বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। তিনি অসুস্থ। তার ভালো চিকিৎসা প্রয়োজন। তার আগ্রহ ছিল বেসরকারি বিশেষায়িত ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার।
Advertisement
সরকার সম্মত না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত তাকে বিএসএমএমইউতেই আসতে হয়েছে। তার চিকিৎসা চলছে। তিনি নিজে নিজে হাঁটতে পারছেন না। তার জন্য মেডিক্যাল বোর্ড গঠিত হয়েছে। বোর্ডের পরামর্শ অনুযায়ী পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তাকে বিদেশে পাঠানোর কথা শোনা যাচ্ছে। তিনি রাজি হলে প্যারোলে মুক্তি দিয়ে বিদেশে পাঠানোর কথা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলেও কেউ সেটা স্বীকার করছে না।
বিএনপি নেতাদের কেউ বলছেন, তারা বেগম জিয়ার নিঃশর্ত মুক্তি চান। কোনো সমঝোতার মাধ্যমে নয়। কিন্তু গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, নেপথ্যে কিছু ঘটছে। আর ঘটছে বলেই বেগম জিয়া বিএসএমএমইউ-তে এসেছেন। এখন যদি সমঝোতা চূড়ান্ত হয় তাহলে এপ্রিল মাসের শেষ সপ্তাহে বিএনপি চেয়ারপারসন চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাবেন আর বিএনপি থেকে নির্বাচিত ছয় জন সংসদ সদস্য শপথ নেবেন এবং সংসদে যাবেন। বিএনপি অবশ্য বিষয়টিকে ‘সমঝোতার ফসল' হিসেবে না দেখে ‘আন্দোলনের বিজয়' হিসেবে দেখতে চায়। তাই তারা বেগম জিয়ার মুক্তির দাবিতে গণঅনশনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে।
বিএনপি এখন দলনেত্রীর মুক্তির বিষয়টিকেই বড় করে দেখছে। নির্জন কারাগারে বেগম জিয়া ভালো নেই। তার শারীরিক জটিলতা বাড়ছে। তিনি তার কষ্টের কথা নিজ মুখেই বলেছেন। আইনি প্রক্রিয়ায় না হলে আন্দোলন করেই তাকে মুক্ত করার কথা ভাবতে হবে দলকে।
Advertisement
আবার বাস্তব পরিস্থিতি এমন যে, আন্দোলন করে বেগম জিয়াকে মুক্ত করার মতো অবস্থাও তৈরি হচ্ছে। এক সর্বগ্রাসী হতাশা বিএনপিকে আচ্ছন্ন করে ফেলছে। দলীয় প্রধানের মুক্তির দাবিতে ঘোষিত কর্মসূচিতেও দলের সকল স্তরের নেতা-কর্মীদের উপস্থিতি লক্ষ করা যায় না। কাজেই বিএনপিকে এখন খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য সরকারের সদিচ্ছা বা করুণার ওপরই নির্ভর করতে হবে।
সরকার আন্দোলনের চাপে না থাকলেও অতিবড় বিজয়ের কারণে সংসদ নিয়ে এক ধরনের নৈতিক চাপে আছে। বিরোধী দল শূন্য সংসদ বাস্তবে কার্যকর হয় না। আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে যারা নির্বাচনে জিতেছে তাদের জোর করে বিরোধী দলের আসনে বসালেও তারা প্রকৃত বিরোধী দল হতে পারে না। আবার বিরোধী দল না থাকলে সংসদও প্রাণবন্ত হয় না। তাই সরকারের এখন দরকার সংসদে বিরোধী দল।
সরকারের এই চাহিদা পূরণ করার ক্ষমতা আছে বিএনপির। বিএনপি যদি তাদের বিজয়ী ছয়জন সদস্যকে সংসদে পাঠায় তাহলে মন্দের ভালো হিসেবে সরকার সবাইকে বলতে পারবে যে, এই যে দেখো, আমাদেরও বিরোধী দল আছে। এখন বিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন হলো, বিএনপি সরকারের এই চাহিদা পূরণে এগিয়ে আসবে কিনা?
বাজারের খবর হলো, বিএনপি সরকারের ইচ্ছা পূরণ করবে যদি সরকারও তাদের ইচ্ছা পূরণ করে। বিএনপির এখন সবচেয়ে বড় চাওয়া নিশ্চয়ই সংসদ ভেঙ্গে নতুন সংসদ নির্বাচন নয়। বিএনপি এখন খুশি হবে তাদের নেত্রী বম্দিদশা থেকে মুক্তি পেলেই। বিএনপির এই ইচ্ছাপূরণেও সরকারের প্রবল আপত্তি না থাকার কথাই শোনা যাচ্ছে। এখন বাকিটুকু নির্ভর করছে বেগম জিয়ার নিজের ইচ্ছার ওপর। তিনি কি চান? তিনি কি সরকারের কাছে আবেদন করবেন প্যারোলের জন্য? নাকি আপসহীন অবস্থানে থাকবেন?
Advertisement
এক বছরের বেশি সময় ধরে জেলে থেকে এবং দলের সামগ্রিক অবস্থা দেখে বেগম জিয়া তার আগের মানসিক জোর ধরে রাখতে পারছেন কিনা আমরা জানি না। তবে তিনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন যে তার পৃথিবী ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে। একসময় তার বড় শক্তি ছিল ছাত্রদল।
তিনি নিজে গর্ব করে বলেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগকে মোকাবেলা করার জন্য আমার ছাত্রদলই যথেষ্ট’। সেই ছাত্র দল এখন অত্যন্ত দুর্বল এবং ক্ষীণবল। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ডাকসু নির্বাচনে ছাত্র দল খুব কম ভোট পেয়েছে। বিজয়ী প্রার্থীদের ধারেকাছেও যেতে পারেনি। এই ছাত্রদলের ওপর নির্ভরতার জোর কি বেগম জিয়া দেখাবেন?
অনেক আশা করে যে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করা হয়েছিল তারও এখন ‘ঘর নড়বড় করে' অবস্থা। ড. কামালকে নিয়ে স্বস্তিতে নেই বিএনপি। তিনি বঙ্গবন্ধুর নাম বারবার উচ্চারণ করলেও জিয়াউর রহমানের নাম একবারও নেন। তিনি এখনও কার্যত আওয়ামী ঘরানারই আছেন। বিএনপি ঘরানার হয়ে উঠতে পারেননি। তাই তার সঙ্গে ঐক্য করা নিয়ে বিএনপির মধ্যেই এখন প্রশ্ন উঠেছে। ঐক্যফ্রন্টের মূল শক্তি ড. কামাল হোসেনের গণফোরাম।
গণফোরাম থেকে নির্বাচিত দুই এমপি সুলতান মোহাম্মদ মনসুর এবং মোকাব্বির খান এরমধ্যেই শপথ গ্রহণ করেছেন। তারা বিএনপির বিরোধিতা মানেনি, এমন কি দলের সিদ্ধান্তও তারা অমান্য করেছেন। তাদের দুইজনকে বিএনপির পক্ষ থেকে বেঈমান বলে ভর্ৎসনাও করা হয়েছে। তবে তারা সংসদে গিয়ে সরকারকে কিছুটা স্বস্তি দিয়েছেন আর বিএনপিকে বেকায়দায় ফেলেছেন। এখন খালদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তির বিনিময়ে বিএনপি যদি সংসদে যায় তাহলে বিষয়টি কি দাঁড়াবে? তারাও কি ‘বেঈমান' বলে অভিহিত হবে না?
বিএনপি সরকারকে, আওয়ামী লীগকে চাপে ফেলতে গিয়ে নিজেরাই চাপের মধ্যে পড়েছে। দলের মধ্যে দেখা দিচ্ছে নানা ধরনের সংকট। কেউ কেউ দল ছাড়ছেন। কেউ নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ছেন। দলীয় সিদ্ধান্ত না মেনে উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিয়ে তৃণমূলের শতাধিক নেতা দল থেকে বহিষ্কৃত হয়েছেন। ৩০ ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচনকে প্রত্যাখ্যান করে, নতুন নির্বাচন দাবি করার পর বিএনপি আবার এখন সংসদে গেলে কর্মী-সমর্থকদের প্রতিক্রিয়া কী হবে সেটা বলা যাচ্ছে না। সব মিলিয়ে বিএনপির জন্য সময়টা খারাপ। সংসদে যাওয়া কিংবা না-যাওয়া নিয়ে বিএনপির দোদুল্যমান অবস্থা দলটিকে আরো ভোগাবে বলেই মনে হয়।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট।
এইচআর/জেআইএম