাস শ্যামপুরে একটি বাড়ি ভাড়া নিয়ে এবং হকারি করে তথ্য সংগ্রহ করতে হয়। এরপর সব তথ্য যাচাই-বাছাই শেষে গ্রেফতার করা হয় তাদের।
মামলার তদন্ত নিয়ে ডিবির অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) নাজমুল হাসান জাগো নিউজকে বলেন, ক্লুলেস মামলাটি তদন্তে ছদ্মবেশে ডিবির এক কর্মকর্তা রিকশা গ্যারেজের পাশে বাসা ভাড়া নিয়ে তদন্ত শুরু করেন। একপর্যায়ে ঘাতকদের চিহ্নিত করে দুজনকে গ্রেফতার করা হয়।
হত্যাকাণ্ডের কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘হেলালের চাঁদাবাজি, অত্যাচার ও নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে রিকশাচালকরা হত্যার পরিকল্পনা করেন।’
ওই হত্যার ঘটনায় ৭-৮ জনের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। তাদের বিষয়ে ডিবির তদন্ত কর্মকর্তা ডি. এম. এ. মজিদ জাগো নিউজকে বলেন, পলাতক অন্য আসামিদের গ্রেফতারে চেষ্টা চলছে।
এআর/এমএআর/পিআর