বিনোদন

‘মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে মাকেই মনে পড়ছিল’

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে মাতৃভূমির জন্য জীবনবাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। তখন তার বয়স মাত্র ১৬ বছর। আর যুদ্ধজয়ের পর জড়িয়ে পড়েন সাংস্কৃতিক আন্দোলনে। তিনি অভিনেতা ও মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউল হাসান কিসলু। দেশের অন্যতম নাট্যসংগঠন নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের এই অভিনেতা টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রেও অভিনয় করে খ্যাতি কুড়িয়েছেন। মহান স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে মুক্তিযোদ্ধা কিসলু শুনিয়েছেন যুদ্ধজয়ের গল্প। সেই স্মৃতিচারণ তুলে ধরা হলো।

Advertisement

আমি ১২ মার্চ চট্টগ্রাম ছিলাম। ওখান থেকে আমার গ্রামের বাড়ি বরিশালে আসি। ১৯৭১ সালে আমার বয়স ছিল ১৬ বছর। আমি দশম শ্রেণির ছাত্র ছিলাম। আমি স্কুলের ছুটিতে বাড়িতে এসেছি। সেই সময় শহর ছেড়ে গ্রামে পালিয়ে আসছে অনেক মানুষ। চট্টগ্রামের অবস্থাও ভালো নয়।

গ্রামে এসেই দেখলাম একগ্রাম থেকে অন্যগ্রামে পালিয়ে বেড়াচ্ছে মানুষ। আমার মন ছটফট করে। যু্দ্ধে যেতে ইচ্ছে করে। আমি ভাবলাম এইভাবে পালিয়ে বেড়ানোর কোনো মানেই হয় না। সেপ্টেম্বর মাসে আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি যুদ্ধে যাবই।

সেই সময় স্বাধীন বাংলা বেতারে যে গানগুলো বাজানো হতো, সেই গানগুলো আমাদের যুদ্ধে যাবার অনুপ্রেরণা ছিল। এই গানগুলো আমাদের রক্ত গরম করে দিতো। আমি ছোট বলে কেউ আমাকে যুদ্ধে নিয়ে যেতে চায় না। পরে ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বরে আমাদের গ্রাম থেকে ১০ জনের একটা দল যুদ্ধে যাচ্ছিল। তাদেরকে অনেক করে বলে রাজি করালাম।

Advertisement

মাকে তো বলা যাবে না। একদিন সকাল বেলা, তখন ছোট ভাইয়েরা মাছ ধরতে গেছে। মা আমাকে খিচুড়ি খেতে দিয়ে পুকুরে গোসল করতে গেল। আমি কয়েকটা কাপর-চোপড়, নজরুলের সঞ্চিতা, আর একটা ডায়েরি নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লাম। নজরুলের কবিতাও আমাকে উজ্জীবিত করতো। আর ডায়েরি নিলাম, যুদ্ধের ঘটনা লিখে রাখবো বলে। আড়িয়াল খাঁ নদীর পাড়ে ১০ জন আমার জন্য অপেক্ষা করছে। লুকিয়ে তাদের সঙ্গে চলে আসি।

যুদ্ধে যাওয়ার পথেই সাংঘাতিক একটা দুর্ঘটনা ঘটে। সাত-আটটা নৌকা চেঞ্জ করে মধুমতি নদী হয়ে, যশোর বর্ডার পার হয়ে যুদ্ধের ট্রেনিং নিয়েছি। যশোরে কালা নামে একটা জায়গায় এক বিল থেকে আরেক বিল পার হতে গিয়ে বিপদে পড়ি আমরা। সেখানে রাজাকাররা আমাদের ওপর আক্রমণ করে।

সেপ্টেম্বরের ২৩ তারিখ গভীর রাত। অনেক শীত পড়েছে। আমরা ১১ জন নৌকায়। রাজাকাররা গুলি করতে শুরু করলো। আমাদের মধ্য থেকে তিন-চারজন জীবন বাঁচাতে লাফ দিয়েছিল। আমিও ছিলাম। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আর কারও কথা নয়, বারবার শুধু মায়ের কথাই আমার মনে পড়ছিল।

আমার এখনই এই বিলের পানিতে মৃত্যু হলে মায়ের কী ভীষণ কষ্ট হবে আমার জন্য। মা কাঁদতে কাঁদতে মরেই যাবে। এসব কথা ভাবতে ভাবতে তলিয়ে যাচ্ছিলাম। শেষ মুহূর্তে বাঁচার জন্য আর একবার চেষ্টা করে উপরে ভেসে উঠে দেখি একটি নৌকায় করে শরণার্থীরা যাচ্ছে। তখনই চিৎকার করে উঠি ‘বাঁচাও’ বলে। ওরা আমাকে নৌকায় তুলে নিল। এখনো সেই দিনের কথা মনে হলে শিউরে উঠি।

Advertisement

এমএবি/জেএইচ/এমএস