চকবাজার থেকে বনানী। বনানী থেকে গুলশান। আগুন আর আগুন। আগুনে পুড়ছে মানুষ। পুড়ছে রাজধানী। বেঁচে থাকার স্বপ্ন নিয়ে এসে রাজধানী থেকে ফিরছেন পোড়া লাশ হয়ে। মুক্তি মিলছে না নতুন-পুরান ঢাকার কোনো অঞ্চলেই। আগুন আতঙ্কে পুরো রাজধানীবাসী। উন্নয়নের এমন দশকেও আগুনের থাবা নিয়ে হতাশ মানুষ।
Advertisement
নাগরিক জীবনের শত সমস্যার নাম রাজধানী ঢাকা। নানা রকম দুর্ঘটনা এখানকার মানুষের নিত্য সঙ্গী। তবে সম্প্রতি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা মানুষের ঘুম যেন কেড়ে নিয়েছে। পুরান ঢাকার চকবাজারে স্মরণকালের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে কেঁদেছে মানুষ, কেঁদেছে বিশ্ব। সেখানকার পোড়া গন্ধ দূর না হতেই অভিজাত এলাকা বনানীর এফআর টাওয়ারে আগুন। আগুন থেকে বাঁচতে বহুতল ভবন থেকে লাফিয়ে পড়া মানুষের করুণ মৃত্যু শিহরিত করেছে সবাইকে। এর দুদিন পর গুলশানের ডিএনসিসি মার্কেটের আগুনে হাজার কোটি টাকার সম্পদ পুড়ে গেছে।
দুই বছরের ব্যবধানে দুবার আগুন এখানে। আগুনে পুড়ে সর্বস্ব হারানো মানুষের আর্তনাদে টনক নড়েছে বিভিন্ন মহলের। অভিযান, তৎপরতা নিয়ে খবর দিচ্ছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। কিন্তু এসব অভিযানের ফলাফল নিয়ে প্রশ্নও আছে জনমনে। অতীত অভিজ্ঞতা আর দুর্ঘটনার পরম্পরা থেকে নগরবাসী কোনোভাবেই আশ্বস্ত হতে পারছে না তাদের নিরাপত্তা নিয়ে। গণপূর্ত অধিদপ্তর, রাজউক আর প্রশাসনের নেয়া পদক্ষেপকে লোক দেখানো হিসেবে জানতেই অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে নাগরিকরা।
তবে গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী রেজাউল করিম বলেছেন, আমরা আগুনে পোড়া মানুষ আর দেখতে চাই না। নগরীর একটি ভবনও ঝুঁকিপূর্ণ থাকুক, তা আর হবে না। এবার সত্যিকার ব্যবস্থাই নেয়া হবে। মানুষের আবাসন নিরাপত্তা দিতে সরকার বদ্ধপরিকর। আমাদের অভিযানে সবাইকে সম্পৃক্ত হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।
Advertisement
ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর দেশে ১৬ হাজার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। গত আট বছরে দেশে ১ লাখ ৩০ হাজারের বেশি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এতে নিহত হয়েছে দুই সহস্রাধিক মানুষ। অগ্নিকাণ্ডের জন্য বৈদ্যুতিক ত্রুটিকে শতকরা ৭০ ভাগ দায়ী করা হয়েছে। এসবের উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটছে রাজধানী ঢাকায়। বিশেষ করে দুই মাসের ব্যবধানে রাজধানীতে তিনটি বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে নতুন করে ভাবিয়ে তুলেছে।
অসচেতনতা, আবাসন নীতিমালা না মানা, অগ্নিনির্বাপণের পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি না থাকা, গণপূর্ত অধিদপ্তর এবং রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) দুর্নীতির কারণেই রাজধানীতে আগুনের ভয়াবহতা বাড়ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
রাজউকের তথ্যমতে, রাজধানীতে ভবন রয়েছে ২২ লাখের বেশি। এর মধ্যে ৮৪ শতাংশ একতলা। তিন লাখ ৫২ হাজার ভবন একতলার বেশি। ১০ তলার বেশি ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা রয়েছে মর্মে ফায়ার সার্ভিসের কাছ থেকে প্রত্যয়নপত্র নেয়ার বিধান রয়েছে ২০০৮ এবং ১৯৯৬ সালের ইমারত নির্মাণ বিধিমালায়।
২০০৮ সালের আগে নির্মিত ভবনগুলোয় অগ্নিনির্বাপণের নতুন করে ব্যবস্থা রাখার বিধান জারি করা হলেও এ ব্যাপারে রাজউকের তদারকি ছিল না বলে অভিযোগ রয়েছে। এমনকি আইন লঙ্ঘনকারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ারও নজির দেখাতে পারেনি রাজউক। অন্যদিকে ২০০৮ সালের পরও অসংখ্য ভবন নির্মিত হয়েছে বিধিমালা না মেনেই।
Advertisement
ফায়ার সার্ভিসের জরিপ মতে, রাজধানীর ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ ভবনে অগ্নিনির্বাপণের কোনো ব্যবস্থা নেই। অতি ঝুঁকিপূর্ণ, ঝুঁকিপূর্ণ, কম ঝুঁকিপূর্ণ- এ তিন ক্যাটাগরিতে বিভক্ত করে ভবন মালিকদের অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা নেয়ার জোর তাগিদও দেয়া হয়েছিল ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে। তবে সে তাগিদ উপেক্ষা করে আসছে ভবন মালিকরা। এই উপেক্ষার পেছনে ভূমিকা রাখে গণপূর্ত বিভাগ এবং রাজউকের কর্মকর্তাদের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ দুর্নীতি।
অগ্নিকাণ্ডের প্রসঙ্গ নিয়ে কথা হয় রাজউক চেয়ারম্যান আব্দুর রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমরা পেছনে যেতে চাই না। সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য যা যা করার তাই করা হবে। আর কোনো ছাড় নেই। যারা আইন মানছে না তাদের ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার সময় এসেছে। আমরা অভিযান শুরু করেছি। এ অভিযান অব্যাহত থাকবে।
হাজার হাজার ভবন আইন না মেনেই নিমার্ণ করা হয়েছে। এখন অভিযানে ত্রুটিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করে কী লাভ হবে- এমন প্রশ্নের জবাবে রাজউক চেয়ারম্যান বলেন, আমরা সমাধানের পথ খুঁজছি। ২০০৮ এবং ১৯৯৬ সালের আগে যেসব ভবন নির্মাণ করা হয়েছে, সেসব ভবনে কীভাবে অগ্নিনির্বাপণ করা যায়, তার জন্য আমরা গবেষণা করছি, বিশেষজ্ঞের সঙ্গে বৈঠক করছি। অগ্নিকাণ্ড যত কমিয়ে আনা যায়, তার জন্য চেষ্টার কোনো ত্রুটি থাকবে না।
গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম এ প্রসঙ্গে বলেন, রাজধানী ঢাকা পরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠেনি, এটি অস্বীকার করতে কোনো দ্বিধা নেই। তবে এটি দীর্ঘদিনের ফল। একটি দেশের প্রাণ হচ্ছে রাজধানী। রাজধানী ঢাকাকে বাসযোগ্য নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে শেখ হাসিনার সরকার নিরলস চেষ্টা করে যাচ্ছে। পরপর তিনটি দুর্ঘটনা অত্যন্ত দুঃখজনক বলে মনে করি। এখন সময় এসেছে আমাদের দায়িত্ববোধের জায়গা থেকে ভূমিকা রাখা। মানুষের নিরাপত্তার জন্য সব বিধান মানতে বাধ্য করা হবে।
এএসএস/এমএসএইচ/পিআর