> শূন্য কোটার অতিরিক্ত পাঁচ শতাধিক শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়েছে> ভর্তি হওয়াদের মধ্যে আবেদনও করেনি এমন শিক্ষার্থী রয়েছে> ভর্তিতে অবৈধ অর্থের ভাগ শিক্ষা বিভাগের কর্তারাও পেয়েছেন
Advertisement
ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে এবারও পাঁচ শতাধিক শিক্ষার্থী অতিরিক্ত ভর্তির অভিযোগ পাওয়া গেছে। অভিযোগ উঠেছে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ভর্তি নীতিমালাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নানা কৌশলে অতিরিক্ত আসন তৈরি করে অর্থ লেনদেনের মাধ্যমে এসব শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়েছে।
নীতিমালা অনুযায়ী পূর্ব ঘোষণা ছাড়া ভিকারুননিসায় কোনো আসনে শিক্ষার্থী ভর্তি করা যাবে না। অথচ এক শাখায় শূন্য আসন দেখিয়ে অন্য শাখায় শিক্ষার্থী ভর্তি করেছে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ কর্তৃপক্ষ। অতিরিক্ত ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে আবেদনও করেনি এমন বেশ কয়েকজন রয়েছে।
এছাড়া লটারিতে ব্যর্থ বা লিখিত পরীক্ষায় ফেল করা শিক্ষার্থীদেরও ভর্তি করা হয়েছে। এসব ভর্তি ‘অবৈধ’ বিবেচিত হয়ে থাকে। ইতোমধ্যে বিষয়টি নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে আলোচনা হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বলে জানা গেছে।
Advertisement
আরও পড়ুন> ভিকারুননিসার দুই শিক্ষকের বিরুদ্ধে চার্জশিট গ্রহণ ৩০ এপ্রিল
এ প্রসঙ্গে ভিকারুননিসার অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যাপক ফেরদৌসি বেগম অবৈধ ভর্তির বিষয়টি স্বীকার করে সোমবার জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি দায়িত্বে আসার আগে বিভিন্ন মাধ্যমে বেশকিছু শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়েছে। এখনও শিক্ষার্থী ভর্তি করতে প্রতিদিন অভিভাবকরা নানা ধরনের তদবির নিয়ে আসছেন। আমি তাদের ফিরিয়ে দিচ্ছি। এসব ভর্তির সঙ্গে আমার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘এ প্রতিষ্ঠানে স্থায়ী অধ্যক্ষ নিয়োগ হওয়ার আগ পর্যন্ত আমি ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। তবে আমি দায়িত্বে বসার পর অবৈধ ভর্তি হয়নি এবং হবেও না।’ এছাড়া অবৈধ ভর্তির পাশাপাশি নিয়মবহির্ভূতভাবে বেশকিছু ছাত্রীর শাখা ‘ট্রান্সফার’ করা হয়েছে বলেও তিনি স্বীকার করেন।
অভিযোগ পাওয়া গেছে, বিধিবহির্ভূত এসব ভর্তির নেপথ্যে প্রতিষ্ঠানের সাবেক এক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ এবং গভর্নিং বডির কয়েকজন সদস্য মূল ভূমিকা পালন করেন। ভর্তির ক্ষেত্রে অর্থের লেনদেনের অভিযোগও করেছেন কেউ কেউ।
Advertisement
অভিযোগকারীরা বলেন, নীতিমালাবহির্ভূত ভর্তির বিষয়টি হালাল করতে কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রভাবশালীদের তদবিরের সুপারিশ রক্ষা করা হয়েছে। এছাড়া স্থানীয় ‘মাস্তান’ এমনকি শিক্ষা বিভাগের কোনো কোনো ব্যক্তিও অর্থের ভাগ পেয়েছেন।
আরও পড়ুন> পরীক্ষায় ফেল : ভিকারুননিসার ছাত্রীর আত্মহত্যা
সূত্র জানিয়েছে, এ বছর (২০১৯) প্রথম থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত পাঁচ শতাধিক শিক্ষার্থী অতিরিক্ত ভর্তি করা হয়েছে। তবে তাদের মধ্যে ৩৬৮ জনের ভর্তির তথ্য জানা গেছে। সে অনুযায়ী সবচেয়ে বেশি ভর্তি করা হয়েছে প্রথম শ্রেণিতে ১৬৫ জন।
এছাড়া দ্বিতীয় শ্রেণিতে ৫৬ জন, তৃতীয় শ্রেণিতে ৯৫, চতুর্থ শ্রেণিতে ৩৯, পঞ্চম শ্রেণিতে ৩১, ষষ্ঠ শ্রেণিতে ১১, সপ্তম শ্রেণিতে ২৬, অষ্টমে ২ জন, নবম শ্রেণির বিজ্ঞান বিভাগে ৭ জনকে ভর্তি করা হয়েছে।
এসব শিক্ষার্থীর ভর্তির ক্ষেত্রে নানা কৌশলের আশ্রয় নেয়া হয়েছে। যেমন- আজিমপুর শাখায় দ্বিতীয় থেকে তদূর্ধ্ব শ্রেণিতে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ শিক্ষার্থী না পাওয়ায় ৮৯টি সিট খালি ছিল। অবৈধ ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে বেশকিছু রয়েছে যারা ভর্তির জন্য অনলাইনে আবেদনই করেনি। কিছু রয়েছে ভর্তি পরীক্ষায় পাস করেনি।
এ ধরনের ভর্তির বিষয়ে তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হাসিনা বেগম বলেন, যে সকল অতিরিক্ত শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়েছে তা কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী করা হয়েছে। এটি আমার একক সিদ্ধান্ত ছিল না।
আরও পড়ুন> মাতৃত্বের সম্পর্কে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ভিকারুননিসার শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা
প্রতিষ্ঠানের একাধিক শিক্ষক সূত্রে জানা গেছে, এসব ঘটনায় গত বছর তদন্ত শেষে প্রমাণ পেয়েছে মন্ত্রণালয়। এরপর ২০ আগস্ট মন্ত্রণালয় সতর্ক করে ভিকারুননিসাকে চিঠি দেয়। তাতে উল্লেখ করা হয়, ‘নীতিমালার ব্যত্যয় ঘটিয়ে ভবিষ্যতে অতিরিক্ত শিক্ষার্থী ভর্তি না করার জন্য অধ্যক্ষকে সতর্ক করা হলো। এর ব্যত্যয় হলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। জানা গেছে, শুধু ভর্তি বাণিজ্যই নয়, নিয়ম না মেনে নিয়োগের ঘটনা আছে।’
গত বছর ৯ জন শিক্ষক ও পাঁচজন প্রদর্শক পূর্ণকালীন নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তাদের অধিকাংশের শিক্ষক হওয়ার ‘নিবন্ধন’ সনদ নেই। অথচ নিয়োগের ক্ষেত্রে সরকারি বিধান অনুযায়ী এনটিআরসিএ’র (জাতীয় শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ) শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়। ফলে এ ধরনের নিয়োগ বিধিসম্মত হয়নি বলে জানান ভিকারুননিসার গভর্নিং বডির এক সদস্য।
এছাড়া গত ৯ বছরে ১৬ শিক্ষক ও কর্মচারী পদত্যাগ, মৃত্যুবরণ ও অবসরজনিত কারণে প্রতিষ্ঠান ছেড়েছেন। নিয়ম অনুযায়ী, এমপিওভুক্ত হলে তাদের তথ্য মাউশিকে জানাতে হবে। এরপর মাউশি সরকারি বেতনের বা এমপিও তালিকা থেকে নাম কর্তন করবে। কিন্তু সরকারকে এসব তথ্য অবহিত না করায় ২০১০ সাল থেকে বিভিন্ন জনের অর্থ প্রতিষ্ঠানটিতে সরকার পাঠিয়েছে। এটি সরকারি কাজে অসহযোগিতার শামিল বলে জানান ওই সদস্য।
এ বিষয়ে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান গোলাম আশরাফ তালুকদার জাগো নিউজকে বলেন, ‘অবৈধ ভর্তির খবর আমাদের কাছে এসেছে। কমিটির কোন কোন সদস্য এসব ভর্তির সঙ্গে জড়িত রয়েছেন বিষয়টি আমরা তদন্ত করছি। প্রমাণ পাওয়া গেলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
উল্লেখ্য, ঢাকায় ভিকারুননিসার মোট পাঁচটি শাখায় ১৩টি শিফটে ক্লাস অনুষ্ঠিত হয়। ১৩টি শাখায় প্রায় ২৪ হাজার শিক্ষার্থী রয়েছে।
এমএইচএম/আরএস/এমএস